প্রকল্প ঘোষণার অন্ত নেই। কিন্তু রাজ্যের ভাঁড়ে তো মা ভবানী। তাই সরকারি-বেসরকারি যৌথ উদ্যোগের (পিপিপি) নীতি তৈরি করে লগ্নির খোঁজে নেমেছিল রাজ্য। কিন্তু ঋণগ্রস্ত সরকারের ডাকে সে ভাবে সাড়া মেলেনি। তাই যৌথ প্রকল্পের জন্য বেসরকারি সংস্থা ধরে আনতে বেসরকারি উপদেষ্টা সংস্থার সাহায্য নেওয়ার কথা ভাবা হয়। সেই মতো খোঁজও শুরু হয়। বেসরকারি লগ্নির হাল দেখে এই ব্যাপারে সংশয়েই ছিল অর্থ দফতর। কিন্তু বাস্তবে দেখা যাচ্ছে, ব্যাপক সাড়া মিলেছে তাতে। মমতা বন্দ্যোপাধ্যায় সরকারের জন্য পুঁজি ধরার ‘ঘটক’ হতে রাজি দেশি তো বটেই, বিদেশেরও একাধিক নামকরা সংস্থা। ভাবমূর্তির সমস্যা নিয়ে লড়াই চালিয়ে যাওয়া রাজ্যের কাছে এটুকুই আশাতীত বলে মনে করা হচ্ছে।
গত বুধবার, নির্দিষ্ট সময়সীমা পেরিয়ে যাওয়ার শেষ দিন আবেদনপত্র খুলে সরকার দেখে, দেশ-বিদেশের ১৫টি সংস্থা নতুন সরকারের আবেদন সাড়া দিয়ে ‘ঘটক’-এর কাজ করতে আগ্রহ প্রকাশ করেছে। এই তালিকায় রয়েছে ‘বিগ ফোর’ বলে পরিচিত প্রাইস ওয়াটার হাউস কুপার্স (পিডব্লুসি), কেপিএমজি, ডিলয়েট এবং আর্নস্ট অ্যান্ড ইয়ং। বিনিয়োগকারী ধরে আনতে ক্রিসিল, ফিডব্যাক ভেঞ্চার, অ্যাকসেনচার, রাইটস, আইডিএফসি-এর মতো পেশাদার সংস্থাও (ট্রানজ্যাকশন অ্যাডভাইসর) সাড়া দিয়েছে।
মহাকরণের খবর, আবেদনকারী ১৫টি সংস্থার মধ্যে ৯টিকে বেছে নেবে অর্থ দফতর। এই ৯টি সংস্থাই রাজ্যের হয়ে পিপিপি প্রকল্পে যাবতীয় বিনিয়োগ টানার দায়িত্ব নেবে। লগ্নি টানার ক্ষেত্রে ‘সাফল্য’ অনুযায়ী ওই সংস্থাগুলিকে ‘ভাতা’ দেবে অর্থ দফতর। ব্যর্থ হলে অবশ্য ওই ভাতা মিলবে না।
কেন এই সিদ্ধান্ত নিল রাজ্য, তার ব্যাখ্যা দিয়ে সরকারের এক শীর্ষকর্তা জানান, ‘পিপিপি মডেল’-এ বিনিয়োগ টানার ক্ষেত্রে এ পর্যন্ত সরকার বিশেষ সাফল্য পায়নি। গত কয়েক মাসে স্বাস্থ্য, পর্যটন, নগরোন্নয়ন, শিল্পের মতো বিভিন্ন দফতর পিপিপি মডেলে প্রকল্প গড়তে চেয়ে বিজ্ঞাপন দেওয়া হয়েছিল। তাতে কার্যত সাড়া মেলেইনি। তাঁর দাবি, দক্ষিণেশ্বরের কাছে হুগলি নদীর উপর নিবেদিতা সেতু ছাড়া সাম্প্রতিককালে পিপিপি মডেলে নতুন কোনও প্রকল্পের খবর নেই। এই অবস্থায় যৌথ উদ্যোগের প্রকল্পে বেসরকারি বিনিয়োগ টানার দায়িত্ব নিজের কাছে রাখতে চায় না রাজ্য সরকার। তাই অনেক ভেবেচিন্তে গৌরী সেন-দের ধরে আনতে পেশাদার সংস্থা নিয়োগের পরিকল্পনা করা হয়েছে। আর তাতেই মিলেছে অভূতপূর্ব সাড়া।
