ইতিহাসে প্রতীকের মূল্য বিস্তর। অনেক প্রতীক প্রতীকমাত্র, কিছু কিছু তাহার অধিক। যখন একটি ঘটনা ইতিহাসের গতি ও প্রকৃতির উপর বড় রকমের প্রভাব বিস্তার করে, তখন তাহার প্রতীকী মূল্য এক ভিন্ন মাত্রা প্রাপ্ত হয়। ২০০৮ সালের ৩ অক্টোবর টাটা গোষ্ঠীর কর্ণধার রতন টাটা ঘোষণা করিয়াছিলেন, সিঙ্গুরে ন্যানো মোটরগাড়ি নির্মাণের জন্য প্রস্তাবিত প্রকল্পটি তাঁহারা প্রত্যাহার করিয়া লইতেছেন। সেই বিদায়বার্তা ঘোষণার মুহূর্তটিকে এই পত্রিকার এই স্তম্ভে ‘ঐতিহাসিক লগ্ন’ হিসাবে চিহ্নিত করা হইয়াছিল। আমরা বলিয়াছিলাম, উহা ‘দুর্ভাগ্যের ইতিহাস। কলঙ্কের ইতিহাস।’ তাহার পরে প্রায় চার বছর অতিক্রান্ত। পশ্চিমবঙ্গের রাজনীতিতে পালাবদল ঘটিয়া গিয়াছে, মহাকরণে জমানা বদলাইয়াছে। কিন্তু দুর্ভাগ্যের ইতিহাস বহমান। পশ্চিমবঙ্গের ঐতিহাসিক দুর্ভাগ্য নির্মম ধারাবাহিকতায় তাহার মাশুল গনিয়া লইতেছে। দেশের শিল্পবাণিজ্যের মানচিত্রে এই রাজ্যের ক্রমিক পশ্চাদপসরণ এই ‘পরিবর্তিত’ পশ্চিমবঙ্গেও অব্যাহত। গত সপ্তাহে টাটা গোষ্ঠীর একটি অনুষ্ঠানে যোগ দিতে আসিয়া রতন টাটা আরও এক বার সিঙ্গুরের দুর্ভাগ্যজনক ইতিবৃত্ত স্মরণ করিয়াছেন এবং সংকেত দিয়াছেন যে, অনুকূল পরিবেশ পরিস্থিতি দেখা দিলে তাঁহারা এই রাজ্যে বিনিয়োগে আগ্রহী। সতর্ক সংযত এই উক্তিতে একটি অপ্রিয় সত্য নিহিত পশ্চিমবঙ্গের পরিবেশ পরিস্থিতি এখনও শিল্পবাণিজ্যের অনুকূল হয় নাই।
মমতা বন্দ্যোপাধ্যায় এই দুর্ভাগ্যের ইতিহাস সৃষ্টি করেন নাই। অবক্ষয়ের সূচনা হইয়াছিল ষাটের দশকে। সেই পাতালপ্রবেশের ভগীরথ ছিলেন বামপন্থীরা। আজ তাঁহাদের ‘সাম্রাজ্যবাদ-বিরোধী মিছিল’ একটি করুণ প্রহসন মাত্র, কিন্তু সেই যুগে তাঁহারা নেতির রাজনীতি সাধন করিয়া পশ্চিমবঙ্গের মানুষকে যাহা উপহার দিয়াছেন তাহা প্রহসন নহে, ট্র্যাজেডি। সেই বহুচর্চিত ইতিহাসের পুনরাবৃত্তি নিষ্প্রয়োজন। বামফ্রন্ট ক্ষমতায় আসিবার পরেও বহু কাল নেতির সাধনায় রত ছিল। পরিণামে জ্যোতি বসুর পশ্চিমবঙ্গ ক্রমশই ভারতীয় উন্নয়নের পরিসর হইতে দূরে সরিয়া গিয়াছে। নূতন শতকে, বিশেষত ২০০৬ সালের নির্বাচনী সাফল্যের পরে বুদ্ধদেব ভট্টাচার্য ইতিহাসের চাকা ঘুরাইবার সচেতন ও সাহসী উদ্যোগ করিয়াছিলেন, কিন্তু অপদার্থ প্রশাসন, অনাচারী দলতন্ত্র এবং তাঁহার আপন দুর্বলতা এই ত্র্যহস্পর্শে শেষরক্ষা করিতে পারেন নাই, মমতা বন্দ্যোপাধ্যায় তাঁহার ছিপ এবং মাছ, দুইই হরণ করিয়া লইয়াছেন।
পশ্চিমবঙ্গের মসনদ হইতে বামফ্রন্ট বিদায় লইয়াছে, বামপন্থা বিদায় লয় নাই। মমতা বন্দ্যোপাধ্যায় সি পি আই এমকে পরাজিত করিয়া ক্ষমতায় আসিয়াছেন, কিন্তু তাঁহার বিশ্বাস এবং পথ বামপন্থীদের চিরাচরিত নেতিবাদের কার্বন কপি। এবং সত্তরের দশকে ক্ষমতায় আসা জ্যোতি বসুর মতো তিনিও মনে করেন, পশ্চিমবঙ্গে বিনিয়োগ করিবার জন্য শিল্পোদ্যোগীরা স্বতঃপ্রবৃত্ত তৎপরতায় দলে দলে ছুটিয়া আসিবেন, তাঁহাদের উদ্দেশে নানাবিধ তর্জনগর্জনের ফাঁকেফোকরে দুই চারিটি মিষ্টবাক্য ছুড়িয়া দিলেই তাঁহারা আহ্লাদিত হইবেন। মমতা বন্দ্যোপাধ্যায় জানেন না, বিনিয়োগকারীরা পশ্চিমবঙ্গকে আজ আর হিসাবের মধ্যেই রাখেন না, কারণ তাঁহারা এই রাজ্যের শিল্পসম্ভাবনা সম্পর্কে সমস্ত উৎসাহ হারাইয়া ফেলিয়াছেন। রতন টাটার উচ্চারণে যে দীর্ঘশ্বাসটুকু ছিল, তাহাও আজ দুষ্প্রাপ্য, পশ্চিমবঙ্গের জন্য দীর্ঘশ্বাস ফেলিবার স্পৃহা কয় জন উদ্যোগীর আছে? |