‘এখনও সোনা আনব’, অভিমান উপেক্ষিতের চোখে
স্বপ্ন কখনও সূর্যের আলো বেয়েও নেমে আসে! যেমন এসেছিল দশক দু’য়েক আগে। নদিয়ার তাহেরপুরে।
পুরসভার মাঠে সকালের রোদে তখন প্রশিক্ষণ চলছে স্থানীয় সেনা ক্যাম্পে। তাগড়াই চেহারার বেশ কিছু ছেলে ছুটছে। দড়ি ধরে ঝুলছে, লাফাচ্ছে। আর দূরে দাঁড়িয়ে বছর বারোর ছেলেটা ভাবছে, ‘ওদের সঙ্গে লাফাই? স্কুলে ক্রাচ নিয়ে দৌড়োই, একটা পা তো আছে। ঠিক পারব!’
ব্যস! মাঠে নেমে পড়ল সোমনাথ মালো। তিন বছর বয়েসে পোলিও বাঁ পায়ের ক্ষমতা কেড়ে নিলেও ডান পা সক্ষম। গিয়ে বলল, আমিও লাফাব। এক পায়ে হাইজাম্পে হারিয়েও দিল সেই শিক্ষানবিশ সেনানীদের! দিনের পর দিন। বিস্মিত চোখগুলো বলত, তুই পারবি। অনেক দূর যাবি!
তখন থেকেই বাসা বাঁধে স্বপ্নটা। সোমনাথের বুকের বিরাট খাঁচাটায়।
তার পর জেলা, রাজ্য, জাতীয় স্তরে এসেছে বহু সাফল্য। তবু ২০০০ সালে অভাবের জেরে বেলজিয়ামে বিশ্ব প্রতিবন্ধী চ্যাম্পিয়নশিপে যাওয়া হয়নি। ফের সুযোগ এল ২০০২-এ। দক্ষিণ কোরিয়ার বুসানে, প্যারা এশিয়ান গেমসে। এ বার টাকার জোগাড় হল। আর প্রথম দিনেই বাজিমাত। হাইজাম্পে সোনা ছিনিয়ে নিল উনিশ বছরের সোমনাথ! বিশ্বের আঙিনায় স্বর্ণশিখর ছুঁল এক লড়াকু বাঙালি। কেউ জানতে পেরেছিলেন?
“আমাদের কথা কেউ জানে না ভাই। কখনও জানতেও চায় না!” দশটা বছর পর অনেক অভিমান নিয়ে বললেন লিউকেমিয়ার সঙ্গে লড়তে থাকা সোমনাথ।
আর বললেন এমনই একটা মুহূর্তে, যখন লন্ডনে রীতিমতো ঘটা করে প্যারালিম্পিক ২০১২-এর আসর বসছে। অথচ সেখানে যাওয়া ভারতীয় দলে একজনও বঙ্গসন্তান নেই!
বেঙ্গল প্যারালিম্পিক অ্যাসোসিয়েশন সূত্রে জানা যাচ্ছে, রাজ্যের কোনও ‘প্যারা অ্যাথলিট’ এ বার যোগ্যতামান পেরোতে পারেননি। পেরোতে পারবেনই কী করে? না আছে পরিকাঠামো, না আছে স্বীকৃতি। কোন জাদুমন্ত্র সাহস জোগাবে আরও অনেক সোমনাথকে?

