সাম্রাজ্যবাদের বিরুদ্ধে কলিকাতায় আস্ত একটা মিছিল হইয়া গেল। এমন মিছিল সচরাচর বামপন্থীরাই করিয়া থাকেন। শনিবারের বারবেলায় রাজধানীতে এই মিছিলের আয়োজকও ছিল সি পি আই এম-ই। মিছিলের তেমন কোনও উপলক্ষ ছিল না। এমনও নয় যে সাম্রাজ্যবাদ (পড়িতে হইবে ‘মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র’) নূতন করিয়া কোনও দেশে অভিযান চালাইয়াছে। বরং ইরাক হইতে মার্কিন নৌসেনারা ফিরিয়া গিয়াছে, আফগানিস্তান হইতেও ফেরার তোড়জোড় চলিতেছে। তবু কলিকাতার নাগরিকের নিস্তার নাই, অবরুদ্ধ রাজপথে নাকাল হওয়াই তাহার বিধিলিপি। শুনা যাইতেছে, দল নাকি ক্যাডারদের সাম্রাজ্যবাদের মর্ম বুঝাইতে নিয়মিত ক্লাসও লইতেছে এবং সেই সব ক্লাসে অন্য নেতাদের পাশাপাশি অসুস্থ শরীরেও শিক্ষকের ভূমিকায় অবতীর্ণ হইয়াছেন বুদ্ধদেব ভট্টাচার্য।
সাম্রাজ্যবাদ কাহাকে বলে, ইহা কয় প্রকার ও কী কী, তাহা নিশ্চয় ওই সব ক্লাসে সবিস্তার ব্যাখ্যাত, বিশ্লেষিত হইতেছে। কমিউনিস্টরা চিরকালই সাম্যবাদ ও সমাজতন্ত্রের বিরুদ্ধে ধনতন্ত্র ও সাম্রাজ্যবাদের ষড়যন্ত্র প্রত্যক্ষ করিয়াছেন। সাম্রাজ্যবাদ তাঁহাদের কাছে একচেটিয়া লগ্নি পুঁজির তরফে ভিন দেশের বাজার দখলের অভিযান। এই লেনিনীয় সংজ্ঞায় স্থিত থাকিয়া তাঁহারা সেই পুঁজি রফতানির স্বার্থে অন্য দেশে চালানো সাম্রাজ্যবাদী দখলদারির বিরুদ্ধে আন্দোলনে মুখর হন, সামরিক, রাজনৈতিক ও অর্থনৈতিক ভাবে কোনও দেশকে পদানত করার চক্রান্তের বিরুদ্ধে প্রতিবাদে নামেন। মজার ব্যাপার হইল, সাবেক ধনতন্ত্রের মধ্য হইতেই সাম্রাজ্যবাদের উত্থান ও বিবর্তনের তত্ত্বে কমিউনিস্টরা বিশ্বাসী। তাই কোনও স্বঘোষিত সমাজতান্ত্রিক দেশ যখন প্রতিবেশী ও নির্ভরশীল রাষ্ট্রকে অর্থনৈতিক ভাবে গ্রাস করিতে উদ্যত হয়, সেটাকে তাঁহারা সাম্রাজ্যবাদ মনে করেন না। সোভিয়েত ইউনিয়ন যখন হাঙ্গারি, চেকোস্লোভাকিয়া ও পোল্যান্ডের গণতন্ত্রকামী জনসাধারণের বিরুদ্ধে ট্যাংক ও সাঁজোয়া গাড়ি পাঠায় কিংবা ঘরের পাশে আফগানিস্তানকে দখল করিয়া লয়, তখন সি পি আই এমের তাত্ত্বিকদের প্রতিবাদ করিতে দেখা যায় নাই। আজ যখন কমিউনিস্ট-শাসিত রাষ্ট্রীয় পুঁজিবাদের পথিক চিন ভারতকে হুমকি দিতেছে, পাকিস্তান-শ্রীলঙ্কা-মায়ানমারকে পুঁজির প্রভাবে নত করিতেছে, দক্ষিণ চিন সাগরের দুর্বল দেশগুলির বিরুদ্ধে জনশূন্য দ্বীপের দখল লইয়া আগ্রাসন চালাইতেছে কিংবা আফ্রিকা ও পশ্চিম এশিয়ার নানা দেশে অর্থনৈতিক নয়া-উপনিবেশবাদ অনুশীলন করিতেছে, তখন বঙ্গীয় কমিউনিস্টদের মুখে কুলুপ।
সাম্রাজ্যবাদ সংক্রান্ত বামপন্থী ধারণাটি বস্তুত একটি জুরাসিক ধারণা। শিক্ষকের কাছ হইতে দলীয় ক্যাডাররা নিশ্চয় এমন একপেশে ধারণাই শিক্ষা করিবেন। ফলে তাঁহাদের কাছে সাম্রাজ্যবাদের স্বরূপ যেমন উন্মোচিত হইবে না, তাহার বিরুদ্ধে সংগ্রামের পন্থা-প্রকরণও তেমন অধরাই থাকিয়া যাইবে। এই অসম্পূর্ণ ও খণ্ডিত জ্ঞান লইয়া ক্যাডাররা কত দূর অগ্রসর হইবেন? অনেকের ধারণা, পরাজিত দলের কর্মীদের মনে উদ্দীপনা জিয়াইয়া রাখিতে এবং মমতা বন্দ্যোপাধ্যায়ের বাম-ঘেঁষা ভাবমূর্তি গড়ার প্রয়াস হইতে সচেতন দূরত্ব রাখিতেই এই পার্টি-ক্লাস। কর্মীরা যে হতাশাগ্রস্ত, তাঁহাদের অবসাদ যে সহসা কাটিবার নয়, প্রতিটি কর্মসূচিতেই সেটা স্পষ্ট। মমতার প্রতিটি সরকারি সিদ্ধান্তই যে বামপন্থার পালের হাওয়া কাড়িয়া লইতেছে, তাহাও নিশ্চিত। এ অবস্থায় সাম্রাজ্যবাদই বোধ করি একমাত্র বিভাজনরেখা, যাহা মমতার নীতি ও কর্মসূচি হইতে বামপন্থীদের আলাদা করিতে পারে। বিমান-বুদ্ধদেবরা আবার এই পথ হাঁটিয়াই ক্ষমতার অলিন্দে পৌঁছান। পথটি এখন ঝোপ-জঙ্গল-আগাছায় হারাইয়া গিয়াছে। কিন্তু অন্য পথের হদিশ যে সি পি আই এমের কেতাবে নাই! |