প্রশ্ন: গোল করার পর প্রথমে বুকে হাত দিয়ে ঈশ্বরকে ধন্যবাদ দিলেন। তার পরে অজানা কারও উদ্দেশ্যে চুমু ছুড়লেন। গোল দু’টো যাঁকে উৎসর্গ করেছেন, চুমুটাও কি তাঁকেই দিলেন? ইস্টবেঙ্গলের শীর্ষকর্তাকে?
টোলগে: আরে না, না (বিব্রত মুখ) আমার আর নীতুদার মধ্যে ঠিক চুমু আদানপ্রদানের সম্পর্ক নেই। ওটা দিচ্ছিলাম মোহনবাগানের সেই সব সমর্থককে, যাঁরা গত তিন মাস...
থামিয়ে দিলেন টোলগের স্বদেশীয় বান্ধবী, লিভ-ইন গার্লফ্রেন্ড সেরাপ, “একেবারে বাজে কথা। চুমুটা আমাকে দেওয়া।”
টোলগে: আরে, সেরাপ তো মোহনবাগান সমর্থকদেরই অংশ হয়ে গিয়েছে। এই ক’টা মাস খারাপ সময়ে যাঁরা আমার সঙ্গে ছিলেন তাঁদের চুমু দিয়ে ধন্যবাদ দিতে চাইছিলাম। ওঁদের দেওয়া মানে সেরাপকেও দেওয়া।
প্র: যুবভারতীর খেলা শেষ হয়ে গিয়েছে ঘণ্টা সাতেক হল। এখনও বাড়িতে যে টি শার্ট পরে দেখছি, তাতে লেখা ম্যাকডাওয়েল মোহনবাগান। বাড়িতেও কি এখন মোহনবাগানি থাকছেন?
টোলগে: না, না। মাঠ থেকে বেরোবার আগে এটা পরেছিলাম। আর খোলা হয়নি।
প্র: ইস্টবেঙ্গল শীর্ষকর্তাকে আপনার গোল উৎসর্গ করা নিয়ে কিন্তু ময়দান তেতে গিয়েছে। দেবব্রত সরকার বলেছেন হায়েস্ট স্কোরার হওয়ার আগে এখনই আপনার উৎসর্গের সিদ্ধান্তে উনি বিস্মিত।
টোলগে: তাই বলেছে বুঝি? যাক, আমি খুশি যে আমার রসিকতাটাকে বুঝে উনি ফিরিয়ে দিয়েছেন।
প্র: পরের দিন গোল করে কাকে উৎসর্গ করবেন? ট্রেভর মর্গ্যানকে?
টোলগে: (নিমেষে মুখ গম্ভীর) আমি আর ট্রেভর এখন দুটো বিপরীত দলে। কলকাতায় ট্রেভরই আমার প্রথম কোচ। যদিও গত কয়েক মাসে ওর সঙ্গে কোনও আলোচনা হয়নি। আমার মনে হয়, ট্রেভরকে অনেক গোল অলরেডি দিয়েছি। আর নতুন করে উৎসর্গ না-ই বা করলাম।
প্র: ট্রেভরের সঙ্গে আলোচনা করেননি কেন? উনি তো মধ্যস্থতা করতে পারতেন।
টোলগে: আমার বাবা ওঁকে ফোন করে বলেছিলেন, ব্যাপারটা একটু দেখতে। উনি স্ট্রেট না বলে দেন। বলেন, উৎসাহী নন। তার পর ওর সঙ্গে আর কথা বলার মানে হয় না। আফটার অল হান্ড্রেড পার্সেন্ট পেশাদার কোচ।
প্র: ইস্টবেঙ্গল টেন্টে শোনা যাচ্ছে কোচ আপনাকে ফিরিয়ে নিতে চাননি। তাঁর মনে হয়েছে আপনি শৃঙ্খলাভঙ্গ করেছেন।
টোলগে: অনেক কিছু বলা হয়েছে। অনেক কিছু শোনা হয়েছে। আমি আর সেসবে ফিরে যেতে চাই না।
প্র: খুব সহজে বলুন, ইস্টবেঙ্গল ছাড়লেন কেন? লাল-হলুদ জনতা জানতে চায়!
টোলগে: ঠিকঠাক লোকেরা কারণ জানে। আমার আর নতুন করে বলার কিছু নেই। কোনও একটা দিন নিশ্চয়ই মুখ খুলব। সেই সময়টা এখন নয়। এটুকু বলতে পারি টিমমেটদের সঙ্গে কোনও সমস্যা হয়নি। ইস্টবেঙ্গল অফিশিয়ালদের সঙ্গেও দু’বছর ধরে আমার বেশ ভাল সম্পর্কই ছিল।
প্র: তা হলে তো পড়ে রইল বেচারি কোচ। কোচের জন্য ছেড়েছেন?