সোমনাথ মালো

প্রবীর সরকার

লীলা সাহা
শুধু সোমনাথ তো নয়, স্বীকৃতির অভাব নিয়ে একই অভিমান ঝরছে প্রবীর সরকার, ভোলানাথ দলুই, লীলা সাহার গলায়। সেই মানুষগুলো, যাঁরা বিভিন্ন প্রতিবন্ধকতা নিয়েই জাতীয়-আন্তর্জাতিক আঙিনা থেকে একের পর এক সোনা, রুপো, ব্রোঞ্জ এনে দিয়েছেন রাজ্যকে। তেরঙ্গা উড়িয়েছেন বিশ্ব জুড়ে। ছুঁয়েছেন সাফল্যের শিখর।
আর শিখর ছোঁয়ার পুরস্কার? “পাঁচশো টাকাও নয়!” নিজের অটোটা রাস্তার পাশে দাঁড় করিয়ে বললেন শোভাবাজারের ছেলে, বছর ত্রিশের ভোলানাথ দলুই। চার বছর বয়সে লরি দুর্ঘটনার পর নকল পা লাগিয়ে গত ১৪ বছর উল্টোডাঙা-আহিরিটোলা রুটে অটো চালাচ্ছেন। অবশ্য অন্য পরিচয়ও তাঁর আছে। ২০০২ সালে জাতীয় প্যারালিম্পিক সাঁতার প্রতিযোগিতায় দু’টো রুপো, দু’টো ব্রোঞ্জ। ২০০৪-এ বেলজিয়ামে প্যারালিম্পিক চ্যাম্পিয়নশিপে সোনা, ব্রোঞ্জ। জাতীয় মিটে ১০ বার পদক জিতেছেন। ভোলানাথ জাতীয় স্তরের ওয়াটার পোলোতেও শেষ চার বার সোনাজয়ী বাংলা দলের অধিনায়ক!
ভোলানাথের কথায়, “সাঁতারে যাই ভালবেসে। শেখার পরিকাঠামো তেমন নেই। ওতে রোজগারও হয় না। ভরসা বলতে ছিল অটোটাই। তবে রাজ্যে নতুন সরকার আসার পর অস্থায়ী একটা কাজ জুটিয়ে দিয়েছেন ক্রীড়ামন্ত্রী।” তাতেই খুশি? “আসলে আমার থেকেও ভাল সাঁতারু আছে এ রাজ্যে। শেখার
সুযোগ পায় না। দেখলে খারাপ লাগে...” অটোয় বসে অভিমানী উত্তর সোনার ছেলের।
মধ্যমগ্রামের লীলা সাহার এটুকুও ‘স্বাচ্ছন্দ্য’ জোটেনি। স্টেশনের কাছেই লাড্ডু আর গজা তৈরির ছোট্ট একটি কারখানা। সেখানে চুল্লির কাছে বসে লাড্ডু বানাচ্ছিলেন ৩৮ বছরের বধূটি। মজুরি, দিন ফুরোলে ৮০ টাকা। একটা পা ট্রেনে কাটা পড়ে ৯ বছর বয়েসেই। বললেন, “বাড়ি চলুন। সব দেখাচ্ছি।”
ছোট্ট ঘরে ভাঙাচোরা খাট। তার নীচে মুখ আটকানো একটা বাজারের থলে। তার ভিতরে সোনা, রুপো আর ব্রোঞ্জ মিলিয়ে প্রায় একশো পদক! খাটের নীচে ডাঁই করা শিল্ড, কাপ। একটায় লেখা ‘চ্যাম্পিয়ন অফ চ্যাম্পিয়ন্স, ন্যাশনাল গেমস’। জাতীয় প্রতিবন্ধী মিটে সাত বারের চ্যাম্পিয়ন অফ চ্যাম্পিয়ন্স লীলা। শটপাট, জ্যাভলিন, ডিসকাসের পাশাপাশি সাঁতারে চার বিভাগে প্রতিটিতে অন্তত চারটি করে সোনা। প্যারালিম্পিকে বহু চেষ্টাতেও যাওয়ার সুযোগ মেলেনি।
