ধোনির জাহাজকে জয়ের বন্দরে নিয়ে যাচ্ছেন বিরাট-অশ্বিন
বিকেল পাঁচটা বাজে। দিনভর উৎসব শেষে চিন্নাস্বামীর ভিড় ধীরে ধীরে ছড়িয়ে পড়ছে ব্রিগেড রোড, অনিল কুম্বলে সার্কেলের দিকে। মাঠের মধ্যে পাশাপাশি হাঁটছে দু’টো চেহারা। গন্তব্য, ড্রেসিংরুম। এক জন লম্বা-চওড়া। অন্য জন তুলনায় বেঁটেখাটো। হাঁটতে-হাটতে মাঝেমাঝে দু’জনের ‘হাই ফাইভ।’ কখনও বা সামান্য ঝুঁকে একে অন্যকে টুকরো অভিনন্দন।
দু’জনের মধ্যে অমিল অনেক। এক জন বোলার। অন্য জন ব্যাটসম্যান। রবিবার এক জনের ঝুলিতে পাঁচ উইকেট, অন্য জনের সেঞ্চুরি। লম্বা-চওড়া ছেলেটা অফস্পিন না করলে হয়তো ইঞ্জিনিয়ার হয়ে যেতেন। ‘আমাকে দেখুন’ মার্কা বিজ্ঞাপন শরীরে কোথাও নেই। শান্ত। নম্র। নেহাতই ছাপোষা। অন্য জন, রীতিমতো ফ্যাশন-বিলাসী। চুল থেকে পায়ের নখ, সবই দেশের চব্বিশ-পঁচিশের কাছে ফ্যাশন-স্টেটমেন্ট। নিত্যনতুন গাড়ির শখ আছে। ডাকাবুকো, কখনও বদমেজাজি, কখনও বা বিতর্কিত। কিন্তু মাঠে নেমে আবার ব্যাট হাতে বোলারদের শায়েস্তা করতেও জানেন।
কোহলি: ১০৩
কিন্তু রবিবারের বেঙ্গালুরু কোথাও যেন রবিচন্দ্রন অশ্বিন ও বিরাট কোহলিকে একই ‘পোডিয়ামে’ তুলে দিল। ভারতের টেস্ট ক্রিকেটের আকাশে দুই নতুন নক্ষত্রের প্রতিষ্ঠাই শুধু হল না, মহেন্দ্র সিংহ ধোনিও দেখে নিলেন এমন দুই লড়াকু ছেলে হাজির, যাঁদের উপর সংসার টানার দায়িত্ব নিশ্চিন্তে ছাড়া যায়।
অত্যুক্তি শোনাচ্ছে? সৌরভ গঙ্গোপাধ্যায়কে ধরা যাক। রবিবার সকালে বিরাটের সেঞ্চুরি দেখার পর কেমন যেন মন্ত্রমুগ্ধ শোনায় প্রাক্তন ভারত অধিনায়কের গলা। “পূজারাকে এখনও নতুন দেওয়াল বলার সময় আসেনি। কিন্তু বিরাট তৈরি হয়ে গিয়েছে। অবিশ্বাস্য ইনিংস। ও-ই ভারতীয় ক্রিকেটের ভবিষ্যৎ,” চিন্নাস্বামীর ক্লাবহাউসে দাঁড়িয়ে আনন্দবাজারকে বলছিলেন সৌরভ। আর অশ্বিনের ধুন্ধুমার পারফরম্যান্স দেখে টুইটারে সঞ্জয় মঞ্জরেকর লিখে ফেলছেন, ‘অশ্বিনের সবচেয়ে বড় ক্ষমতা হচ্ছে ওর ডেলিভারিগুলো নিরানব্বই শতাংশ স্টাম্পে থাকে।” এবং দু’টো পর্যবেক্ষণই সত্যি। এই দু’জন না থাকলে দিনের শেষে ২৪৪ নয়, নিউজিল্যান্ডের এগিয়ে থাকার অঙ্কটা নির্ঘাত আরও অনেক বেশি হত। যা পরিস্থিতি তাতে, আড়াইশো বা তার আশেপাশে জয়ের টার্গেট থাকলে ম্যাচ জিততে বোধহয় অসুবিধা হওয়ার কথা নয় ধোনির।
অশ্বিন: ৫-৬৯
বিরাট আজ ৯৩ থেকে বেশি দূর এগোননি, কিন্তু তাঁর ১৯৪ বলে ১০৩ ভারতকে এমন এক পাটাতনে তুলে দিল যেখান থেকে পাল্টা লড়াই চালানো যায়। তিনি ছিলেন বলেই ভারত প্রথম ইনিংসে সাড়ে তিনশো পেরিয়েছে। সিনিয়রদের ব্যথর্তার গন্ধমাদন চাপ সামলে বিশল্যকরণী খোঁজার কাজটা দিল্লির যুবকই করেছেন। কিন্তু তার পরেও দরকার ছিল এক দক্ষ নাবিকের যিনি ধোনির ‘জাহাজ’-কে ধীরে ধীরে জয়ের তটভূমির দিকে নিয়ে যাবেন। অশ্বিন ছাড়া সেটা আর কে পারতেন?
