দিনেদুপুরে হাতে বন্দুক ও চপার, মুখে রুমাল বাঁধা কয়েক জনকে রাস্তায় দৌড়তে দেখে ধাওয়া করেছিল পাড়ার ছেলেরা। মোটরবাইকে উঠে তাদের দিকে বন্দুক তাক করে ‘জানে মেরে দেওয়ার’ হুমকি দিয়ে পালাল দুষ্কৃতীরা। বৃহস্পতিবার বেসরকারি একটি আর্থিক সংস্থার বরাহনগর ও দক্ষিণ সিঁথির দু’টি অফিসে হানা দেওয়ার পরে এমন ভাবেই গা-ঢাকা দিল সশস্ত্র ডাকাতদল। তাদের অস্ত্রের আঘাতে জখম ওই সংস্থার কয়েক জন কর্মী ও গ্রাহক।
বরাহনগরে বি টি রোডের সুভাষপল্লি এলাকায় বেসরকারি ওই আর্থিক সংস্থার আঞ্চলিক সদর অফিস। সোনা বন্ধক রেখে ঋণ দেয় ওই সংস্থা। এ দিন দুপুরে প্রথমে সেখানেই হানা দেয় ডাকাতেরা।
পুলিশ সূত্রের খবর, ওই অফিসে একসঙ্গে দু’জনের বেশি গ্রাহককে ঢুকতে দেওয়া হয় না। তখন বেলা ১১টা। বছর তিরিশের এক যুবক ওই অফিসে ঢোকে। নিরাপত্তাকর্মী কোল্যাপসিব্ল গেট টেনে বন্ধ করতে যেতেই তাঁকে ধাক্কা মেরে সরিয়ে দেয় যুবক। পকেট থেকে আগ্নেয়াস্ত্র বার করে রক্ষীর কপালে ঠেকিয়ে বলে, ‘দরজা বন্ধ করবি না।’ তখনই দরজার বাইরে থাকা আরও সাত জন দুষ্কৃতী মুখে রুমাল বেঁধে হুড়মুড়িয়ে অফিসে ঢুকে পড়ে। সকলের বয়স ৩০-৩২ বছরের মধ্যে। কর্মীদের এলোপাথারি মারধর করতে শুরু করে তারা। সকলের হাতেই ছিল বন্দুক, চপার। অভিযোগ, অফিসের ক্যাশ কাউন্টার থেকে এক লক্ষ টাকা, ১৪২ গ্রাম সোনা লুঠ করে ডাকাতেরা। অস্ত্র দেখিয়ে কর্মীদের মোবাইল ফোন ছিনিয়ে নেয়। যাওয়ার আগে ভেঙে দেয় ক্লোজ্ড সার্কিট টিভির ক্যামেরা। |
সশস্ত্র ডাকাতেরা যে ভিতরে লুঠপাট চালাচ্ছে, তা টের না-পেয়েই ওই অফিসে ঢুকেছিলেন স্থানীয় বাসিন্দা সুইটি ও শম্পা সরকার। তাঁরা জানান, ঋণের কিস্তি মেটানোর জন্য ৪০ হাজার টাকা ছিল তাঁদের কাছে। শম্পাদেবী বলেন, “কয়েক জন লোক এ দিক-ও দিকে দাড়িয়ে ছিল। নিরাপত্তারক্ষীর পাশেও ছিল এক জন। হঠাৎ ওদের এক জন সামনে এসে বন্দুক দেখাল। বলল, ব্যাগে যা রয়েছে দিয়ে দিন। ভয়ে টাকাটা ব্যাগ থেকে বার করে দিই।” ওই দুই মহিলার মোবাইল ফোনও নিয়ে নেয় দুষ্কৃতীরা। ভল্টের চাবি দেওয়ার জন্য কর্মীদের ভয় দেখাতে থাকে। রাজি না-হওয়ায় কয়েক জনকে বন্দুকের বাঁট দিয়ে মারে ডাকাতেরা। ওই সময়েই সুযোগ পেয়ে বিপদঘন্টি বাজিয়ে দেন এক কর্মী। বেগতিক দেখে পালায় দুষ্কৃতীরা।
খবর পেয়ে ঘটনাস্থলে যায় বরাহনগর থানার পুলিশ। সেখানে যান ব্যারাকপুরের পুলিশ কমিশনার সঞ্জয় সিংহ, গোয়েন্দাপ্রধান কল্যাণ মুখোপাধ্যায়-সহ পদস্থ আধিকারিকেরা। সিআইডি-র তদন্তকারীরাও ওই অফিস থেকে আঙুলের ছাপ সংগ্রহ করেন। আশপাশের কয়েকটি থানার পুলিশকে ডেকে পাঠানো হয়। ঘটনার সময়ে ওই অফিসে উপস্থিত কর্মী, গ্রাহকদের কাছ থেকে দুষ্কৃতীদের বিরবণ জেনে নেন তদন্তকারীরা। পুলিশ সূত্রের খবর, ডাকাতদের এক জন হলুদ টি-শার্ট পরেছিল। ডোরাকাটা জামা, জিন্স পরা আর এক দুষ্কৃতীর পিঠে ছিল একটি ছোট ব্যাগ।
ওই অফিসে তদন্ত চলাকালীনই পুলিশকর্তারা খবর পান, দক্ষিণ সিঁথিতে ওই একই সংস্থার অফিসে হানা দিয়েছে ডাকাতেরা। সেখানেও ছিল হলুদ টি-শার্ট, ডোরাকাটা জামার দু’জন দুষ্কৃতী। পুলিশ জানায়, বিকেল তিনটে নাগাদ সিঁথির ওই অফিসে একসঙ্গে তিন জন দুষ্কৃতী ঢুকতে চেষ্টা করে। নিরাপত্তাকর্মী বাধা দিলে চপার দিয়ে তাঁর আঙুলে কোপ মারে এক জন। বাকিরা আগ্নেয়াস্ত্র বার করে। তা দেখতে পেয়ে বিপদঘন্টি বাজিয়ে দেন অফিসের ম্যানেজার। চম্পট দেয় দুষ্কৃতীরা। চিৎকার শুরু করেন অফিসের কর্মীরাও। |
