হিংসুটে সায়েবগুলো ইচ্ছে করে সেই খেলাগুলো বাদ দিয়ে দেয়,
যাতে
বাঙালিরা দড়। অলিম্পিকে নতুন খেলার সাজেশন দিলেন
চন্দ্রিল ভট্টাচার্য |
ধর্ষণ এখন জাতীয় ক্রীড়া। মানে, বাঙালি জাতির নিত্যি চু-কিতকিত। সায়েবগুলো হিংসুকুটির ডিম, অলিম্পিকে ক্যাটিগরি-টাই রাখল না। অবিশ্যি হেদিয়ে খোলা স্টেডিয়াম আর সূর্যের বাপ ফ্লাডফ্লাডানি আলোর মধ্যে এ জিনিস জমেও না। এ খেলার ফার্স্ট রাউন্ডে কোঁত পেড়ে ফুটবে চাড্ডি মিটমিটে স্ট্রিটলাইট (‘ত্রিফলা’ হলে জম্পেশতর, ‘জ্বললে হবে, খরচা আছে’ টাইপ তাদের তে-এঁটে কার্পণ্য), অব্যর্থ তাক করে আধলা ছুড়ে প্রত্যেকটাকে ঠাটিয়ে ভাঙতে হবে (তিরন্দাজি ও শটপাটের বিবাহ), তার পর খেটে-পাওয়া ঝুঁঝকো আঁধারে খানপাঁচ মুশকো মিলে মেয়েটিকে ৩.৭ ডেসিবেল-ও বের করার সুযোগ না দিয়ে তারই শাড়ি দিয়ে মুখ-নাক আষ্টেপৃষ্ঠে পেঁচিয়ে, রিলে-রেসের ব্যাটন পাসাপাসি-র মতো ‘কাউন্টার-টা দিস’ মর্মে তীব্র বোঝাপড়ায় পৌরুষ-হুমহাম লাগু। আরও আঁকস্: শুধু টিমওয়ার্ক ও কোমর-ফিটনেসের ঘাগু ঢিচক্যাঁও নয়, ঘনঘটা-টি প্রাচ্যের, সুতরাং হাফ-গেরস্ত দর্শনমণ্ডিত: উল্লাস-কেরদানির পুরো সময়টায় খেলোয়াড়দের পাশে রমরমাবে পিনপিনে-মশাবৃত্তের ন্যায় বিধায়কের দল, যারা ক্রমাগত তালি মারতে মারতে ফুকারিবে: ‘রামায়ণ-মহাভারতের কাল থেকে এ সব হচ্ছে রে ভোলা, ইলিয়াড-ওডিসি-মোহিনীআট্টমের কাল থেকে এ সব চলেছে গো প্যালা, ইয়ার্কি না, দিস ইজ ফ্রম ইতিহাসের সকালবেলা!’ এবং ফাউ চাটনি: পাশেই দাঁড়িয়ে টিভি-ক্যামেরার পানে মুখ করে রসিয়ে রসিয়ে, শিকার-নারীর বিষয়ে কীর্তনাঙ্গে টোন কাটবেন এক মন্ত্রী-স্পেসিমেন, ধুয়ো: ‘মদ যদি অন হয়, ক্যারেক্টার তবে অফ, মেয়েটি তো মদ খাচ্ছিল, হবেই ক্যটাস্ট্রফ!’ (‘ফি’-র জায়গায় ‘ফ’-টা, ইয়ে, আর্ষ প্রয়োগ)।
|
এরই প্রায় দোসর খেলা, কিঞ্চিৎ লাইটওয়েট বিভাগে চালু: ছোট্ট পুল-কার-এর মধ্যে, ওই দামড়া দেড়-দু’খান সিট ও ব্যাগ-ওয়াটার বট্ল ঠাসাঠাসি সংকীর্ণ জায়গায়, শরীর দুরন্ত নৈপুণ্যে বেঁকিয়ে মুচড়ে, স্কুল-বালিকাকে আরামসে মোলেস্ট। এবং হ্যাঁ, গাড়ির পাশেই মোতায়েন থাকবে এক পুলিশ-পার্টনার, যাকে সাইডলাইন থেকে ক্রমাগত ছুড়ে যাওয়া হবে নানা সাইজের ডাইরি, কিন্তু সে কিছুতেই একটাও লুফবে না। ও, বলতে ভুলেছি, পুলিশের এই অ্যান্টি-লোফালুফি, কোলের লোপ্পা অভিযোগ ‘এইয্যাঃ’ মিস-এর ঝিংকুচাকু, আলাদা তুখড় ইভেন্ট হিসেবে উপস্থাপিত করার তক্ক চলছিল, কিন্তু প্রায় প্রতিটি বং-পুলিশ এতে অ্যায়সা ক্যালি ঝলকিয়েছেন (খুনের ডাইরি নেব না, ধর্ষণের ডাইরি নিতে এলে বলব, ‘এ মা রক্ত পড়ছে, বাড়ি গিয়ে পুঁছুন’, মেয়ের ইজ্জত বাঁচাতে গিয়ে মার-খাওয়া বাপ ডাইরি করতে এলে হিতোপদেশ ঝাড়ব, ‘নেহি