ঋণদানকারী সংস্থা হিসাবে ঝকঝকে একটি ওয়েবসাইট রয়েছে। রয়েছে যোগাযোগের নম্বর। ঋণ সংক্রান্ত যে সমস্ত প্রশ্ন কোনও গ্রাহক করে থাকেন, সেগুলির উত্তরও দেওয়া রয়েছে ওয়েবসাইটে। অভিযোগ, এই সব মোড়কের আড়ালেই চলছে প্রতারণার ব্যবসা।
হেমন্ত রাও বুরাদা নামে বছর পঁয়ত্রিশের সেই ‘প্রতারককে’ ফাঁদ পেতে ধরে ফেলেছেন বাঁকুড়া ও উত্তর ২৪ পরগনার ঘোলার দুই যুবক। তাঁদের এক জন ইতিমধ্যেই হেমন্তের হাতে প্রতারিত। অন্য জন প্রতারিত হওয়ার হাত থেকে বাঁচলেন। গ্রাহক পরিষেবা সংক্রান্ত একটি ওয়েবসাইটে পারস্পরিক তথ্য আদানপ্রদানের মাধ্যমেই ফাঁস হয়েছে এই প্রতারণার কীর্তি। হায়দরাবাদের সেক্টর ২ থানার ভুদা কলোনির বাসিন্দা হেমন্ত ওই ঋণদানকারী সংস্থার কর্মী হিসাবে নিজেকে পরিচয় দিতেন।
শনিবার খড়দহ থানার পুলিশ তাকে আটক করে। মঙ্গলবার জালিয়াতির অভিযোগে বাঁকুড়া সদর থানার পুলিশ খড়দহ গিয়ে তাঁকে ধরে আনে। উদ্ধার করা হয় ওই ‘ফিনান্স কোম্পানি’র নামে তাঁর দু’টি জাল পরিচয়পত্রও। কখনও এম বিজয় কুমার, কখনও বা এম সন্তোষ
কুমার নামে তিনি সম্ভাব্য ঋণগ্রহীতাদের প্রতারণা করতেন বলে পুলিশের দাবি। এ দিন বাঁকুড়া জেলা আদালত ধৃতকে ৭ দিন পুলিশ হেফাজতে রাখার নির্দেশ দেয়। বাঁকুড়ার পুলিশ সুপার মুকেশ কুমার বলেন, “হায়দরাবাদের ওই যুবক উচ্চশিক্ষিত। হিন্দি, ইংরেজিতে দখল রয়েছে। তাঁকে জিজ্ঞাসাবাদের পাশাপাশি অন্য কোথাও তাঁর বিরুদ্ধে প্রতারণার অভিযোগ রয়েছে কি না, তা খোঁজ করা হচ্ছে।” পুলিশ জানিয়েছে, ধৃত হেমন্ত নিজেকে ‘জি ফিনান্স ইন্ডিয়া’ নামে একটি ঋণদানকারী সংস্থার কর্মী বলে দাবি করেছে। তাঁর দু’টি পরিচয়পত্রও ওই সংস্থার
নামেই রয়েছে। পুলিশের দাবি, জেরায় হেমন্ত তাদের কাছে কবুল করেছে, ওই ওয়েবসাইট তারই মস্তিষ্কপ্রসূত। |
ধৃত প্রতারক হেমন্ত রাও বুরাদা। |
কী ভাবে ধরা পড়ল প্রতারণা? বাঁকুড়া শহরের দশেরবাঁধ এলাকার বাসিন্দা, বিস্কুটের ডিস্ট্রিবিউটর সুজয়কুমার দে সম্প্রতি ইন্টারনেটে ‘জি ফিনান্স ইন্ডিয়া’-র তরফে ঋণ দেওয়া সংক্রান্ত বিজ্ঞাপন দেখতে পান। সুজয় ওই সংস্থার ওয়েবসাইটে ২৫ লক্ষ টাকা ঋণের আবেদন করেন। কিছু দিন পর সংস্থা থেকে সন্তোষ কুমার নামে এক জন তাঁকে জানান, শীঘ্রই এক কর্মী তাঁর সঙ্গে যোগাযোগ করবেন। ২০ অগস্ট এম বিজয় কুমার (আদতে হেমন্ত) নামে এক জন বাঁকুড়ায় এসে সুজয়কে জানান, তাঁদের সংস্থা ১৫ লক্ষ টাকা ঋণ দেওয়ার ব্যবস্থা করবে। তবে, তার আগে ঋণের ৫.২% এবং আরও ৭ হাজার টাকা কোম্পানির ব্যাঙ্ক অ্যাকাউন্টে জমা করতে হবে। তার ১২ ঘণ্টার মধ্যেই সুজয়ের ব্যাঙ্ক অ্যাকাউন্টে ঋণের টাকা জমা পড়ে যাবে।