২০ বছর বয়সে স্বামী হারিয়েও একা দুই সন্তানকে বড় করতে করতে খেলা চালিয়ে যাচ্ছিলেন। কিন্তু বাধা তো আর একটা নয়! রাজ্যকে এত সোনা এনে দেওয়ার পরে প্রতিশ্রুতির বন্যা বয়ে গিয়েছে। অথচ প্রতিবন্ধী ভাতাটুকুও পাননি সোনার মেয়ে। মেলেনি বিধবা ভাতাও। দিল্লিতে সনিয়া গাঁধী একটি স্কুটার দিয়েছিলেন। সেটাও খারাপ হয়ে গিয়েছে। সারানোর পয়সা নেই।
রাগ হয় না? লীলার জবাব, “নাহ। খেলা, সংসারের মাঝে পড়ে এ সব ভেবে পাগল হয়ে গিয়েছিলাম। পাগলী বলে ডাকত কেউ কেউ। কিন্তু ছেলেমেয়ে দু’টোকে তো একটু ভাত দিতে হবে। কাজে নেমে পড়লাম। তবে...”
তবে কী? “এখনও জলে নামলে চারটে সোনা। কেউ রুখতে পারবে না!” ঠিকরে বেরিয়ে আসে কোনির সেই প্রত্যয়“এক বার জলে পাই!”
প্যারালিম্পিক অ্যাসোসিয়েশনের রাজ্য সম্পাদক ভাস্কর মুখোপাধ্যায় নিজেই ৮০টির মতো পদক আর ট্রফি জয়ী। একটি হাত, একটি চোখ পুরোপুরি নষ্ট। ২০০৪ থেকে ২০১১ পর্যন্ত জাতীয় ক্রীড়ায় প্রতি বারই তিন-চারটি করে পদক এনে দিয়েছেন মধ্যমগ্রাম বীরেশপল্লির ভাস্কর। এ বছর কুয়েতে ওপেন ইন্টারন্যাশনাল চ্যাম্পিয়নশিপে শটপাটে রুপোও পেয়েছেন। অথচ কাজ জোটেনি আজও।
তবু স্বপ্ন যে পিছু ছাড়ে না! স্বপ্ন দেখেন এক ‘ফিরিওয়ালা’ শাহজাহান। শাহজাহান বুলবুল। বাড়ি রাজারহাটের পাকাপুলে। স্টুডিও থেকে ল্যাবরেটরি ছবি পৌঁছে দেন। একটি পা হাঁটুর নীচ থেকে সরু হয়ে গিয়েছে। সেই ছেলেরই ব্যাডমিন্টনে প্রচুর পদক। দক্ষিণ কোরিয়ায় প্যারা এশিয়ান গেমসে যাবেন ক’দিন বাদে। চোখে পদক জেতার স্বপ্ন তাঁর!
কেউ খোঁজ নেয়? “খোঁজ? জিতে ফিরলে কেউ একটা ফুলের তোড়াও দেয় না। কেন আমাদের দূরে সরিয়ে রাখে বলতে পারেন?” প্রশ্নটা হালিশহরের যুবক প্রবীর সরকারের। চার বছর বয়েসে দুর্ঘটনায় বাঁ পা হারান। তবু বুসানে রুপো এসেছিল লংজাম্পে। তার পর ২০০৬ সালে মালয়েশিয়া, এ বছর কুয়েত পদক না এলেও চার নম্বরে। এই প্রতিযোগিতাগুলোর মাঝে জাতীয় স্তরে সোনা-রুপো মিলিয়ে রাজ্যকে ৬টা পদকও এনে দিয়েছেন প্রবীর। স্বস্তি একটাই, সরকারি চাকরি জুটেছে। রাজ্যে পালাবদলের পর সংবর্ধনা পেয়েছেন। কিন্তু তাতেও পথ মসৃণ হয়নি। কেন?