দ্বিতীয় ইনিংসে নিউজিল্যান্ডের যে ন’টা উইকেট পড়ল, তার মধ্যে অশ্বিনেরই পাঁচটা। হায়দরাবাদে ১২ উইকেটের পর বেঙ্গালুরুতে আপাতত দু’ইনিংস মিলিয়ে ৬। তৃতীয় দিনেও চিন্নাস্বামীর পিচ ব্যাটসম্যানের শত্রু নয়। বরং চতুর্থ বা পঞ্চম দিন থেকে খারাপ হওয়ার সম্ভাবনা। কিন্তু অশ্বিনের অত সময় কোথায়? বাকি অস্ত্র দূরে রেখে স্রেফ ফ্লাইটেই বিপর্যস্ত করে ছাড়লেন কিউয়িদের। কেউ লোভীর মতো ক্রিজ ছেড়ে বেরিয়ে স্টাম্পড। টিম সাউদির (যাঁর সাত উইকেট ঢাকা পড়ল অশ্বিন-আশ্চর্যে) মতো কেউ কেউ আবার তাঁকে মাঠের বাইরে ফেলতে গিয়ে বোল্ড। হরভজন সিংহ নয়, ক্রিকেটমহল অশ্বিনের সঙ্গে কুম্বলের মিল পায়। কর্নাটকী লেগস্পিনারের মতো তাঁকেও একটা সময় শুনতে হয়েছে, ‘স্পিনার হু কান্ট স্পিন।’ ‘বল ঘোরে না’ অপবাদ নিয়েও কুম্বলে উইকেটশিকারের সংখ্যায় টেস্ট বিশ্বে সর্বকালের সেরাদের তালিকায় তিনে। অশ্বিনের সেখানে ৮ নম্বর টেস্ট চলছে। উইকেট ৪৯। খুব খারাপ এগোচ্ছেন কী?
বিরাট আবার একটা অদ্ভুত কথা শুনিয়ে গেলেন। ঠিক যতটা অদ্ভুত এ দিন সেঞ্চুরির পর তাঁর অভিব্যক্তি। উত্তেজিত ভঙ্গি নেই, সেঞ্চুরির স্ট্রোকটাকে ফাইন লেগ বাউন্ডারিতে পাঠিয়ে বিরাটের মুখে একটা হাসি দেখা গেল। পরিতৃপ্তির হাসি। পরে বলছিলেন, “আমার উপর যত চাপ আসে, তত আমার খেলা খোলে। বোলার আমার স্টাম্প আক্রমণ করলে আমার আনন্দ হয়। কারণ আমি তখন বুঝে যাই, আউটফিল্ড এখন অনেকটাই ফাঁকা। রান পেতে অসুবিধা হবে না।” আর কাকতালীয় কি না জানা নেই, বিরাট-অশ্বিন শৌর্যের ছাপ রেখে গেলেন তাঁদেরই সামনে যাঁদের জুতোয় তাঁরা পা গলাতে চলেছেন। কেএসসিএ প্রেসিডেন্ট অনিল কুম্বলে এবং চিন্নাস্বামীতে সংবর্ধনা নিতে আসা ভিভিএস লক্ষ্মণ দু’জনেই আজ স্টেডিয়ামে সশরীরের উপস্থিত ছিলেন। লক্ষ্মণ বলেও দিলেন, “নিউজিল্যান্ড সিরিজই তো জুনিয়রদের প্রস্তুতির সেরা মঞ্চ। তাই ঠিক এই সময়টায় আমি সরে গিয়ে ঠিকই করেছি। ওরা খুব ভাল করছেও।”
সব মিলিয়ে, ভারতীয় ক্রিকেট-সংসারের সুখী, পরিতৃপ্ত ছবি। শুধু একটাই কাঁটা থেকে যাচ্ছে। সচিন বনাম গাওস্কর বিতর্ক আজও ফুলকি ছড়াল। সচিনের ফুটওয়ার্ক নিয়ে সৌরভ নিজে কী মনে করেন? “নিউজিল্যান্ডের বিরুদ্ধে দু’টো টেস্ট দেখে কিছু বলাটা ঠিক নয়। অস্ট্রেলিয়া-ইংল্যান্ড সিরিজ পর্যন্ত অপেক্ষা করা উচিত। আর গাওস্করের মন্তব্যের ঠিকঠাক ব্যাখ্যা হয়েছে বলে মনে হয় না।”
সৌরভ বলছেন বটে, কিন্তু অকল্যান্ডের কাগজে লেখালেখি হয়েছে সচিনের এমন বিশ্রী ইনিংস নাকি দেখা যায়নি। রবিবারও ক্যামেরা বারবার ‘লিটল মাস্টার’কে ধরল। মাঠে তাঁর হাঁটাচলা, টুপি ঠিক করা, সব। দ্বিতীয় ইনিংসে ব্যাট হাতে সচিন নামার পর টিভি ক্যামেরাগুলো নিশ্চয়ই আরও সক্রিয় হয়ে উঠবে।