টোলগে: যা বলার আমি বলেছি। এর বেশি এই স্টেজে আমি বলব না।
প্র: বিতর্কের মুখে পড়া টোলগে আর বিতর্ক থেকে বেরিয়ে আসা টোলগে, তফাত কী?
টোলগে: মধ্যিখানে একটা সাত সপ্তাহের ছুটি কাটানো আছে। ছুটির আগে আমি ক্রমাগত দুশ্চিন্তা করে যাচ্ছিলাম। প্রচণ্ড উত্তেজিতও ছিলাম। অঞ্জনদা, দেবাশিস এরা আমায় বারবার বলছিল, চিন্তা কোরো না। তুমি ঠিক সময়ে মাঠে নামবে। কিন্তু আমার চিন্তা যাচ্ছিল না। রাগটাও না। ছুটিতে বসে অনেক ভাবি। নিজেকে নিজে বলি, এই ঘটনাটা হচ্ছে স্রেফ আমার পুরনো ক্লাব আমায় রাখতে চায় বলে। কোনও অসূয়া থেকে নয়। তখনই রাগটা চলে যায়।
প্র: শুনলাম তাইল্যান্ডে আপনি ঝুঁকি নিয়ে বাঙ্গি জাম্পিং করেছেন। এটা কেন? ইস্টবেঙ্গল কর্তারা প্রচণ্ড চাপে ফেলে দিয়েছিলেন বলে?
সেরাপ: ও কিন্তু বাঙ্গি জাম্পিং করার লোকই না। যখন করতে গেল আমি আশ্চর্য হয়ে যাই। কিছুতেই শুনল না।
প্র: প্রতিবাদে আপনি টোলগেকে কী শাস্তি দিলেন?
সেরাপ: অনেকক্ষণ কথা বলিনি ওর সঙ্গে। আমি এখনও ভাবতে পারছি না কী করে অত উঁচু থেকে লাফাতে চলে গেল।
প্র: অত উঁচু থেকে লাফানোর সময় নীচে কাকে দেখছিলেন? নীতু সরকারকে না মর্গ্যানকে?
টোলগে: ধুস, ওদের কাউকেই দেখিনি। এর আগে যখন প্যারিস বেড়ানোর সময় আইফেল টাওয়ারে সম্মোহিত হয়ে উঠছিলাম, তখনও ওদের নামগুলো আমার তালিকার শেষে ছিল। আমি তো এখনও বুঝতে পারিনি, আমার মোহনবাগানে যাওয়া নিয়ে এত হুড়ুমতাল বাঁধার কী ছিল? কীসের এত চেঁচামেচি?
প্র: আপনি এমন সব ঘটনা ঘটিয়েছেন কলকাতা ময়দান আগে দেখেনি।
টোলগে: কী এমন ঘটিয়েছি আমি?
প্র: আপনি ইস্টবেঙ্গলের হয়ে লিগের শেষ ম্যাচে হ্যাটট্রিক করলেন। করে কয়েক ঘণ্টার মধ্যে মোহনবাগানের হয়ে প্রেস কনফারেন্স করলেন। ভাবাই যায় না।
টোলগে: কী বলছেন মশাই! ইউরোপে একজন প্লেয়ার ট্রান্সফার নেওয়ার ছ’মাস আগে সবাই জেনে যায় সে চলে যাচ্ছে। লিগের ওই ম্যাচটার পরে ইস্টবেঙ্গলের সঙ্গে আমার চুক্তি শেষ হয়ে যায়। তার পর তো আমি মুক্ত পাখি। আমি যে কোনও জায়গায় যেতেই পারি। ওই সাংবাদিক সম্মেলনটা যদি এত নড়াচড়ার কারণ হয়, তা হলে সাফ বলছি তার জন্য একটুও দুঃখিত নই। এত শোরগোল কীসের ভাই? ওই সাংবাদিক সম্মেলনেই যদি বলতাম, আমি ইস্টবেঙ্গলে থেকে যাচ্ছি, তা হলে কি এসব হত? আসল কথা হল, কিছু লোকে যেটা আমার মুখে শুনতে চেয়েছিল, সেটা শুনতে পারেনি।
প্র: কী গ্যারান্টি এক বছর পর এই সাউথ সিটির ফ্ল্যাটে বসে আপনার মুখে একই রকম বিষ প্রতিক্রিয়া মোহনবাগান কর্মকর্তাদের সম্পর্কে শুনব না?
