‘সিজার’ হয় না ১৫টি স্টেট এবং মহকুমা হাসপাতালে
স্ত্রোপচার করে সন্তানের জন্ম দিতে হলে, চর মেঘনার কোনও প্রসূতিকে এখন পাড়ি দিতে হবে প্রায় ১০৫ কিলোমিটার।
নদিয়ার কাঁটাতারের বেড়ার ওপারের এই গ্রামের মহিলাদের অবশ্য প্রথম বাধা ওই বেড়াটাই। প্রসব যন্ত্রণা উঠলে প্রথমে সে কথা জানাতে হবে সীমান্তরক্ষী বাহিনীকে। সন্ধ্যেয় একবার দরজা বন্ধ হয়ে গেলে, রাতে তা খুলবে কি না, তা নির্ভর করে বিএসএফের উপরেই। তারপরেও ভরসা তারাই। রাতে ওই রাস্তায় যানবাহন চলে না। সীমান্তরক্ষী বাহিনীর গাড়িতে ওই প্রসূতি যেতে পারেন ২০ কিলোমিটার দূরের করিমপুর পর্যন্ত। সেখান থেকে করিমপুর গ্রামীণ হাসপাতালের মাতৃযান পেলে ভাল। না হলে গাড়ি ভাড়া করে ৮৫ কিলোমিটার দূরের কৃষ্ণনগর।
কিন্তু কেন অত দূর যেতে হবে? কারণ, কাছাকাছি দু’টি সরকারি হাসপাতালেই প্রসূতিদের অস্ত্রোপচার হয় না। করিমপুর গ্রামীণ হাসপাতালে নিয়ম থাকলেও অস্ত্রোপচার হয় না। তেহট্ট মহকুমা হাসপাতালেও ৫ মাস অস্ত্রোপচার বন্ধ। তবে নার্সিংহোম রয়েছে। সেখানে যেতে না চাইলে চর মেঘনার মতো প্রত্যন্ত এলাকা থেকে কৃষ্ণনগর সদর হাসপাতালে পৌঁছতে সব কিছু ঠিকঠাক থাকলেও লেগে যাবে কম করেও আড়াই ঘণ্টা। খরচও বাড়বে তেমনই লাফ দিয়ে।
পনেরোটি হাসপাতালের তালিকায় রয়েছে তেহট্ট মহকুমা হাসপাতালও। ছবি: কল্লোল প্রামাণিক
মাসখানেক আগেই সিজারের জন্য করিমপুর গ্রামীণ হাসপাতাল থেকে কৃষ্ণনগর সদর হাসপাতালে রেফার করা হয় প্রসূতি বঞ্চিতা বিশ্বাসকে। কৃষ্ণনগরে পৌঁছে অস্ত্রোপচারের পরে তাঁর সদ্যোজাত কন্যার মৃত্যু হয়। কৃষ্ণনগরের চিকিৎসকেরাই জানিয়েছেন, কয়েক ঘণ্টা আগে সিজার করা গেলে হয়তো শিশুকে বাঁচানো যেত।
একমাত্র নদিয়াতেই সরকারি হাসপাতালে সিজারের এই অবস্থা তা কিন্তু নয়। স্বাস্থ্য দফতরই স্বীকার করেছে, রাজ্যে এই মুহূর্তে মহকুমা ও স্টেট জেনারেল মিলিয়ে অন্তত ১৫টি হাসপাতালে ন্যূনতম সিজারের ব্যবস্থাটাই নেই। বাউড়িয়া, বাসন্তী, কুলতলি, গোসাবা, দক্ষিণ হাওড়া সর্বত্র একই অবস্থা। গ্রামীণ হাসপাতালগুলিতেও প্রশিক্ষণপ্রাপ্ত অ্যানাসথেটিস্টের সাহায্য নিয়ে সিজার করার কথা। কিন্তু ৯০ শতাংশ গ্রামীণ হাসপাতালে স্বাভাবিক প্রসব ছাড়া আর কিছু হয় না।
সমস্যা অন্য জায়গাতেও। এক জায়গায় সিজার না-হওয়ায় যখন প্রসূতিকে ৬০-৭০ কিলোমিটার দূরে রেফার করা হচ্ছে, তখন তাঁকে সেখানে নিয়ে যাওয়ার যানবাহন অনেক ক্ষেত্রে পাওয়া যাচ্ছে না বলেও অভিযোগ। এই রেফারল-যান নিখরচায় দেওয়ার কথা সরকারের। কিন্তু স্বাস্থ্যকর্তারাই জানাচ্ছেন, সরকারের দেওয়া টাকায় অধিকাংশ গাড়ির মালিকই চুক্তি করতে রাজি হচ্ছেন না। ফলে রেফারল-যান পরিকল্পনাই বাতিল হতে বসেছে। আরও দিশেহারা হয়েছেন রোগীরা।