করেয়া ফুত্তি নেহি খায়েগা চুল্লু, তো যুবসমাজ সন্ঝেবেলা কেয়া করেগা রে উল্লু’, বোটানিকাল গার্ডেনে সময় পেরিয়ে যাওয়ার পর জোর করে গাড়ি নিয়ে ঢোকার ডাইরি স্লিপারি হাতে ফেলে দিয়ে আঁতকাব ‘আমার ঘাড়ে কখান মাথা, এঁয়ার বাবা কাহার ভ্রাতা!’) কিছুতেই ছোট টিম নির্বাচন করা যাচ্ছে না। কুড়ি হাজার সমান দুর্ধর্ষ অ্যাথলিট, সব্বাই হিটে ফার্স্ট।
পরের খেলাটা হেভি সোজা। জোরসে অটো চালিয়ে একটা বাচ্চাকে খোয়া-ওঠা লেন-এ হিঁচড়ে নিয়ে যেতে হবে তেরো হাজার মিটার। বাচ্চাটা যত ছিঁড়েকুটে কেটে-ছেতরে যাবে, তত পয়েন্ট। একদম মরে গেলে, গোল্ড মেডেল। তবে খেলার আনুষঙ্গিক বখেড়া বহুত। বাচ্চাটার একটা হাত থাকবে মায়ের হাতে ধরা, ড্রাইভারটিকে হতে হবে ‘নভিস’ (এই ট্র্যাকে তিন মাসের বেশি প্র্যাকটিস করেনি, ট্রাফিক সিগন্যাল থেকে দেবব্রত ব্যারিটোনে দাবড়ে উঠলে হিসি করে ফ্যালে), সর্বোপরি, অটোয় থেবড়ে থাকবে আরও তিনটি প্যাসেঞ্জার, যারা গোটা সময়টা ঈশান নৈঋর্ত ও বায়ু কোণে তাকিয়ে প্রখর ভুরু মুচড়ে ভেবে চলবে শহিদ মিনারের ফ্রয়েডীয় গঠন বা রোববারের পাঁঠায় কত কিলো মটন। এখানেও উস্কানি-কোরাস: অটোর পাশে পাশে উদ্দাম ছুটবেন ইউনিয়নের কাঁড়ি নেতা, অনুনয় প্লাস থ্রেটের নাটকীয় মিশেলে মা’কে শেখাবেন এই সামান্য ব্যাপার নিয়ে নালিশমুখর না-হতে, কারণ নবীন প্রতিভাটির তাতে বিস্তর ক্ষেতি, তাকে হয়তো আর নেওয়াই হবে না বিপরীত ইউনিয়নের অটো-পোড়ানো, বা পুলিশ সার্জেন্ট ফাইন করলে দল বেঁধে উর্দিপাকা-কে বেধড়ক লাথানো ইত্যাকার প্রিয় ইভেন্টগুলোয়।
ওই যাঃ, শিক্ষিকাকে আটশো মিটার দূরে দাঁড় করিয়ে কপাল টিপ করে জলভর্তি জগ, পাঁচশো মিটার দূরে অবৈধ প্রণয়ীদের পাশাপাশি দাঁড় করিয়ে গলা টিপ করে জুতোর মালা (ব্যাকগ্রাউন্ডে সালিশি সভা-র উদ্দাম চিয়ারলিডিং), তিনশো মিটার দূরে একুশ হাজার কবি-শিল্পী-ফিলিমস্টারকে দাঁড় করিয়ে প্রত্যেকের বুকপকেট টিপ করে লাখ দুই টাকার চেক (সাপোর্ট-সংগীত: মোরা দেউ-দেউ-দেউলিয়া, শুধু কেউ কেউ পয়সা লিয়া), ট্রেনের কামরায় রানিং-এ উঠে পড়ে রিজার্ভড বার্থ থেকে অন্তঃসত্ত্বা পাবলিক’কে চোঁওও দরজার বাইরে টা-টা এ সব দুর্ধর্ষ ‘প্রোজেক্টাইল’ ইভেন্ট বলিনি বুঝি? আর বাঙালির টিপিনটাইমে ‘চোর-চোর’ খেলার তুলকালাম রূপান্তর? স্টার্টিং লাইনে উবু থাকবে পিলপিল রোগা হাবলা কৃষক। জার্সিতে লেখা ‘অনিচ্ছুক’। বারো মিটার সামনে তাদের জমি ফেরত-এর প্রতিশ্রুতি ডান বগলে চেপে দাঁড়িয়ে থাকবে চৌখস খেলুড়ের দল। বাঁশি বাজতেই শুরু পাঁইপাঁই দৌড়, হইহই ধেয়ে আসা কৃষকদের নাগাল এড়িয়ে, তেরোটি কারখানার খড়খড়ে গেটের হার্ডল পেরিয়ে, সাতাশিটি খুদে গাড়ির কঙ্কাল মাড়িয়ে, ঊনত্রিশটি ভুল ইংরিজিতে