হাইস্কুলে ভর্তি করে দেওয়া হলেও ‘দাদা’র লেখাপড়ায় মন ছিল না। একটু থমকালেন বুঝি সৈয়দ খালেদ নৌমান। সদ্য প্রয়াত দাদার কথা মনে পড়ে গেল হয়তো। ধীরে ধীরে যোগ করলেন, “জানেন...রাখালদের সঙ্গে হিজলবিলে ঘুরে বেড়ানোর দিকে দাদার প্রগাঢ় টান ছিল।”
তাঁর একান্ত মুর্শিদাবাদ, চেনা খোশবাসপুরের সেই অনন্ত মাঠ, পানাকচুতে সবুজ ডোবা, নীলকণ্ঠের উচ্ছল ওড়াউড়িসব ছেড়ে হারিয়ে যাওয়া ‘অলীক মানুষ’টির কথা, সারাটা দিন মেঘ-বৃষ্টির মতো ভারী হয়ে থাকল এ দিন। কখনও স্বজনের কথায়। কখনও বা বন্ধুদের স্মৃতিতে। |
নৌমান বলছেন, “সেই সময়ে সিপিআই নেতা আব্দুর রহমান ফেরদৌসি থাকতেন বর্ধমানে। লেখাপড়ার বদলে রাখালদের সঙ্গে বোহেমিয়ান জীবনযাপন করায় দাদাকে নিয়ে বাবা চলে গেলেন বর্ধমানে। সেখানের কালনার জৌ গ্রামের কাছে নবগ্রামের স্কুল থেকে দাদা ম্যাট্রিক পাশ করলেন।”
কিন্তু সিরাজকে কী আর স্কুলে বেঁধে রাখা যায়! স্কুল পর্ব শেষে বহরমপুর কৃষ্ণনাথ কলেজ। কিন্তু প্রথাগত শিক্ষায় মন বসে না যে। মাঝপথেই তাই থমকে যায় কলেজের পাঠ। এ বার খাদ্য দফতরে চাকরি। ঠিকানা মেদিনীপুর। নৌমান বলেন, “দু-তিন বছর চাকরিটা করেছিলেন বোধহয় দাদা। তারপর আবার সেই সবুজ হয়ে থাকা গ্রামেই ফিরে এলেন। প্রাইভেটেই পরে পাশ করেছিলেন আইএ এবং বিএ।” এই সময়েই আলকাপ দলের সঙ্গে জড়িয়ে পড়েন সিরাজ। জীবন বাঁক নিল এখান থেকেই। |
খোসবাসপুর থেকে মাইল দু’য়েক দূরে সাওতাপাড়া গ্রাম। সেখানেই ছিল আলকাপের দল। দলে নাম লেখালেন তিনি। অচিরেই হয়ে উঠলেন পাক্কা ওস্তাদ। ‘ছোকরা’ ছিলেন সুধীর দাস, ‘কোপে’ আনিস। দলের খ্যাতি ছড়াল জেলা উজিয়ে পড়শি জেলায়। নৌমান বলেন, “এরপর দাদা নিজেই আলকাপের একটি দল তৈরি করেন। সেই দল নিয়ে তিনি রাজ্যের বিভিন্ন জেলা তো বটেই, রাজ্যের বাইরেও গিয়েছেন।” ১৯৫০ সাল থেকে বছর সাতেক টানা আলকাপই ছিল তাঁর প্রাণ।
অলীক মানুষের অন্য প্রেম ছিল যাত্রা। সেই সময়ে গোকর্ণে ছিল নাটক-যাত্রার একটি দল। ম্যানেজারের মৃত্যুতে সেই দলটিই উঠে যেতে বসেছিল। সেই দলের সঙ্গে যুক্ত ছিলেন সিরাজের চেয়ে বছর চারেকের বড় গোকর্ণের কিরীটীভূষণ দত্ত। তাঁর এখনও মনে আছে, “দলের দায়িত্ব কাঁধে তুলে নিল সিরাজ। সুরকার, ম্যানেজার, অভিনয় শিক্ষক, পরিচালকসবই সিরাজ। কলকাতা চলে যাওয়ার আগে পর্যন্ত নাটক ও যাত্রাদলটির দায়িত্ব তিনিই সামলেছেন। সেই সময় আমরা একটি হাতেলেখা দেওয়াল প্রত্রিকা প্রকাশ করতাম। নাম অঙ্কুর। তার লেখা, অলঙ্করণ, ও ছবি সবই করত সিরাজ।”
১৯৬৪ সালে তিনি কলকাতায় চলে যান। তাঁর প্রথম গল্প ‘কাঁচি’ প্রকাশিত হয় মুর্শিদাবাদ জেলা শিক্ষিক সমিতির মুখপত্র ‘সুপ্রভাত’ পত্রিকায়। তারপর পরিচয়, নতুন সাহিত্য, বিংশ শতাব্দী, ছোটগল্প নামের পত্রিকায় তাঁর গল্প প্রকাশিত হতে থাকে। ক্রমে খোলস থেকে বেরিয়ে আসেন অপ্রকাশিত সিরাজ। সারাটা দিন এই মেঘ-মেঘ দুপুরে হিজলবনের বর্ষাস্নাত পাতার মতো ভারি হয়ে থাকল সিরাজ-কথায়। |
আজ, সকালে কলকাতা থেকে ফিরে আসছেন তিনি। পাকাপাকি ভাবে, খোশবাসপুরে। সেই মাঠ, জলা, সবুজ মুথা ঘাসের আড়ালেই থেকে যাবেন, অনন্ত, ‘অলীক’ হয়ে।
|