যুবভারতীতে টোলগে ওজবের হ্যাটট্রিকের গোলটা বুধবার কেউ দেখেনি। আসলে মাঠে সেই গোলটা হয়ইনি। কিন্তু টোলগে এ দিন তাঁর ‘তৃতীয় গোল’টাও করলেন। পায়ে নয়, মুখে। ম্যাচের শেষে বলে দিলেন, “আজকের দু’টো গোল আমি নীতুদাকে উৎসর্গ করছি।” গত তিন মাসে তাঁর ঠোঁটের কোণ থেকে যে প্রাণোচ্ছল হাসিটা হারিয়ে গিয়েছিল, তা আবার চোখে-মুখে ফুটে উঠছে। তবে টোলগের কথা শুনে ইস্টবেঙ্গলের প্রধান কর্তা দেবব্রত সরকার (নীতু) আরও একধাপ এগিয়ে বললেন, “সে কী, এখনই করে দিল? আমি তো ভেবেছিলাম সর্বোচ্চ গোলদাতা হয়ে করবে।”
কৌতূহলের বোঁচকা নিয়ে যুবভারতীর গ্যালারিতে যে অচেনা মুখগুলো ঘোরাফেরা করছিল, তাদের সবার মনে একটাই প্রশ্ন বারবার উঁকি মারছিল। যে ক্লাবে খেলার জন্য দীর্ঘ তিন মাসের মহাসংগ্রাম, সেই সবুজ-মেরুন জার্সি গায়ে কি আবির্ভাবেই জ্বলে উঠতে পারবেন টোলগে? |
উত্তরের খোঁজে হা করে বসে থাকার প্রয়োজন নেই। অভিষেকেই নতুন ক্লাবকে অনন্য উপহার অস্ট্রেলীয় স্ট্রাইকারের জোড়া গোল। তিন মাস আগে যে বিন্দুতে শেষ করেছিলেন, বুধবার যেন ফের সেখান থেকেই শুরু করলেন। গতবার লিগের শেষ ম্যাচে ইস্টবেঙ্গলের হয়ে করেছিলেন চার গোল। এ বার দু’গোল দিয়ে মরসুম শুরু করলেন গঙ্গাপারের ক্লাবের জার্সিতে। পরিষ্কার বুঝিয়ে দিলেন, অভূতপূর্ব টানাপোড়েন তাঁর মানসিক কষ্ট বাড়িয়ে তুললেও, স্থিতি টলাতে পারেনি। পায়ের জাদু দেখানোর ক্ষমতায় আঁচড় কাটতে পারেনি একবিন্দুও। প্রতিদ্বন্দ্বী দলের কোচও তা স্বীকার করে গেলেন। “একটা ম্যাচ দেখে কিছু বলা কঠিন। তবে একটা কথা বলতে পারি, টোলগের খেলায় কোনও অবনতি হয়নি। সেই আগের মতোই গোলের খিদে,” বললেন জর্জ কোচ বিশ্বজিৎ ভট্টাচার্য।
ময়দানের মহাযুদ্ধে টোলগেকে ‘জিতে’ সবুজ-মেরুন পতাকা উড়িয়ে ছিলেন মোহন-সমর্থকরা। বুধবার যুবভারতীতে মরসুমের প্রথম ম্যাচে তাদেরই একটা বড় অংশ ভিড় জমিয়েছিলেন মাঠে। ভারী বর্ষাকেও তোয়াক্কা না করে। সাত বছরের সৈকত থেকে পঞ্চাশ ছুঁইছুঁই প্রবীরবাবু ম্যাচ শেষে সবার মুখেই টোলগে-বন্দনা। হবে না-ই বা কেন? প্রত্যাশার এভারেস্ট কাঁধে নিয়েও প্রথম ম্যাচেই যে ফুটবলটা খেললেন, তাতে ‘অন্য’ টোলগেকে খুঁজে পাওয়া গেল। গতি, শটের নিঁখুত নিশানা এবং বুদ্ধিদীপ্ত ফুটবলে ভরপুর। সবচেয়ে বেশি চোখ টানল, ‘টিমম্যান’ হয়ে ওঠার গুণ। যেটা ইস্টবেঙ্গলে শেষের দিকে তাঁর বিরুদ্ধে কিছুটা অভিযোগ ছিল। এ দিন টোলগে জার্সির পিঠে যেন একটা অদৃশ্য সাইনবোর্ড ঝুলিয়ে পুরো ৯২ মিনিট খেললেন-- ‘স্বার্থপরের মতো একাই সব গোল করতে চাওয়া নয়, টিমের স্বার্থে সতীর্থদের দিয়েও গোল করাব।”
টোলগেকে নিয়ে নাচানাচির মধ্যে আরও একটা কৌতূহল ঘুরপাক খাচ্ছিল ড্রেসিংরুমের আশেপাশে। টোলগের আবির্ভাবে কি ফিকে হয়ে যাচ্ছে ওডাফা ওকোলির আকাশছোঁয়া জনপ্রিয়তা? ম্যাচের পর যুবভারতীর চতুর্দিকে যে দৃশ্য চোখে পড়ল, তাতে ধাঁধা আরও বেড়ে গেল। চিত্রসাংবাদিক, টিভির বুম আর সমর্থকদের ঠাসা ভিড়ে যখন মুখ দেখা যাচ্ছে না টোলগের, তখন অন্য দিকে একা ওডাফা! কী অদ্ভুত, গটগট করে হেঁটে বেরিয়ে যাচ্ছেন নাইজিরিয়ান গোলমেশিন। আর তাঁকে নিয়ে কোনও হইচই হচ্ছে না!
ভয় নেই। মাঠের বাইরের লেন্সে যাই ধরা পড়ুক না কেন, মাঠের ভিতরে ওডাফাও এ দিন নায়ক। উপরের স্কোরলাইনে টোলগের নামের পাশে ‘২’ লেখা থাকলে কী হবে, এ দিন ওডাফার সৌজন্যেই কিন্তু মোহনবাগান দ্বিতীয়ার্ধে মালগাড়ি থেকে রাজধানী এক্সপ্রেস হয়ে উঠতে পেরেছিল। শুরুতে স্ট্যানলি থাকায় মাঝমাঠ থেকে বল বাড়ানোর কাজটায় যে হ্যাঁচকা টান পড়ছিল, সেটা বিরতির পর ওডাফা নামতেই মসৃণ হয়ে উঠল। জুয়েলের প্রথম গোল কিংবা টোলগের জোড়া গোল, সব ক্ষেত্রেই নিজের অদৃশ্য ছাপ রেখে গেলেন ওডাফা। শুধু মন্দভাগ্য, নিজে মরসুমের প্রথম ম্যাচেই গোলের মুখ দেখতে পেলেন না। ওডাফার দু’টো বিদ্যুৎ গতির শট একটা পোস্টে লাগল, অন্যটা ক্রসবারে। আরও দু’টো গোল বাঁচালেন জর্জ গোলকিপার স্বরূপ দাস।
কী দাঁড়াল? টোলগে-ওডাফা যুগলবন্দির ‘ফার্স্ট শো’ই সুপারহিট!
মোহনবাগানে খেলেন: শিল্টন, ইচে, রাজীব, বিশ্বজিৎ (লালরিন), মেহরাজ, ফানাই, স্ট্যানলি (ওডাফা), ডেনসন, জুয়েল, মণীশ, টোলগে। |