কোন কোন ক্ষেত্রে সরকার লগ্নি খুঁজছে? লগ্নির ভিত্তিই বা কী হবে? সরকারের নতুন নীতিতে পিপিপি-প্রকল্পের তালিকায় প্রায় সব গুরুত্বপূর্ণ ক্ষেত্রই রয়েছে। যেমন: স্বাস্থ্য-শিক্ষা-পর্যটন, রাস্তা-সেতু-বাইপাস, বিমানবন্দর-এয়ারস্ট্রিপ-হেলিকপ্টার, শিল্পপার্ক-থিমপার্ক-নলেজপার্ক-উপনগরী, শিল্প প্রশিক্ষণ কেন্দ্র, পানীয় জল সরবরাহ ও জলশোধন কেন্দ্র, বিদ্যুৎ উৎপাদন-সংবহন-বণ্টন, কঠিন বর্জ্য, পয়ঃপ্রণালী ও নিকাশি, অভ্যন্তরীণ জলপথ পরিবহণ, শহরের যান চলাচল ব্যবস্থা এবং আবাসন।
সরকার চায়, পরিবহণে আরও বেশি করে বেসরকারি সংস্থা আসুক। এমনকী লঞ্চ, ভুটভুটি চালানোর ক্ষেত্রেও বেসরকারি লগ্নি চায় সরকার। এ ছাড়া নিকাশি, বর্জ্য ব্যবস্থাপনা, পানীয় জল, পরিবহণ, রাস্তা নির্মাণ, পর্যটন, বিদ্যুৎ, টেলি যোগাযোগ এবং ই-গর্ভন্যান্স-এর জন্যও বেসরকারি বিনিয়োগকারীদের রাজ্যে নিয়ে আসার ভার নিক ওই ৯টি সংস্থা। ওই মুখপাত্র জানান, রাজ্যের কোথায় কী ধরনের প্রকল্প লাভজনক হতে পারে, সেই প্রকল্পে বিনিয়োগের টাকা কোথা থেকে আসবে তা দেখবে এই পেশাদার পরামর্শদাতা সংস্থাগুলি। পাশাপাশি, দেশ-বিদেশের বিভিন্ন সংস্থার কাছে থেকে কী ভাবে অনুদান আদায় করা যাবে, বিশ্ব ব্যাংক কিংবা এশিয়া উন্নয়ন ব্যাঙ্কের ঋণ পেতেও দায়িত্ব নিতে হবে তাদের।
তবে সরকার ঠিক করেছে, যৌথ উদ্যোগের প্রকল্পগুলিতে রাজ্যবাসীকে লেভি বা পরিষেবা কর দিতে হবে। এর হার কত হবে, তা ঠিক করবে পেশাদার সংস্থারাই। অর্থ দফতরের এক কর্তার কথায়, উন্নত পরিষেবা পেলে সামান্য কর দিতে অনীহা নেই মানুষের। কর্নাটক এর বড় উদাহরণ। তাঁর প্রশ্ন, “ওই রাজ্যে সামাজিক উন্নয়নের কাজে পিপিপি মডেল গতি পেলে এখানে তা হবে না কেন?”
গত বছরের মে মাসে দু’লক্ষ কোটি টাকারও বেশি ঋণের বোঝা মাথায় নিয়ে নতুন সরকার ক্ষমতায় এসেছে। বছরে আসল ও সুদ মিলিয়ে ২৫ হাজার কোটি টাকা পরিশোধ করতে হওয়ায় সরকারের সংসার চালাতে যে প্রথম থেকেই ত্রাহি ত্রাহি রব উঠেছে, তা বিভিন্ন সময়ে জানিয়েছেন মুখ্যমন্ত্রী ও অর্থমন্ত্রী। এই অবস্থায় কর্মীদের বেতন-পেনশন দেওয়া এবং দৈনন্দিন খরচের পরে পরিকাঠামো ও পরিষেবা উন্নয়নে অর্থ ব্যয় করা প্রায় অসম্ভব হয়ে দাঁড়িয়েছে। তাই সরকার গঠনের শুরু থেকেই মুখ্যমন্ত্রী ‘পিপিপি মডেলের’ কথা বলে আসছেন। সরকারকে ‘সহযোগীর’ ভূমিকায় রেখে পরিকাঠামো ও পরিষেবা উন্নয়নের প্রায় সব ক্ষেত্রেই বেসরকারি বিনিয়োগ চাইছেন মমতা। সেই লক্ষ্যেই আরও এক ধাপ এগোল রাজ্য। |