স্কোর
প্রথম ইনিংস

নিউজিল্যান্ড: ৩৬৫
ভারত: (আগের দিন ২৮৩-৫)
কোহলি এলবিডব্লিউ সাউদি ১০৩
ধোনি এলবিডব্লিউ সাউদি ৬২
অশ্বিন নঃআঃ ৩২
জাহির ক ফান উইক বো সাউদি ৭
ওঝা ক ফান উইক বো সাউদি ০
উমেশ বো বোল্ট ৪
অতিরিক্ত ১৯,
মোট ৩৫৩।
পতন: ৫, ২৭, ৬৭, ৮০, ১৭৯, ৩০১, ৩১২, ৩২০, ৩২০।
বোলিং: বোল্ট ২৩.৫-২-৯০-১, সাউদি ২৪-৬-৬৪-৭, ব্রেসওয়েল ২০-৪-৯১-২,
ফ্র্যাঙ্কলিন ১০-৪-১৭-০, পটেল ১৯-৫-৭৮-০।

দ্বিতীয় ইনিংস
নিউজিল্যান্ড
ম্যাকালাম ক ধোনি বো উমেশ ২৩
গুপ্টিল বো উমেশ ৭
উইলিয়ামসন ক সহবাগ বো অশ্বিন ১৩
টেলর এলবিডব্লিউ ওঝা ৩৫
ফ্লিন ক সহবাগ বো অশ্বিন ৩১
ফ্র্যাঙ্কলিন স্টাঃ ধোনি বো অশ্বিন ৪১
ফান উইক এলবিডব্লিউ অশ্বিন ৩১
ব্রেসওয়েল এলবিডব্লিউ ওঝা ২২
সাউদি বো অশ্বিন ২
পটেল ব্যাটিং ১০
বোল্ট ব্যাটিং ০
অতিরিক্ত ১৭
মোট ২৩২-৯।
পতন: ৩০, ৩১, ৬৯, ১১১, ১৪০, ১৯৫, ২১৬, ২২২, ২২২।
বোলিং: জাহির ১২-২-৩৭-০, উমেশ ১৪-০-৬২-২, ওঝা ২০-৬-৪৮-২,
অশ্বিন ২২-১-৬৯-৫, রায়না ১-১-০-০।




First Page| Calcutta| State| Uttarbanga| Dakshinbanga| Bardhaman| Purulia | Murshidabad| Medinipur
National | Foreign| Business | Sports | Health| Environment | Editorial| Today
Crossword| Comics | Feedback | Archives | About Us | Advertisement Rates | Font Problem

অনুমতি ছাড়া এই ওয়েবসাইটের কোনও অংশ লেখা বা ছবি নকল করা বা অন্য কোথাও প্রকাশ করা বেআইনি
No part or content of this website may be copied or reproduced without permission.