শাহজাহান বুলবুল

ভোলানাথ দলুই
সরকারি-বেসরকারি সাহায্যে বছরখানেক আগে জার্মানি থেকে বিশেষ ‘ব্লেড’ এনেছেন প্রবীর। ক্রাচ ছেড়ে নিজের ‘পায়ে’ দাঁড়িয়েছেন ঠিকই, কিন্তু জানেন না, ওটা কী ভাবে আয়ত্ত করতে হয়। বলছেন, “বিদেশে গিয়ে ট্রেনিং নিতে পারলে ভাল হত। বাইরে সবাই এগুলো ব্যবহার করে। আমি এক পায়ে এঁটে উঠছি না। প্যারালিম্পিকে যোগ্যতামানই তো এ বার পেরোতে পারলাম না। এখানে কোনও প্রশিক্ষক নেই যিনি ব্লেডটা ব্যবহার করতে শেখাবেন।” তা হলে? “ইন্টারনেটে ‘ব্লেড রানার’ অস্কার পিস্টোরিয়াসের প্রশিক্ষণের ভিডিও দেখে শেখার চেষ্টা করছি” মৃদু হেসে উত্তর দিলেন প্রবীর।
স্বর্ণশিখর ছুঁয়েও কেন পিছিয়ে পড়ছেন এই ‘লড়াকু’ বাঙালিরা?
কারণ প্রতিবন্ধী ক্রীড়ার উপযুক্ত পরিকাঠামো এ রাজ্যে নেই বললেই চলে। মহকুমা বা জেলাস্তরে কয়েকটি সংগঠন স্থানীয় প্রশাসনের সঙ্গে এই খেলোয়াড়দের জন্য প্রতিযোগিতার আয়োজন করলেও প্রশিক্ষণের ব্যবস্থা নেই। রাজ্যস্তরেও উৎসাহ ছাড়া কিছুই জোটে না। জাতীয় বা আন্তর্জাতিক প্রতিযোগিতার আগে সল্টলেকে ‘সাই’ কমপ্লেক্সে কিছু দিন ‘স্বাভাবিক’ খেলোয়াড়দের সঙ্গে প্রশিক্ষণ হয়। তবে প্রয়োজনের তুলনায় সেটা খুবই কম। প্রতিবন্ধী খেলোয়াড় হিসেবে চাকরির সুযোগও রাজ্যে নেই।
তবু এই ‘লড়াকু’ বাঙালিরা কিছু ‘বন্ধু’ পেয়েছিলেন যাত্রাপথে। যেমন অভিজিৎ মজুমদার। উল্টোডাঙার বাসিন্দা অভিজিৎ নিজের উৎসাহেই বহু দিন এঁদের সঙ্গে দেশের বিভিন্ন প্রান্তে ঘুরেছেন। প্রশিক্ষণে সাহায্য করেছেন। তাঁর কথায়, “লড়াই কাকে বলে, তাঁর জীবন্ত উদাহরণ এই প্রত্যেকটা মানুষ। যে কেউ ওঁদের দেখে উদ্বুদ্ধ হতে পারে। কিন্তু ওঁদের তো কেউ চেনেই না।”
সমস্যাটা ঠিক কোথায়? প্রাক্তন বাম মন্ত্রী তথা রাজ্য প্রতিবন্ধী ক্রীড়া সম্মিলনীর সাধারণ সম্পাদক কান্তি গঙ্গোপাধ্যায় স্বীকার করে নিচ্ছেন, তাঁদের আমলে প্যারা অ্যাথলিট নিয়ে সরকারি উদ্যোগে ঘাটতি ছিল। তাঁর কথায়, “ওদের জন্য মহকুমা বা জেলায় কমিটি থাকলেও তার কার্যকারিতা নেই। প্রতিযোগিতার সঙ্গে প্রশিক্ষণও প্রয়োজন। কেন্দ্রের থেকে সাহায্য পেলে ভাল হত। তবে আমরাও একটু ভাবতে পারতাম। সেটা হয়নি।”
আর এখন? রাজ্যের ক্রীড়ামন্ত্রী মদন মিত্রের কথায়, “আমাদের সাধ আছে, সাধ্য নেই। ভবিষ্যতে পরিকাঠামো তৈরির ভাবনা রয়েছে। এই অ্যাথলিটদের চাকরিতে বিশেষ কোটা থাকা জরুরি বলেও মনে করি। কিন্তু এখনই আশু সমাধান হাতে নেই।” লন্ডন যাওয়ার আগে রাজ্য ও দেশের প্যারালিম্পিক কমিটির সভাপতি সুলতান আহমেদ বলেন, “ক্রীড়া মন্ত্রককে বলেছি, খেলোয়াড় কোটার মধ্যেই যদি প্যারা অ্যাথলিটদের জন্য চাকরির ব্যবস্থা হয়। আশা করছি একটা সুরাহা হবে।”
কিন্তু কবে? উত্তর খুঁজে চলে ক্লান্ত চোখগুলো। যদি কোনও দিন...
২০০৩ প্যারালিম্পিক প্রস্তুতিতেই পায়ের পেশি ছিঁড়ে যায় সোমনাথের। শরীরে বাসা বাধে লিউকেমিয়া। কেন্দ্র বা রাজ্য কাউকে পাশে পাননি। তাঁর খেলার রেকর্ড দেখে মার্কিন একটি সংস্থা বিনামূল্যে ওষুধ পাঠায়। এর পরেও মালয়েশিয়া গিয়েছিলেন, কিন্তু অসুস্থ হয়ে জয়ের আশা ছাড়তে হয়। সরকারি চাকরির আশ্বাস ছিল, এখনও পাননি। তাই স্টেশন রোডে ডিম বেচে সংসার টানা বাবাকে সাহায্য করতে সল্টলেকে একটা কাজ জুটিয়েছেন।
সোমনাথ এখন রোজ সকালের রোদে ট্রেন ধরতে বেরোন। পুরসভার মাঠটা প্রশ্ন করে, ‘পারবি তো?’
ছায়া ভেসে যায়। উত্তর আসে না!

ছবি: সুদীপ ভট্টাচার্য, সুদীপ ঘোষ এবং শিলাদিত্য সাহা




First Page| Calcutta| State| Uttarbanga| Dakshinbanga| Bardhaman| Purulia | Murshidabad| Medinipur
National | Foreign| Business | Sports | Health| Environment | Editorial| Today
Crossword| Comics | Feedback | Archives | About Us | Advertisement Rates | Font Problem

অনুমতি ছাড়া এই ওয়েবসাইটের কোনও অংশ লেখা বা ছবি নকল করা বা অন্য কোথাও প্রকাশ করা বেআইনি
No part or content of this website may be copied or reproduced without permission.