|
|
|
|
কেনা হল ‘উন্নত’ এলাইজা কিট |
|
ডেঙ্গি নির্ণয়ে এনএস-ওয়ান
পরীক্ষাকেই ঘুরিয়ে স্বীকৃতি
নিজস্ব সংবাদদাতা • কলকাতা |
|
ডেঙ্গি নির্ণয়ে যে পরীক্ষাকে এত দিন ব্রাত্য করে রেখেছিল রাজ্যের স্বাস্থ্য দফতর, পরিস্থিতির চাপে পরে তাকেই এখন স্বীকৃতি দিতে হচ্ছে।
পরীক্ষাটির নাম ‘এনএস-ওয়ান’ (ননস্ট্রাকচারাল প্রোটিন-ওয়ান)। স্বাস্থ্য প্রতিমন্ত্রী থেকে শুরু করে শীর্ষকর্তা, প্রত্যেকেই ঘোষণা করেছিলেন, এই পরীক্ষায় ‘পজিটিভ’ হলেও ডেঙ্গি হয়েছে বলে মানবে না সরকার। সেই পরীক্ষাকে স্বীকৃতি দিতে গিয়ে মুখ বাঁচাতে তাঁরা এখন যুক্তি দিচ্ছেন, আগের ‘এনএস-ওয়ান’ পরীক্ষার থেকে উন্নততর প্রক্রিয়ায় এ বার ‘এনএস-ওয়ান এলাইজা’ পরীক্ষা করা হবে। এতে দু’দিনের মধ্যেই ডেঙ্গি হয়েছে কিনা তা নিশ্চিত ভাবে জানা যাবে।
স্বাস্থ্য প্রতিমন্ত্রী চন্দ্রিমা ভট্টাচার্য জানান, ভারত সরকারের অনুমতি নিয়ে ‘ন্যাশনাল ইনস্টিটিউট অফ কলেরা অ্যান্ড এন্টেরিক ডিজিজেস’ বা নাইসেডের মাধ্যমে প্রথম দফায় ৫ লক্ষ টাকার ‘এনএস-ওয়ান এলাইজা কিট’ কিনেছে রাজ্য। পরে আরও কেনা হবে। বুধবার থেকে রাজ্যের সব জায়গায় সরকারি ক্ষেত্রে এই কিট দিয়ে ডেঙ্গি পরীক্ষা শুরু হবে বলে জানিয়েছেন স্বাস্থ্য-অধিকর্তা বিশ্বরঞ্জন শতপথী। এর ফলে রক্তে ডেঙ্গি জীবাণু আছে কি না, তা জানতে জ্বর হওয়ার পাঁচ দিন পরে রক্ত পরীক্ষা করার জন্য অপেক্ষা করতে হবে না বলে স্বাস্থ্য দফতরের কর্তারা জানাচ্ছেন। ফলে চিকিৎসা আরও দ্রুত ও যথাযথ হবে বলে তিনি জানান। এবং এই যুক্তিতেই ‘এনএস-ওয়ান’ পদ্ধতির উপরে আস্থাশীল বেসরকারি হাসপাতালের সঙ্গে যুক্ত চিকিৎসকরা।
তবে কি বিভিন্ন বেসরকারি হাসপাতাল এবং ক্লিনিক যে পদ্ধতিতে ডেঙ্গি নির্ণয়ের পরীক্ষা চালাচ্ছিল (এনএস-ওয়ান) তাকে স্বীকৃতি দিচ্ছে রাজ্য? স্বাস্থ্য দফতরের মুখপাত্র অসিত বিশ্বাস কিন্তু বললেন, “বিভিন্ন বেসরকারি ক্লিনিক এবং হাসপাতাল ‘র্যাপিড কিট’-এর সাহায্যে ‘এনএস-ওয়ান’ পরিমাপ করছে। যার থেকে এলাইজা পদ্ধতি অনেক বেশি সংবেদনশীল এবং নির্ভরযোগ্য। আমরা র্যপিড কিটে এনএস-ওয়ান পরিমাপ গ্রাহ্য করি না।” বেসরকারি হাসপাতালের সঙ্গে যুক্ত চিকিৎসকদের পাল্টা দাবি, ড্রাগ কন্ট্রোলই ‘র্যাপিড কিট’ বাজারে ছাড়ার অনুমতি দিয়েছে। রাজ্য সরকার তবে তার ব্যবহার বন্ধ করে দিক। সেই ক্ষমতা যে তাদের নেই, সে কথা অবশ্য কবুল করেছেন স্বাস্থ্য দফতরের কর্তারা।
