যাত্রী বা রেল ভ্রুক্ষেপ নেই কারও
প্রাণ হাতে লাইনে হাঁটার ব্যাধি বে-লাগাম
কাল ৯টা ৫০। ডাউন লেডিজ স্পেশ্যাল এসে থামল নৈহাটি স্টেশনে। এক দল স্কুলপড়ুয়া নামল ট্রেন থেকে। জনা কুড়ি হবে। পিছনে তাদের অবিভাবকেরা। চার নম্বর প্ল্যাটফর্মে একটু এগিয়েই স্কুলপড়ুয়া আর অভিভাবকেরা নেমে পড়লেন রেললাইনে। লাইন পেরিয়ে দলটি চলল গন্তব্যে।
ভাগ্যিস, নৈহাটির মতো ব্যস্ত স্টেশনের ওই লাইনে সেই সময় কোনও ট্রেন এসে পড়েনি!
হেঁটে লাইন পারাপার বা রেললাইন বরাবর হাঁটা নিষিদ্ধ। কিন্তু সেই নিষেধাজ্ঞাকে বুড়ো আঙুল দেখিয়ে নৈহাটির মতো অনেক স্টেশনেই যাত্রীরা লাইন পার হয়ে ট্রেন ধরতে যাচ্ছেন অহরহ। অনেক ক্ষেত্রে প্রাণ দিয়ে চূড়ান্ত মাসুলও গুনতে হচ্ছে হাতে হাতে। গত বৃহস্পতিবারেও লাইন পেরিয়ে শ্যামনগর স্টেশনের প্ল্যাটফর্মে উঠতে গিয়ে ট্রেনের ধাক্কায় মৃত্যু হয়েছে শুভশ্রী দাস নামে এক বালিকার। গুরুতর আহত হন তার মাসি। রেলের হিসেবে প্রতি বছর গোটা দেশে ট্রেনে কাটা পড়ে মৃতের সংখ্যা ১৫ হাজারেরও বেশি। কিন্তু তাতেও কারও ভ্রুক্ষেপ নেই। যাত্রিসাধারণ বা রেল, কারওই না।
রেলে যাত্রী সুরক্ষা এবং পরিকাঠামো উন্নয়নে অগ্রগতি দেখার জন্য তৈরি কাকোদকর কমিটিও এই সমস্যাকে গুরুত্ব দিয়ে দেখার পরামর্শ দিয়েছে তাদের রিপোর্টে। রেল-কর্তৃপক্ষের কাছে পেশ করা রিপোর্টে ওই কমিটি বলেছে, ‘দেশ জুড়ে যে-হারে মৃতের সংখ্যা (হেঁটে রেললাইন পেরোতে গিয়ে) বেড়েই চলেছে, তাতে বিষয়টি নিছক বেআইনি বলে বসে থাকলে চলবে না। প্রাণহানির বিষয়টিকে যথোচিত গুরুত্ব দিয়ে এটিকে সামাজিক সমস্যা হিসেবে দেখতে হবে। হেঁটে লাইন পেরোনোর প্রবণতা কী ভাবে রোধ করা যায়, সেটা খতিয়ে দেখতে হবে রেলকেই।’
নিত্যদিনের ছবি। নৈহাটি স্টেশনে। ছবি: সুদীপ আচার্য
হেঁটে রেললাইন পেরোনো ঠেকাতে রেলের তরফে বিভিন্ন স্টেশনে কী ব্যবস্থা নেওয়া হয়েছে?
রেলের বক্তব্য, বহু প্ল্যাটফর্মে ওভারব্রিজ বা সাবওয়ে গড়ে দেওয়া হয়েছে। মাইকে ঘোষণা চলছে। মাঝেমধ্যে দেওয়া হচ্ছে বিজ্ঞাপনও। কিন্তু লাইন পেরোতে গিয়ে কাটা পড়ে মৃত্যু রোধ করা যাচ্ছে না। কেন?