সিজার না-হওয়ার কারণ হিসাবে স্বাস্থ্য দফতর বলছে, অ্যানাসথেটিস্ট-এর অভাবকে। স্বভাবত প্রশ্ন উঠেছে, যেখানে অ্যানাসথেটিস্টের অভাবে সিজার করা যাচ্ছে না, সেখানে প্রায় প্রতিদিন একটা করে নতুন মেডিক্যাল কলেজ খোলার ঘোষণা কী করে হচ্ছে? সেই কলেজের জন্য কী করে অ্যানাসথেটিস্ট পাওয়া যাবে? স্বাস্থ্য অধিকর্তা বিশ্বরঞ্জন শতপতীর বক্তব্য, “অ্যানাসথেটিস্ট-এর অভাবে বিশেষ করে স্টেট জেনারেল, গ্রামীণ হাসপাতালে অনেক জায়গায় সিজার করা যাচ্ছে না। আমরা ‘ওয়াকিং ইন্টারভিউ’ করে লোক নিচ্ছি। আশা করছি খুব তাড়াতাড়ি সমস্যা মিটবে। তা ছাড়া অ্যানাসথেশিয়ায় ডিপ্লোমা কোর্স চালু হচ্ছে। সেখান থেকেও কিছু চিকিৎসক পাশ করবেন।”
কিন্তু সেটাই যে একমাত্র কারণ যে নয়, তার জলজ্যান্ত উদাহরণ তেহট্ট মহকুমা হাসপাতাল। সেখানে স্ত্রীরোগ বিশেষজ্ঞও রয়েছেন আবার এক জন অ্যানাসথেটিস্টও আছেন। তা হলে সিজার পাঁচ মাস বন্ধ কেন? স্বাস্থ্যঅধিকর্তার জবাব, “ওই অ্যানাসথেটিস্ট আমাদের জানিয়েছেন, তিনি কাজে আত্মবিশ্বাস পাচ্ছেন না!” তা হলে তাঁকে কাজে বহাল রাখা হয়েছে কেন? তিনি বলেন, “ওঁকে একটু প্রশিক্ষণ দেওয়া হবে বলে ঠিক করেছি। ততদিন সিজার বন্ধ রয়েছে!” স্বাস্থ্য দফতরের বিশেষজ্ঞ গ্রুপের প্রধান সুব্রত মৈত্রও বলেন, “অনেক হাসপাতালে সব চিকিৎসক থাকলেও অস্ত্রোপচারের পরিকাঠামো না-থাকায় সিজার হচ্ছে না। এটা দুঃখজনক।”
এই একবিংশ শতকেও দক্ষিণ ২৪ পরগনার কুলতলিতে কোনও প্রসূতি সিজার হওয়ার জন্য এলে তাঁকে রেফার করা হবে নিমপীঠ গ্রামীণ হাসপাতালে, সেখানেও সিজার হবে না, তাঁকে পাঠানো হবে পদ্মের হাট গ্রামীণ হাসপাতালে, সেখানেও সিজার বন্ধ। তখন তাঁকে রেফার করা হবে বারুইপুর মহকুমা হাসপাতালে। সেখানেও সিজার না-হওয়ার সম্ভাবনা কারণ সেখানে ২৪ ঘণ্টা সিজারের ব্যবস্থা নেই। শেষ গন্তব্য টালিগঞ্জের এমআর বাঙুর হাসপাতাল। তত ক্ষণে যদি প্রসূতি সুস্থ থাকেন, তবে সেটা তাঁর বরাতজোর।



First Page| Calcutta| State| Uttarbanga| Dakshinbanga| Bardhaman| Purulia | Murshidabad| Medinipur
National | Foreign| Business | Sports | Health| Environment | Editorial| Today
Crossword| Comics | Feedback | Archives | About Us | Advertisement Rates | Font Problem

অনুমতি ছাড়া এই ওয়েবসাইটের কোনও অংশ লেখা বা ছবি নকল করা বা অন্য কোথাও প্রকাশ করা বেআইনি
No part or content of this website may be copied or reproduced without permission.