টোলগে: পেশাদার ফুটবলারের জীবনে যা কিছু ঘটতে পারে। ভাল সময় আসে। খারাপ সময় আসে। আমি বোধহয় সবচেয়ে খারাপ সময়ের মধ্যে দিয়ে গেলাম। আশা করি, সেটা কাটিয়ে উঠেছি। আর ফেডারেশন কাপে নতুন সময়ের মধ্যে ঢুকে যেতে পারব।
প্র: কিন্তু পরিস্থিতিটা তো মোহনবাগানে অন্য রকম। এখানে মহানায়ক হলেন ওডাফা। আপনি পার্শ্বনায়ক। সেটা মানিয়ে নিতে সমস্যা হবে না?
টোলগে: সেটা মানিয়ে নিয়েই তো এসেছি। আমি মনে করি ওডাফা সত্যিই বেস্ট প্লেয়ার। গত দু’টো মরসুম দারুণ খেলেও যে ও গোল্ডেন বুট পায়নি সেটা ওর দুর্ভাগ্য। ও রিয়েল স্টার। আমার দায়িত্ব হল, ওদের সঙ্গে থেকে টিমটাকে ট্রফি জিততে সাহায্য করা।
প্র: লোকে বলে দু’জন দক্ষ স্ট্রাইকার সাধারণ ভাবে দুই সুন্দরী মহিলার মতো। কেউ কাউকে সহ্য করতে পারে না।
টোলগে: তা ঠিক। সাধারণ ভাবে স্ট্রাইকাররা একটু স্বার্থপর হয়।
প্র: ওডাফাও থাকেন সাউথ সিটিতে। ক’দিন দেখা হয় আপনাদের?
(সেরাপ ব্যাপক অস্বস্তির সঙ্গে টোলগের দিকে তাকিয়ে)
টোলগে: (গলা খুকখুক করে) হ্যাঁ, ও আমার প্রতিবেশী। মাঝে মাঝে দেখি। তবে ওডাফা রিয়েল ফ্যামিলি ম্যান। চারটে বাচ্চা আছে। বেচারা সময়ই বা পায় কোথায়? তবে দুশ্চিন্তার কোনও কারণ নেই। আমার আর ওডাফার সম্পর্ক ভাল। নিজেদের মধ্যে কোনও প্রতিযোগিতা নেই। আর মনে রাখবেন দু’জনেই পারফর্মার। আজকের ম্যাচটা দেখুন না, সেকেন্ড হাফে ওডাফা এসেই তো ঘোরাল।
প্র: টোলগে ওজবের পৃথিবী এই ক’মাসে কতটা বদলেছে?
টোলগে: হুঁ, আগে মানুষকে সহজে বিশ্বাস করতাম। গত ক’মাসের ঘটনাপ্রবাহ আমাকে মানুষ সম্পর্কে সন্দিগ্ধ করে তুলেছে। অনেকের সত্যিকারের চেহারা আমি দেখে ফেলেছি। বুঝে গিয়েছি কারা আমার সত্যিকারের বন্ধু আর সমর্থক।
প্র: ইস্টবেঙ্গল সমর্থকদের কী বলবেন?
টোলগে: বলব যে আপনাদের টিমের দু’টো খেলা আমি ইন্টারনেটে দেখেছি। ওদের কিন্তু খুব ফিট এবং ধারালো মনে হচ্ছে। যদিও তেমন কঠিন প্রতিদ্বন্দ্বী এখনও খেলেনি।
প্র: আর মোহনবাগান সমর্থকদের?
টোলগে: বলব, আমি আশা করি আপনাদের সুখ দিতে পারব।
প্র: নতুন কোচ কেমন?
টোলগে: খুব ভাল। আমি তো ওঁকে চিনতামই না। এখন রোজ সকালে উঠে ওঁনার দৌলতে মনে হয় প্র্যাক্টিসে যাই। আনন্দ করে আসি। এটাই চলে গিয়েছিল।
প্র: আজ ভারতে শিক্ষক দিবস। জানেন?
টোলগে: না।
প্র: ময়দানে আপনার প্রথম শিক্ষক ট্রেভর মর্গ্যানকে কী বলবেন আজকের দিনে?
টোলগে: (গুম হয়ে গিয়ে) একটা কথাও নয়। একটা কথাও বলব না।
প্র: সে কী! একটা কথাও বলবেন না?
টোলগে: না। কিছু বলার দরকার নেই।
প্র: শুনেছি আপনি ইস্টবেঙ্গলে মুচলেকা দিয়ে একটা বন্ডে সই করেছেন। তার পরেও এত কথা বলছেন কী করে?
টোলগে: আমি তো সে রকম কিছু খারাপ কথা এখনও বলিনি। যেগুলো না বললেই নয়, সেগুলো বলেছি। তবে ভবিষ্যতে হয়তো আরও মুখ খোলার সময় আসবে। |