কয়লা কেলেঙ্কারি লইয়া সংসদে বিরোধী পক্ষের প্রতিবাদ ও বিক্ষোভ অব্যাহত। তাহার জেরে লোকসভা ও রাজ্যসভা, উভয় কক্ষের অধিবেশন ভণ্ডুল হওয়ার ধারাবাহিকতাও। বস্তুত, পরিস্থিতি যে দিকে গড়াইতেছে, সংসদের বর্ষাকালীন অধিবেশন কার্যত কোনও কাজ না করিয়াই শেষ হইয়া যাইবে। জরুরি বহু বিল পেশ হইবে না, কোনও ক্রমে পেশ হইলেও তাহা লইয়া সংসদে কোনও আলোচনা হইবে না। জনপ্রতিনিধিরা কেবল কয়লা কেলেঙ্কারি ও তাহার পরিণাম এবং দায়ভাগ লইয়াই ঝগড়াঝাটি করিতে থাকিবেন। প্রধান বিরোধী দল বি জে পি প্রধানমন্ত্রী মনমোহন সিংহের ইস্তফার দাবিতে অবিচল, আর শাসক কংগ্রেস তথা ইউ পি এ-র পক্ষেও এই দাবি মানিয়া লওয়া সম্ভব নয়। তাই অচলাবস্থার অবসানের কোনও সম্ভাবনাই দেখা যাইতেছে না।
শাসক দলের নেতৃত্ব যদি অধিবেশন শুরুর আগেই কেলেঙ্কারির অভিযোগ সংক্রান্ত সি এ জি-র রিপোর্ট লইয়া বিরোধী পক্ষের সহিত আলোচনায় বসিতেন, তবে ক্রমাগত অধিবেশন বানচাল হওয়া এড়ানো যাইত। প্রায় দিন দশেক সংসদ সম্পূর্ণ অচল থাকিবার পর শাসক দলের টনক নড়ে এবং দলনেত্রী সনিয়া গাঁধী লোকসভার বিরোধী নেত্রী সুষমা স্বরাজকে বৈঠকে ডাকেন। তত দিনে অনেক বিলম্ব হইয়া গিয়াছে। শাসক পক্ষ ভাবিয়াছিলেন, প্রধানমন্ত্রীর বিবৃতি জারি করিয়াই বিরোধী পক্ষের বিক্ষোভ প্রশমিত করা যাইবে। কিন্তু তাহা ঘটে নাই। যদি বিরোধী পক্ষের সহিত আলোচনা, শলাপরামর্শ চালাইবার অভ্যাসটি আগে হইতেই চালু থাকিত, তবে এমন পারস্পরিক অনাস্থার আবহ রচিত হইত না। কিন্তু বিরোধী পক্ষের সহিত শাসননীতি লইয়া আগাম শলাপরামর্শ করার কোনও ঐতিহ্য কংগ্রেসে নাই। একা একাই যাবতীয় সিদ্ধান্ত লইয়া একতরফা ভাবে তাহা দেশবাসীর উপর চাপাইয়া দেওয়াই তাহার আবহমান কালের রাজনীতি। দলের বর্তমান নেতৃত্বও সেই বদ অভ্যাস বা কুপ্রথা হইতে বিন্দুমাত্র বিচ্যুত হন নাই। আর সংসদ ভণ্ডুলের উপর্যুপরি ঘটনায় তাহারই খেসারত দিতে হইতেছে। ইতিপূর্বে লোকপাল বিল লইয়াও বিরোধীদের সহিত একই ধরনের মতান্তর সভা ভণ্ডুল করিয়াছে। তাহার আগে কমনওয়েল্থ কেলেঙ্কারি, টু-জি স্পেক্ট্রাম কেলেঙ্কারি লইয়াও একের-পর-এক সংসদীয় অধিবেশন সম্পূর্ণ নিষ্ফলা অতিবাহিত হইয়াছে।
কংগ্রেস নেতৃত্বের তবু কাণ্ডজ্ঞান ফেরে নাই। কংগ্রেস আর জাতীয় রাজনীতিতে একমেবাদ্বিতীয়ম্ দল নয়, অন্য শরিক দলের সমর্থন লইয়া তাহাকে সংসদীয় গরিষ্ঠতা অর্জন করিতে, সরকার গড়িতে হয়, তখনও এমনকী শরিকদের অগ্রাহ্য করিয়াই দলীয় নেতৃত্ব বিভিন্ন সরকারি নীতি গ্রহণ করিয়া থাকেন। যেন সরকারটি একা কংগ্রেসের। ইউ পি এ-র বিভিন্ন শরিক এ কারণেই নানা সময়ে সরকারের সহিত অসহযোগিতাকে প্রায় পরিষদীয় সঙ্কটের স্তরে লইয়া যায়। শেষ পর্যন্ত বাবা-বাছা করিয়া শরিকদের গায়ে-মাথায় হাত বুলাইয়া তুষ্ট করিতে হয়। নিরুপায় শরিকদের অগ্রাহ্য করিলে তাহারা যদি বা অপ্রসন্ন চিত্তে তাহা মানিয়া লয়, বিরোধীদের ক্ষেত্রে উপেক্ষা করার মাশুল শাসক পক্ষকে গনিতেই হইবে। সুষমা স্বরাজ সনিয়া গাঁধীকে বলিয়াছিলেন, বেসরকারি সংস্থাকে মঞ্জুর করা কয়লা নিষ্কাশনের লাইসেন্স রদ করিয়া গোটা বিষয়টির তদন্ত করা হউক। এমন কিছু অসঙ্গত দাবি নয়। বস্তুত, ইউ পি এ-র সমর্থক মুলায়ম সিংহ যাদব এবং বামপন্থীরা, বিজু জনতা দল এবং তেলুগু দেশমও অনুরূপ দাবিই জানান। কংগ্রেস নেতৃত্ব সাড়া দেন নাই। একলা-চলার মনোভাব, একতরফা সিদ্ধান্ত গ্রহণের প্রবণতা, বিরোধী পক্ষকে গুরুত্ব না দেওয়া, এমনকী শরিকদেরও উপেক্ষা করার মানসিকতাই ইউ পি এ-র শাসনকালকে নিষ্ফল পরিষদীয় পর্বে পর্যবসিত করিতেছে। |