সামনের রাস্তায় স্থানীয় কয়েক জন যুবক গল্পগুজব করছিলেন। তাঁদের এক জন বলেন, “তিনটে লোক ব্যাঙ্ক থেকে দৌড়ে বেরোচ্ছিল। আমরা পিছনে ধাওয়া করি। কিছুটা দূরে রাস্তায় নম্বরপ্লেট ছাড়া দু’টি পুরনো বাইক রাখা ছিল। আরও তিন জন ছিল সেখানে। পালিয়ে গিয়ে বাকিরা মোটরবাইকে উঠে আমাদের দিকে বন্দুক তাক করে শাসানি দেয়। ভয়ে আর এগোতে পারিনি।” এলাকার অন্য কয়েক জন যুবক মোটরবাইকে দুষ্কৃতীদের ধাওয়া করেন। তাঁরা পুলিশকে জানিয়েছেন, চিড়িয়ামোড়ের দিক থেকে ওই মোটরবাইকগুলি দমদমের দিকে চলে যায়। পুলিশ সূত্রের খবর, এ দিন দুপুরে লুঠ হওয়া কয়েকটি মোবাইলের টাওয়ারের অবস্থান দেখা গিয়েছে কাশীপুর এলাকায়।
ব্যারাকপুরের পুলিশ কমিশনার সঞ্জয় সিংহ বলেন, “জনা দশেক দুষ্কৃতী হানা দিয়েছিল। কয়েক জন ভিতরে ঢুকে লুঠপাট চালায়। দু’টি ঘটনারই তদন্ত শুরু হয়েছে। সংস্থার কর্মকর্তাদেরও জিজ্ঞাসাবাদ করা হচ্ছে।” পুলিশ সূত্রের খবর, পরপর দু’টি জায়গায় একই ডাকাত-দলের হামলার ঘটনা কিছুটা বিরল। সাধারণ ভাবে ডাকাতির পরে লুঠ করা জিনিস নিয়ে দ্রুত গা-ঢাকা দেয় দুষ্কৃতীরা। এ ক্ষেত্রে ফের তারা অন্য জায়গায় হানা দিয়েছে। ওই দু’টি ঘটনায় আর্থিক সংস্থাটির কারও যোগশাজস রয়েছে কি না, তা-ও তদন্তে দেখা হচ্ছে। বরাহনগরের ঘটনায় ক্লোজ্ড সার্কিট টিভির যান্ত্রিক জটিলতার জন্য ডাকাতির ঘটনার ফুটেজ দেখতে পারেননি তদন্তকারীরা। গোয়েন্দাপ্রধান বলেন, “ঘটনাটি সন্দেহজনক। অনেক প্রশ্ন উঠে আসছে। এ ভাবে কাছাকাছি জায়গায় একই প্রতিষ্ঠানে দু’বার ডাকাতির চেষ্টা সচরাচর দুষ্কৃতীরা করে না। এটাই আরও বেশি সন্দেহ তৈরি করছে। গ্রাহক-সহ সংস্থার কর্মী বা কর্তাদেরও আমরা জিজ্ঞাসাবাদ করছি।”
গত বছর ১৪ অক্টোবর বেলঘরিয়ায় বি টি রোডে একই আর্থিক সংস্থার অফিসে জনা দশেক দুষ্কৃতী হামলা চালিয়েছিল। সে বার কর্মী, গ্রাহকদের ভল্টে ঢুকিয়ে সোনা, নগদ টাকা লুঠ করে পালায় তারা। জেলা পুলিশের বিশেষ তদন্তকারী দল কাজ শুরু করে। ওই দলে বরাহনগর থানার আইসি হিমাদ্রি বন্দ্যোপাধ্যায়ও ছিলেন। কোনও কিনারা করতে না পারায় তদন্তভার যায় সিআইডি-র কাছে। তবে এখনও দুষ্কৃতীরা অধরাই রয়ে গিয়েছে।
এ দিন সন্ধ্যায় ১৪ অক্টোবরের ডাকাতির সিসিটিভি ফুটেজের সঙ্গে এ দিনের কাশীপুরে দুষ্কৃতীদলের হানা দেওয়ার ছবি মিলিয়ে দেখার পরে তদন্তকারীদের অনুমান, তিনটি ঘটনায় একই দল জড়িত। কলকাতা পুলিশের যুগ্ম কমিশনার (অপরাধ দমন) পল্লবকান্তি ঘোষ জানিয়েছেন, দু’টি ঘটনায় একই দল জড়িত কি না, তা দেখা হচ্ছে। এক তদন্তকারী অফিসার বলেন, “পাণ্ডা-সহ কয়েক জন দক্ষিণ ভারতীয়।” ঘটনাচক্রে সংস্থাটিও দক্ষিণ ভারতীয়। এই ধরনের আরও একটি সংস্থার সঙ্গে তাদের প্রতিযোগিতা চলে বলেও পুলিশ ওই সংস্থার কর্মকর্তাদের থেকে জানতে পেরেছে। এই ঘটনার পিছনে কোনও ব্যবসায়িক ষড়যন্ত্র রয়েছে কি না, তা-ও দেখা হচ্ছে।
|