কয়লা কেলেঙ্কারি নিয়ে ডামাডোলে গত এগারো দিন ধরে বিশেষ কোনও কাজই হতে পারেনি সংসদে। তার উপর সরকারি চাকরিতে সংরক্ষণের প্রশ্নে আজ সাংসদদের হাতাহাতিও দেখে ফেলল রাজ্যসভা! সংসদেরই টিভি ক্যামেরার সৌজন্যে দুনিয়া দেখল বিশ্বের বৃহত্তম গণতন্ত্রের কদর্য চেহারাটি।
চরম হট্টগোলের মধ্যেও এ বারের বাদল অধিবেশনে সরকার ইতিমধ্যেই তিনটে বিল পাশ করিয়ে নিয়েছে। এবং কোনও রকম আলোচনা ছাড়াই। আজ অবশ্য সেটাও সম্ভব হয়নি। উত্তরপ্রদেশের দুই কট্টর প্রতিদ্বন্দ্বী সমাজবাদী পার্টি এবং বহুজন সমাজ পার্টির দুই সাংসদের হাতাহাতির জেরে সভা মুলতুবি হয়ে যাওয়ায় সরকারি কর্মীদের পদোন্নতিতে তফসিলি জাতি-উপজাতির জন্য সংরক্ষণ চালু করার বিলটি আজ পাশ করাতে ব্যর্থ হয় সরকার।
মুলায়ম সিংহ যাদবের দল আগেই আভাস দিয়ে রেখেছিল, সরকার ওই বিল আনলে তারা বিরোধিতা করবে। কিন্তু তা করতে গিয়ে তাদের এক সাংসদ আজ হাতাহাতিতে জড়িয়ে পড়েন মায়াবতীর দলের সাংসদের সঙ্গে। দু’টি দলই কেন্দ্রে সরকারের সমর্থক। কিন্তু ভোট-রাজনীতির স্বার্থেই সংরক্ষণের প্রশ্নে দু’টি দলের অবস্থান দুই মেরুতে। দু’দলের মরিয়া হাতাহাতির মূলে সেটাই। সংসদীয় মন্ত্রী পবন বনশল জানিয়েছেন, “কালও ফের বিলটি রাজ্যসভায় পাশ করানোর চেষ্টা করা হবে।” |
এমনিতেই এগারো দিন ধরে অচল হয়ে রয়েছে সংসদ। আজ ওই বিলটিকে কেন্দ্র করে সংসদের মর্যাদা ক্ষুণ্ণ হওয়ার অভিযোগ উঠল। প্রধানমন্ত্রীর উপস্থিতিতে সংসদীয় প্রতিমন্ত্রী ভি নারায়ণস্বামী আজ বিলটি রাজ্যসভায় পেশ করা মাত্রই সপা সাংসদরা ওয়েলে নেমে আসেন। পাল্টা বিক্ষোভ দেখান বিএসপি সাংসদরা। মায়াবতী উত্তরপ্রদেশে তাঁর শাসনকালে সরকারি কর্মীদের পদোন্নতিতে সংরক্ষণ কোটা চালু করেছিলেন। প্রথমে দু’পক্ষের মধ্যে উত্তপ্ত বাক্য বিনিময় পরে ধাক্কাধাক্কি ও হাতাহাতিতে জড়িয়ে পড়েন সপা-র নরেশ অগ্রবাল এবং বিএসপি-র অবতার সিংহ করিমপুরিকে। অন্য সাংসদরা এসে অনেক কষ্টে যুযুধান দুই সাংসদকে সরিয়ে দেন। মুলতুবি হয়ে যায় রাজ্যসভা। সংসদ ও দেশের বিভিন্ন বিধানসভায় হই-হট্টগোল, বিশৃঙ্খল পরিস্থিতি তৈরি হয়েছে অনেক বারই। জম্মু-কাশ্মীর বিধানসভায় ২০১০-এ জখম হয়েছিলেন ৪ জন বিধায়ক। সংসদেও কাগজ ছেঁড়া ও ছোড়ার ঘটনা ঘটেছে অনেক বার। ২০০৯-এ এই রাজ্যসভাতেই লিবারহান কমিশনের রিপোর্ট পেশের সময় বিজেপি ‘জয় শ্রীরাম’ স্লোগান তুলেছিল। সপা-র তৎকালীন সাংসদ অমর সিংহ তাদের থামাতে ঠেলা দিয়েছিলেন বিজেপি-র এসএস অহলুওয়ালিয়াকে। এর জবাবে অহলুওয়ালিয়া সজোরে ধাক্কা দেন অমরকে। এ বার আর ধাক্কাধাক্কি নয়, রাজ্যসভা সাক্ষী হল হাতাহাতিরও।