রেলকর্তারা স্বীকার করে নিচ্ছেন, যাত্রী-সংখ্যার তুলনায় ওই সব ব্যবস্থা সামান্য। আবার অনেক ক্ষেত্রে ব্যবস্থা থাকলেও সেটা এমন জায়গায় এবং এমন ভাবে আছে যে, যাত্রীরা তা ব্যবহার করার ঝক্কি নিতে চান না। যেমন বহু স্টেশনেই ওভারব্রিজ আছে একেবারে শেষ প্রান্তে। এমনিতে দূর, তার উপরে সেটা এতটাই উঁচু যে, বয়স্ক যাত্রীরা তাতে উঠতেই পারেন না। ফলে বাধ্য হয়েই যাত্রীদের লাইন পেরিয়ে যেতে হয়। আবার ১২ কামরার ট্রেন দাঁড় করানোর জন্য প্ল্যাটফর্ম বাড়ানো হয়েছে। ফলে অনেক স্টেশনে ঢোকা ও বেরোনোর রাস্তাই বন্ধ হয়ে গিয়েছে। যাত্রীরা লাইন পেরিয়ে প্ল্যাটফর্মে উঠতে বাধ্য হচ্ছেন। বনগাঁ শাখার অনেক স্টেশনেই এটা রোজকার ছবি।
কাকোদকর কমিটি তাদের রিপোর্টে বলেছে, শহরতলির ট্রেন ঘিঞ্জি এলাকা দিয়ে চলাচল করায় মুম্বই ও কলকাতায় ট্রেনে কাটা পড়ে মৃত্যুর হার বেশি। তবে মৃতের সংখ্যা সব চেয়ে বেশি মুম্বইয়ে। বছরে প্রায় ছ’হাজার। রেল পুলিশ সূত্রের খবর, রেলমন্ত্রী মুকুল রায়ের রাজ্যে, বিশেষত হাওড়া, শিয়ালদহ ও খড়্গপুর বিভাগে ট্রেনে কাটা পড়ে মৃতের সংখ্যা বছরে আড়াই হাজার ছাড়িয়ে যায়। শুধু শিয়ালদহ বিভাগেই প্রতিদিন গড়ে চার জন ট্রেনে কাটা পড়েন। রেললাইনে কাটা পড়ে মৃত্যু হলে মৃতের পরিবার কোনও ক্ষতিপূরণ পাবে না। রেলের আইনে মৃত ব্যক্তিকে ‘ট্রেসপাসার’ বা আইন ভেঙে লাইনে উঠে পড়া বহিরাগত হিসেবে গণ্য করা হয়। তাই সেটাকে শুধু অস্বাভাবিক মৃত্যুর ঘটনা বলে নথিভুক্তি করবে রেল পুলিশ। তার বেশি কিছু নয়।
হুটহাট লাইনে নেমে পড়া আটকাতে রেলকে কিছু পরামর্শ দিয়েছে কাকোদকর কমিটি। তার মধ্যে আছে:
• ঘিঞ্জি এলাকায় রেললাইনের পাশ থেকে দখলদার সরানো জরুরি। প্রয়োজনে রাজনৈতিক দলগুলির সঙ্গে কথা বলে রেললাইনের ধার ঘেঁষে গড়ে ওঠা বসতি সরিয়ে দিতে হবে।
• হেঁটে লাইন পারাপার আটকাতে লাগাতে হবে স্থায়ী লোহার বেড়া।
• প্ল্যাটফর্মে বেশি সংখ্যায় সাবওয়ে তৈরি করা দরকার।
• যাত্রীদের সচেতন করতে আরও বেশি ঘোষণার ব্যবস্থা চাই।
• প্রহরাবিহীন লেভেল ক্রসিংয়ে প্রহরীর ব্যবস্থা করতে হবে। এতেই কমবে দুর্ঘটনা।
রেল বোর্ডের প্রাক্তন সদস্য সুভাষরঞ্জন ঠাকুর বলেছেন, “শুধু আইনে হবে না। লাইন পারাপারের বিষয়টিকে মানবিক দিক থেকে দেখা উচিত রেলের। অসচেতনতা আর অসতর্কতার কারণে এই সব মৃত্যু বছরে কয়েক হাজার পরিবারে আলো নিভিয়ে দিচ্ছে।”



First Page| Calcutta| State| Uttarbanga| Dakshinbanga| Bardhaman| Purulia | Murshidabad| Medinipur
National | Foreign| Business | Sports | Health| Environment | Editorial| Today
Crossword| Comics | Feedback | Archives | About Us | Advertisement Rates | Font Problem

অনুমতি ছাড়া এই ওয়েবসাইটের কোনও অংশ লেখা বা ছবি নকল করা বা অন্য কোথাও প্রকাশ করা বেআইনি
No part or content of this website may be copied or reproduced without permission.