বিশেষ তারিখ সাধারণত আমার মনে থাকে না। কিন্তু পয়লা সেপ্টেম্বর তারিখটা কী করে ভুলি? শনিবার সকালে ঘুম থেকে উঠে মনটা খারাপ হয়ে গেল। মনে পড়ল, এই প্রথম মান্নাদার জন্মদিনে মান্নাদাই নেই! সবসময় অনুভব করি বড়দাদা হয়ে পিঠে হাত রাখার আর কেউ নেই। বউদিকে একটা ফোন করতে হবে। ফেব্রুয়ারিতে মান্নাদা মারা যাওয়ার আগেও তো যাতায়াত ছিল।
মান্নাদাকে নিয়ে কোনও লেখা ঠিক কী ভাবে শুরু করা উচিত, ভেবে কুল পাচ্ছি না। সম্পর্কের শুরু সেই ১৯৫২ থেকে। বড় দাদা আর ছোট ভাইয়ের ৬০ বছরের সম্পর্ক কী অল্প কথায় ব্যাখ্যা করা যায়? কত স্মৃতি, কত ঘটনা। কোনটা ছেড়ে কোনটা বলি? শুরুটাই বলা যাক। ’৫২তে ইউনিভার্সিটি লিগ খেলছি, হঠাৎ খবর পেলাম মাঠের বাইরে মান্নাদা, কুমারবাবু (উমাপতি কুমার) ও অভিনেতা জহর গঙ্গোপাধ্যায় আমার জন্য অপেক্ষা করছেন। বেরোতেই মান্নাদা পিঠে হাত রেখে বললেন, “গাড়িতে ওঠো, মোহনবাগান মাঠে চলো।” সেই শুরু স্বপ্ন দেখার। ফুটবল অন্ত প্রাণ আমি, মোহনবাগান আমার মন্দির, মান্নাদা আমার আদর্শ। সেই যে পিঠে হাত রেখে ছিলেন, ৬০ বছরে কখনও সরাননি। দাদা-ভাইয়ের সম্পর্কে উষ্ণতা ও ভালবাসা বরাবর থেকে গিয়েছে।
দু’-একটা গল্প না বলে পারছি না। ’৫৩ সালে ডুরান্ড জিতে ফিরছি। ফুটবলার জীবনে আমার প্রথম সাফল্য। কালকা মেলে ফিরছে টিম। ভোররাতে গাড়ি এলাহাবাদে ঢোকার কথা। কামরায় সবাই ঘুমোচ্ছে। আমি কিন্তু ধোপদুরস্ত ফিটফাট হয়ে রেডি। হঠাৎই পাশের বাঙ্ক থেকে মান্নাদার গলা। “কীরে এতো ভোরবেলা ফিটফাট কেন?” বললাম, “সবুর করুন, স্টেশন এলেই বুঝবেন।” |
|
|
তিনি মারা গিয়েছেন ২৭ ফেব্রুয়ারি। দেখতে দেখতে কেটে গিয়েছে ছ’মাস। অথচ শৈলেন মান্নার
মৃত্যুর পর প্রথম
জন্মদিনে (৮৮তম) শহরজুড়ে উৎসাহ দেখে মনে হল না তিনি আর নেই। কালীঘাট
স্পোর্টস লাভার্স অ্যাসোসিয়েশনের
অনুষ্ঠানে শৈলেন মান্নার মূর্তিতে মালা দিলেন প্রদীপ বন্দ্যোপাধ্যায়,
অমল দত্ত ও সুব্রত ভট্টাচার্য। বিধাননগর পৌরসভা
পরিচালিত অনুষ্ঠানে শৈলেন মান্নার প্রতিকৃতিতে
ফুল দিচ্ছেন তাঁর স্ত্রী আভা মান্না। পাশে বিধায়ক সুজিত বসু।
অনুষ্ঠান পালন করল
কৃষ্ণপুর
বিদ্যাসাগরপল্লী নাগরিক কমিটিও। ছবি: শঙ্কর নাগ দাস |
|
স্টেশনে গাড়ি ঢুকতেই হইহই কাণ্ড। আমাদের কামরার সামনে ভিড়। প্রবাসী দুই বাঙালী পরিবার এসেছেন, আমাকে নেমন্তন্ন করতে। বাড়তি আকর্ষণ, বেশ কয়েকটি ফুটফুটে সুন্দরী তরুণী। দু’টো পরিবারের বাড়িতেই নেমন্তন্ন। কিন্তু ম্যানেজার কেষ্ট সেন কিছুতেই ছাড়বেন না। সে যাত্রা বাঁচালেন মান্নাদা। ট্রেন থেকে নামার অনুমতি মিলল। একদিন পরে টিমের সঙ্গে যোগ দিলাম বেনারসে। বহু ঘটনার ভিড়ে মনে পড়ছে ’৫৬-র কথাও। মোহনবাগানের হয়ে খেলতে গিয়েছি হংকং, ইন্দোনেশিয়া, সিঙ্গাপুর। একদিন সাত সকালে মান্নাদা হোটেলের ঘরে হাজির। পিঠে হাত রেখে বললেন, “কলকাতায় বাবাকে কী রকম দেখে এসেছিস?” জানা গেল, কলকাতা থেকে ধীরেন দে-র টেলিগ্রাম এসেছে আমার নামে। ‘ফাদার সিরিয়াসলি ইল। কাম শার্প।’ বাড়িতে বাবাকে সুস্থ দেখে এসেছি। হঠাৎ এই টেলিগ্রামে একেবারেই ভেঙে পড়েছিলাম। মান্নাদা বিদেশে বুকে আগলে রাখলেন। বললেন, “মন শক্ত কর। আমরা তো আছি।” খুব অবাক হয়েছিলাম, বাড়ির কেউ কেন টেলিগ্রাম পাঠাল না। হাওড়ার বালিতে আমাদের বাড়ি। মান্নাদাকে বলেছিলাম ওখানে খবর নিতে। দেশে ফেরার পর বেরিয়েছিল, দলবদলের সময় আমাকে ভাঁওতা দিতে ধীরেনদার নাম করে আমাকে মিথ্যে টেলিগ্রাম করা হয়েছিল। আনন্দবাজারে পরে বিষদ ব্যাখ্যা দিয়ে খবরটা বেরিয়েও ছিল। তখন মান্নাদা যে ভাবে আমাকে আগলেছিলেন জীবনে ভোলা সম্ভব নয়।
কত বড় ফুটবলার ছিলেন তা নিয়ে নতুন করে আমি কী বলব? গায়ে গতরে নয়, ফুটবলটা খেলতেন মাথা দিয়ে। এদেশের ফুটবল বরাবর মান্নাদাকে মনে রাখবে। তাঁর স্বচ্ছ, বিনয়ী, মাথা উঁচু করে থাকা ভাবমূর্তির জন্য। আমরা জানতাম, মান্নাদা মানেই মোহনবাগান। মোহনবাগান মানেই মান্নাদা। সেই মান্নাদার মরদেহ মোহনবাগান ক্লাবে এল না কেন, সেই প্রশ্ন আজও ভাবায়। কী কারণে ওই দুঃখজনক ঘটনা ঘটেছিল সেই ব্যাখ্যায় যাচ্ছি না। কিন্তু ঘটেছিল তো! মান্নাদার মতো প্রবাদপ্রতিম ফুটবলারের ক্ষেত্রেই যদি এই হয়, তা হলে আমাদের বেলা কী হবে ভাবলে কষ্ট হয়। |