সরকারি চাকরিতে এই সংরক্ষণ চালুর বিষয়ে গত কালই সিদ্ধান্ত নিয়েছিল কেন্দ্রীয় মন্ত্রিসভা। এই সংবিধান সংশোধনী বিল পাশ করাতে হলে বিজেপি-র সমর্থন প্রয়োজন হবে কংগ্রেসের। বিজেপি বিলটিকে সমর্থন করবে বলে প্রকাশ্যে জানালেও দোটানায় রয়েছেন দলের নেতারা। ফলে বিলটি পাশ না হওয়ায় আপাতত স্বস্তিতেই বিজেপি। দলে মতপার্থক্যের প্রসঙ্গ এড়িয়ে আজ কংগ্রেসের বিরুদ্ধে আক্রমণ যাওয়ার রাস্তা নেয় তারা। দলের তরফে অভিযোগ তোলা হয়, সর্বদলীয় বৈঠকে বিলটি নিয়ে কোনও আলোচনা হয়নি। কয়লা কেলেঙ্কারি থেকে নজর ঘোরাতেই তাড়াহুড়ো করে বিলটি এনেছে সরকার। এই অভিযোগ উড়িয়ে কেন্দ্রীয় গ্রামোন্নয়ন মন্ত্রী জয়রাম রমেশ পাল্টা অভিযোগ করেন, “সপা যে বিরোধিতা করবে, তা আগেই জানিয়েছিল। কিন্তু বিজেপি এখন যা মনোভাব নিচ্ছে তা যথেষ্ট নেতিবাচক।”
বস্তুত বিলটি নিয়ে গোড়া থেকেই দ্বিধায় রয়েছে বিজেপি শিবির। দলের মুখপাত্র রবিশঙ্কর প্রসাদ বিলটি নিয়ে ‘দলের মনোভাব ইতিবাচক’ বলে দাবি করলেও, চাকরিতে সংরক্ষণের প্রশ্নে দলের নেতাদের অনেকেরই তীব্র আপত্তি রয়েছে। তাঁদের মতে, এই বিল পাশ হলে উচ্চ বর্ণের ভোটারদের কাছে ভুল বার্তা যাবে। কিন্তু পাল্টা যুক্তি হিসেবে গোপীনাথ মুন্ডের মতো অনগ্রসর শ্রেণির নেতাদের বক্তব্য, দীর্ঘ দিন ধরেই বিজেপি নেতৃত্বের রাশ উচ্চ বর্ণের হিন্দুদের হাতেই। নব্বইয়ের দশকের শেষে দলিত নেতা বঙ্গারু লক্ষ্মণকে দলের সভাপতি করে সামাজিক শ্রেণিবিন্যাসে তথাকথিত নিম্ন বর্ণের ভোটারদের কাছে বার্তা দেওয়ার একটি চেষ্টা করেছিল বিজেপি। কিন্তু তার পর থেকে প্রায় এক দশক কেটে গিয়েছে। দলের শীর্ষে এখনও সুষমা স্বরাজ, অরুণ জেটলি, নিতিন গডকড়ী, মুরলিমনোহর জোশীর মতো ব্রাহ্মণ বা রাজনাথ সিংহের মতো রাজপুত নেতাদের হাতেই। তাই বিলটিকে সমর্থন করলে দলিত ও পিছিয়ে পড়া শ্রেণির ভোটব্যাঙ্ককে টানা যাবে বলে মনে করছেন দলের একাংশ। তা ছাড়া মায়াবতী প্রথম থেকেই এই বিলটির সমর্থনে রয়েছেন। ২০১৪-র ভোটের পর সরকার গড়ার মতো পরিস্থিতিতে মায়াবতীর সাহায্য প্রয়োজন হতে পারে বিজেপি-র। দলের এক নেতার কথায়, “ধর্মনিরপেক্ষতার প্রশ্নে মুলায়ম কখনওই বিজেপি-র সঙ্গে হাত মেলাবেন না। কিন্তু অতীতে মায়াবতী-বিজেপি একসঙ্গে উত্তরপ্রদেশে সরকার চালিয়েছে।” তাই দলের একাংশ এখনই প্রকাশ্যে বিলটির বিরোধিতা করে মায়াবতীকে চটাতে চাইছে না। |