মহাকরণে এ দিন ডেঙ্গি নিয়ে বৈঠক হয়। সন্ধ্যায় মহাকরণ ছেড়ে যাওয়ার সময়ে মুখ্যমন্ত্রী মমতা বন্দ্যোপাধ্যায়কে সে বিষয়ে জিজ্ঞাসা করা হলে তিনি বলেন, “আমার কাছে যা রিপোর্ট এসেছে সেই অনুযায়ী এ পর্যন্ত সারা রাজ্যে ৩ জনের মৃত্যু হয়েছে ডেঙ্গিতে। বাকিটা প্রচার করা হচ্ছে।” স্বাস্থ্য দফতরের হিসেবে সোমবার গোটা রাজ্যে নতুন করে ১৭ জনের দেহে নিশ্চিত ভাবে ডেঙ্গি পাওয়া গিয়েছে। কলকাতায় নতুন করে ডেঙ্গি মিলেছে ৮ জনের দেহে। সরকারি হিসেবে এ পর্যন্ত মৃত্যু হয়েছে ৩ জনের। প্রত্যেকেই কলকাতার। তবে বেসরকারি হিসেবে মৃতের সংখ্যা ৭। বাকি ৪ জনের এনএস-ওয়ান পরীক্ষা পজিটিভ হয়েছিল। তাই স্বাস্থ্য দফতর একে ডেঙ্গি বলে মানতে চায়নি।
বেসরকারি হাসপাতালের সঙ্গে যুক্ত চিকিৎসকেরা প্রশ্ন তুলেছেন, এ বার সরকারি হাসপাতালে এলাইজা কিট দিয়ে ‘এনএস-ওয়ান’ পরীক্ষায় ‘পজিটিভ’ পাওয়া কোনও রোগীর মৃত্যু হলে তাকে ডেঙ্গিতে মৃত্যু বলা হবে কি না। কারণ, র্যপিড কিট দিয়ে বেসরকারি ক্লিনিক এবং হাসপাতাল যাঁদের ‘এনএস-ওয়ান পজিটিভ’ পেয়েছেন তাঁদের অনেকেরই পরবর্তীকালে জটিল ডেঙ্গি হয়েছে। কেন রাজ্য সরকার এত দিন ‘এনএস-ওয়ান’ পরীক্ষাকে ব্রাত্য করে রেখেছে, সেই প্রশ্নও তুলেছেন ওই সব চিকিৎসক। তাঁদের বক্তব্য, রাজ্য সরকার বিষয়টি নিয়ে আগে সিদ্ধান্ত নিলে মানুষের মধ্যে এমন বিভ্রান্তি ছড়াত না। ‘এনএস-ওয়ান পজিটিভ’ অনেক রোগীরই চিকিৎসা অনেক আগে শুরু করা যেত। পরিস্থিতি এতটা জটিল হত না। তবে রাজ্য স্বাস্থ্য দফতরের যুক্তি, তারা ঠিক সময়েই ঠিক সিদ্ধান্ত নিয়েছে।
স্বাস্থ্য দফতরের নির্দেশে কলকাতা পুরসভার ক্লিনিকগুলিতেও এ বার ‘এনএস-ওয়ান’ পরিমাপের যন্ত্র ব্যবহার করা হবে বলে মুখ্য স্বাস্থ্য আধিকারিক তপন মুখোপাধ্যায় জানিয়েছেন। তিনি বলেন, “ন্যাশনাল ভেক্টর বোর্ন ডিজিজ কন্ট্রোল প্রোগ্রাম থেকে বলা হয়েছে এলাইজা পদ্ধতিতে কিটের সাহায্যে রক্তের অ্যান্টিজেন পরীক্ষা করতে। আমরা সেই নিয়ম অনুসরণ করতে বলেছি।”