সুজয়ের দাবি, “আমি প্রায় ৮৫ হাজার টাকা জমা করি। কিন্তু, আমার অ্যাকাউন্টে ঋণের টাকা জমা করা হয়নি। বিজয় নামে ওই যুবক বাঁকুড়ার যে হোটেলে উঠেছিল, সেখানে গিয়ে দেখি পাখি উড়ে গিয়েছে।”
এই ঘটনা থেকে ‘শিক্ষা’ নিয়ে আর যাতে কেউ ওই ‘ভুয়ো’ সংস্থার জালে পা না দেন, সে জন্য নিজের অভিজ্ঞতার কথা সুজয় ‘পোস্ট’ করেন ‘গ্রাহকসেবা ডট কম’ নামের একটি ওয়েবসাইটে। ঘটনাচক্রে ঘোলা থানার মহানগর এলাকার কম্পিউটার ব্যবসায়ী স্বর্ণকমল খামরুইও ওই সংস্থার কাছে ঋণ নেওয়ার আবেদন করেছিলেন। তাঁর কাছেও এম সন্তোষ কুমার নামে এক জনের আসার কথা ছিল। স্বর্ণকমল বলেন, “আগে এমন কিছু সংস্থার কাছে প্রতারিত হয়েছিলাম। তাই ওই লোকটির সঙ্গে দেখা করার আগে নিছক কৌতূহলেই গ্রাহকসেবা ডট কমে ওই কোম্পানির নামে কোনও অভিযোগ রয়েছে কি না খোঁজ নিই। সেখানে সুজয়ের পোস্ট করা অভিযোগ দেখি। ওঁর সঙ্গে ফোনে কথা বলতেই প্রতারণার ছক পরিষ্কার হয়ে যায়।” |
এর পরেই সুজয় ও স্বর্ণকমল হেমন্ত ওরফে সন্তোষকে ফাঁদে ফেলার ফন্দি আঁটেন। শনিবার স্বর্ণকমল তাঁকে নিজের বাড়িতে ডাকেন। আগে থেকেই সেখানে লুকিয়ে ছিলেন সুজয় ও আরও কয়েক জন যুবক। সন্তোষের পরিচয়ে আসা হেমন্তকে দেখেই সুজয় চিনে ফেলেন। সঙ্গে সঙ্গে সবাই তাঁকে পাকড়াও করেন। হেমন্ত এ বার উঠেছিলেন সোদপুরের একটি হোটেলে। খবর পেয়ে পুলিশ তাঁকে আটক করে। বাঁকুড়ায় ফিরে সোমবার সুজয় হেমন্তের বিরুদ্ধে প্রতারণার অভিযোগ দায়ের করেন। ওই সংস্থার ওয়েবসাইট থেকে পাওয়া যোগাযোগের দু’টি মোবাইল নম্বরে এ দিন বারবার ফোন করা হলেও সেগুলি বন্ধ ছিল।
এ রাজ্যের ক্রেতাসুরক্ষা দফতরের এক আধিকারিকের কথায়, “লাগাতার প্রচারের ফলে সাধারণ মানুষ যে সচেতন হচ্ছেন, এই ঘটনা তারই নিদর্শন।” তিনি জানান, প্রায় প্রতিটি জেলাতেই নানা ভাবে প্রতারিত হচ্ছেন অনেকে। কিন্তু, কোথায় প্রতিকার মিলবে, তা তাঁদের জানা ছিল না। এখন সরকারের পাশাপাশি বেসরকারি উদ্যোগেও গ্রাহক-সচেতনতা বাড়ানোর কাজ চলছে। ‘গ্রাহকসেবা ডট কম’ তেমনই একটি উদ্যোগ।
আর ঠেকে শিখে সুজয়, স্বর্ণকমল বলছেন, “ইন্টারনেটে যেমন প্রতারিত হওয়ার সম্ভাবনা থাকে, তেমনই প্রতারককে ধরার সুযোগও আছে সেখানে। দরকার শুধু সতর্ক থাকা।”
|