মহাকরণে মুখ্যমন্ত্রী মমতা বন্দ্যোপাধ্যায়ের সঙ্গে স্পোর্টস স্কুল নিয়ে আলোচনা করে ফেরার পর রাতে ময়দানের ক্লাব তাঁবুতে দাঁড়িয়ে এম সি মেরি কম জানিয়ে দিলেন, তিনি রাজনীতিতে আসতে চান না।
মণিপুরের রাজনৈতিক টালমাটাল সামলাতে এক সময় লন্ডন অলিম্পিকের ব্রোঞ্জজয়ী ঠিকই করে ফেলেছিলেন, তিনি রাজনীতিতে যোগ দেবেন। যাতে রাজ্যে শান্তি ফেরে। তা নিয়ে প্রচুর জল্পনাও হয়েছিল। কিন্তু কলকাতায় এক দিনের ঝটিতি সফরে এসে তাঁর সরাসরি মন্তব্য, “রাজনীতিতে আসার কথা আমি ভাবছি না। বরং ভাবছি পরের কমনওয়েলথ গেমস। এশিয়াড। এবং অলিম্পিকের কথা। রিও-তে আমি পদকের রংটা বদলাতে চাই।” মানেটা খুব সহজ। আর ব্রোঞ্জ নয়, এ বার সোনার লক্ষ্য। |
সংবর্ধনামঞ্চে সোমা বিশ্বাস, মেরি কম, দোলা ও
রাহুল বন্দ্যোপাধ্যায়, জয়দীপ কর্মকার। ছবি: উৎপল সরকার। |
বেঙ্গালুরু এবং অসমের একটি পত্রিকার উদ্যোগে অলিম্পিকে পদক জয়ের পর এই প্রথম মেরির কলকাতায় আসা। স্বামীকে সঙ্গে নিয়ে। কিন্তু তাঁর সঙ্গে সারা দিনই সব অনুষ্ঠানে উপস্থিত থেকেছেন রাজ্যের কোনও না কোনও মন্ত্রী। মমতা যখন তাঁর হাতে রাজ্য সরকারের পক্ষ থেকে দু’লক্ষ টাকার চেক তুলে দেন, তখন সেখানে উপস্থিত একঝাঁক মন্ত্রী। মণিপুরে তৃণমূল কংগ্রেস বিরোধী দল। তাই মেরি কম মহাকরণে যাওয়ার আগে জল্পনা চলছিল, মণিপুরের জনপ্রিয়তম ক্রীড়াবিদ তা হলে কী রাজনীতিতে আসছেন? কিন্তু সব বিতর্কেই জল ঢেলে তিনি জানিয়ে দেন, “মুখ্যমন্ত্রীর সঙ্গে আমার মেয়েদের বক্সিং এবং স্পোটর্স স্কুল নিয়ে কথা হয়েছে। উনি আমাকে বলেছেন পরের বার কিন্তু আমাকে সোনা জিততেই হবে।” আর রাজনীতি? রাতে অসুস্থ হয়ে পড়া মেরি কম শুধু হেসেছেন। আর বলেছেন, “না, ও দিকে এখনই নয়।”
এ দিন মেরি কমের সঙ্গে রাজ্য থেকে লন্ডন অলিম্পিকে যাওয়া সব ক্রীড়াবিদকেই পঞ্চাশ হাজার টাকা করে পুরস্কার দেন মুখ্যমন্ত্রী। মেরি কম এবং অন্য অলিম্পিয়ানদের সঙ্গে মুখ্যমন্ত্রী প্রায় চল্লিশ মিনিট কথা বলেন। সেখানে মেয়েদের বক্সিং অ্যাকাডেমি, আর তিরন্দাজি অ্যাকাডেমি নিয়ে অনেক কথা হয়। জয়দীপ কর্মকারকে মুখ্যমন্ত্রী বলেন, “আমি পিটিউষা এবং সুশীল কুমারকে রেল ছাড়তে বারণ করেছিলাম। ওদের আমি স্পেশ্যাল পদে নিয়োগ করেছিলাম। তুমি রেলে থাক। আমি রেলমন্ত্রীকে বলব তোমার যাতে চাকরির আরও উন্নতি হয়।” |