রোগ নিয়ন্ত্রণের কাজ হোক বা না হোক, ডেঙ্গি নিয়ে রাজনৈতিক তরজা কিন্তু চলছেই। রাজ্যের নগরোন্নয়নমন্ত্রী ফিরহাদ হাকিম এ দিন বলেন, “বিরোধীরা ডেঙ্গি নিয়ে আতঙ্ক ছড়াচ্ছে। আসলে এই সময়ে ডেঙ্গি, জ্বর, ম্যালেরিয়া, টাইফয়েড এবং পেটের রোগ হয়। হাসপাতালে যাঁরা ভর্তি হচ্ছেন, তাঁদের সকলেরই ডেঙ্গি নয়।” তাঁর পরামর্শ, “জ্বর হলেই রক্ত পরীক্ষা করান এবং ‘ড্রিপ’ দেওয়া চালু করুন।” তাঁর দাবি, “প্রাকৃতিক পরিবর্তনের কারণে তিন-চার বছর অন্তর এমন হয়। এ বার বৃষ্টি কম হওয়ায় জমা জলে মশার লার্ভা হচ্ছে দ্রুত। তার থেকেই ডেঙ্গি হচ্ছে।” ফিরহাদ বলেন, ‘‘আমার মেয়েরও ডেঙ্গি হয়েছিল। তিন দিন হাসপাতালে ভর্তি ছিল সে।”
ডেঙ্গি উদ্বেগের কারণ হয়ে উঠলেও তা নিয়ে তাঁরা ‘রাজনীতি’ চান না বলে মন্তব্য করেছেন বিরোধী দলনেতা সূর্যকান্ত মিশ্র। তিনি বলেন, “ডেঙ্গি নিয়ে রাজনীতি করতে আমরা কেউ চাই না। সবাইকে এক হয়ে এর বিরুদ্ধে লড়তে হবে। মশা রাজনীতির রং দেখে কামড়ায় না! সরকার, পুরসভা-সহ সংশ্লিষ্ট সব পক্ষ মিলে কাজ করতে হবে।” রাজ্য সরকার প্রতিদিন মানুষকে ঠিক তথ্য জানালে ডেঙ্গি নিয়ে আতঙ্ক ছড়ানো বন্ধ হবে বলেও প্রাক্তন স্বাস্থ্যমন্ত্রীর অভিমত। সূর্যবাবুর বক্তব্য, তাঁরা সরকারে থাকার সময়ে ডেঙ্গির সমস্যা দেখা দিলে সরকারি ও বেসরকারি হাসপাতালের মধ্যে সমন্বয় রেখে রোজ তথ্য জানানো হত।
ডেঙ্গি নিয়ে সরকারি ও বেসরকারি তথ্যের বিস্তর ফারাক দেখা যাচ্ছে বলে অভিযোগ করে সূর্যকান্তর মন্তব্য, “তথ্য দিতে কোথায় অসুবিধা হচ্ছে জানি না! মহাকরণের শুধু জেলায় জেলায় ঘুরতে গেলে হবে না! যেখানে যেখানে সর্বোচ্চ স্তরের সমন্বয় দরকার, সেটা করতে হবে।” রাজ্যের প্রাক্তন মন্ত্রী সিপিএমের বিধায়ক আনিসুর রহমান বলেন, “মঙ্গলবার এ ব্যাপারে কথা বলতে স্বাস্থ্য-প্রতিমন্ত্রীর কাছে যাব। রোগ নিয়ন্ত্রণে সরকারকে আরও সতর্ক হতে বলব।” |
|
|
|
|
|