লেখা বক্তৃতার খসড়া ছাড়িয়ে, হাঁপাতে হাঁপাতে ফিনিশিং স্পটে। ন্না, এখেনে শেষ নয়, যে শালারা স্টেডিয়াম থেকে চেঁচিয়ে এতক্ষণ ঊনপাঁজুরে চাষাগুলোকে বাহবা দিচ্ছিল, প্রত্যেকটাকে স্পট করে চিল্লাতে হবে ‘এর প্রশ্ন মাওবাদী’, ‘এর যুক্তি মাওবাদী’, ‘এর পেছনপেঁয়াজি মাওবাদী’, ‘এর ইন্টেল-চুলকুনি মাওবাদী’, এবং হতভাগাদের চুলের মুঠি ধরে চোবাতে হবে বিশাল ধোবি-পাট গামলায়। আর শেষে, বিজয়োৎসব মানাতে স্টেডিয়াম খুলে দেওয়া হবে আমজনতার জন্য, সক্কলে কাছা খুলে নাচবে গাইবে মুম্বইয়ের হুপহুপ-নায়ককে ঘিরে ঝরাবে সম্মিলিত লাল, এবং উর্রে কী পোস্টমডার্ন মোচড়খেলোয়াড়দের তক্ষুনি উচ্চণ্ড আমোদগেঁড়ে ভিড়কে সামলানোর জন্য বনতে হবে দুঁদে ভলান্টিয়ার, কে ব্যাকসাইডে যাবে কে সাইডব্যাকেমাইকে নাগাড়ে ফরমাশ ঝাঁঝিয়ে ফেরাতে হবে শ্যামবাজার সর্বজনীন-তুতো মহাষ্টমী। উঁহু, মাল্টিথেলন-এ এখনও আসেনি বিশ্রামবেলা, সন্ধেয় বাকি আছে এই খেলার কার্টুন এঁকে কেউ ফেসবুকে চিমটি দিলে তুরন্ত তার কলার মুচড়ে কানের পাশে রদ্দা ও মুচলেকা-ডিকটেশন।
যারা নির্মল দুপুরে স্রেফ ধাঁইধপাধপ ছুট্টে বল্লম ছোড়ে ও তার দূরত্ব মাপতে দর্জির ফিতে নিয়ে মাটির ওপর ঝুঁকে পড়ে, তারা এ সব বহুমাত্রিক নটখটে খেলার মাহাত্ম্য বুঝবে ক্যামনে? আরে গেধো, মদীয় খেলায় বোনা আছে জিতা-জাগতা সময় সমাজের হৃৎড্যাব্লা ও কিডনি। মাটির গন্ধ ভি তীব্র হ্যাজ, বেশি কাছে নাক নিলে হেঁচে দিবি। ইন্ডিভিজুয়াল ঘোঁতঘোঁত নয়, এ খেলার প্রাণ: বিশাল নন-প্লেয়িং দোহার-ইউনিট, যারা স্ট্যান্ডে বসে গোড়ালি গরমায় না, বরং খেলুড়েদের কদমতালে ঢ্যাঁড়া পেটাতে পেটাতে, বল ব্যাট লকেট নেকলেস বুলেট চাক্কু হাতে হাতে জোগাতে জোগাতে, খেলার জন্ম দিতে দিতে, খেলাকে দুধ খাওয়াতে খাওয়াতে, খেলার গু-মুত পরিষ্কার করতে করতে, গোড়া থেকে শেষ অবধি লেপ্টেজুপ্টে থাকে। পাশ্চাত্যের একলসেঁড়ে নই, অনেক জল ছিটকিয়ে তবে পেছন ধুই, আমাদের ক্রীড়া-ফিক্সচারে নিপুণ পিকো করা রয়েছে গোষ্ঠীচেতনা না কী একটা দারুণ শক্ত টার্ম। যার শর্ট মানে হল: দশে মিলি মারি গোল, হারি জিতি হরিবোল। না না, সরি, ওর মানে: খেলা যে হাঁকড়ায় আর খেলা যে সহে, একই ট্রফির ছ্যাৎলা নিয়ে নাচবে শিয়ালদহে! বিলিতি মুখ্যুরা কিসু বোঝে না, অলিম্পিকে থোড়-বড়ি গতর-হুমহাম লাগিয়ে রেখেছে। কিন্তু নো ঘাবড়ানো, পৃথিবীর সব সিদ্ধান্তই টিভি-সাপেক্ষ। চলুন বং-খেলার ব্লুপ্রিন্ট সন্ধে সাতটার লাইভ তরজায় নিয়ে ফেলি। গবেট অ্যাংকর, সুন্দরী ফ্যাশন-ডিজাইনার, সবজান্তা নাট্যকার মিলে ঝিকিয়ে উঠুক জ্ঞানগত্ত। দেখি, অলিম্পিকের মেনু তৈরির বিচার-কমিটি কদ্দিন মুন্ডু ফিরিয়ে থাকে। অবিশ্যি, আজকাল তো আবার টাকায় বিচার কেনা যাচ্ছে! |