শহরে মেরি কমের ছবি তুলেছেন উৎপল সরকার। |
জয়দীপ জমির প্রসঙ্গ তুললে মমতা তাঁকে বলেন, ক্রীড়ামন্ত্রী মদন মিত্রের সঙ্গে যোগাযোগ করতে। মুখ্যমন্ত্রী সবার কাছেই জানতে চেয়েছিলেন, এ রাজ্যে খেলাধুলোর উন্নতির জন্য কী করা উচিত? মেরি তখন তাঁকে বলেন, চিনে যে রকম স্পোর্টস স্কুল আছে। এখানেও সে রকম থাকা দরকার। রাজ্যে যদিও বাম-আমলে তৈরি হওয়ার তিরিশটা স্পোর্টস স্কুলের বেশির ভাগই এখনও বন্ধ। রাজ্য ক্রীড়াপর্ষদ নতুন সরকারের দেড় বছরের মধ্যেও সেগুলো চালু করতে পারেনি।
এ দিন সকাল থেকে একটার পর একটা অনুষ্ঠানে ছুটতে হয়েছে বক্সার মেরিকে। মিডিয়ার হুড়োহুড়ি, বক্তৃতা, সংবর্ধনার ফুলের তোড়া, উত্তরীয়, আর্থিক পুরস্কারমেরিকে ঘিরে আজ কোনও কিছুর বাদ ছিল না। মজার হচ্ছে, বক্সিং রিং-য়ে যে মেয়েকে ধ্বংসের মেজাজে ‘আপার কাট’, ‘জ্যাব’ করতে দেখে শিহরণ জাগে, তিনিই এ দিন সংবর্ধনায় ঠেলায় হাঁসফাস। প্রায়ই নার্ভ হারালেন!
একটা ব্রোঞ্জ পদক জীবন তা হলে কতটা পাল্টে দিল মেরির?
“মানুষ মেরি কিন্তু বদলায়নি,” একগাল হেসে সকালে বলছিলেন মেরি। তাঁর দু’চোখের সারল্য, চার দিক থেকে ফ্ল্যাশবাল্বের ঝলকানিতে থতমত মেরিকে দেখে তখন কে বলবে, এই মেয়ে বক্সিং লড়েন! মাথায় কখনও পরিয়ে দেওয়া হচ্ছে, ‘জাপি’। যা সামলাতে তিনি ব্যতিব্যস্ত। কখনও কাটতে হচ্ছে বক্সিং গ্লাভসের আদলে কেক। |
অলিম্পিকে ব্রোঞ্জজয়ী মেরি কমের সঙ্গে মুখ্যমন্ত্রী।
বৃহস্পতিবার মহাকরণে। ছবি: দেবাশিস রায় |
তারই মধ্যে কোনও রকমে বললেন, “এখন সবাই আমাকে চেনে। দেশের যেখানেই যাই, আমাকে সবাই ঘিরে ধরে। বলে, মেরি কম তোমার জন্য আমরা গর্বিত। সে দিক থেকে দেখলে জীবন তো কিছুটা বদলেছে বটেই।” তাঁর মতো যাঁরা লন্ডন অলিম্পিকে পদক পাননি, তাঁদের জন্যও বার্তা ছেড়ে রাখলেন মেরি। খুবই সোজাসাপ্টা সেই বার্তা“আমি পারলে, তোমরাও পারবে।”
তবে তিনি নিজে এখনও গর্বিত নন নিজেকে নিয়ে। মেরি মনে করেন, গর্ব করার মতো কিছু করেননি জীবনে। বলছেন, “কী ভাবে তৃপ্ত হব? রিওতে সোনা জিততে হবে। যদি ৪৮ কেজি বিভাগ তাকে ওখানে, তা হলে আমিই হব সবচেয়ে কড়া প্রতিদ্বন্দ্বী। নইলে ৫১ কেজিতে নামব। সে ভাবেই তৈরি করছি নিজেকে। তাই মেরি কম নিজেকে নিয়ে এখনও গর্বিত নয়। সেটা হওয়া বাকি আছে।” |