হ্যারি, ইংল্যান্ডের রাজপরিবারের ছেলে হোটেলে নগ্ন হইয়া কতিপয় বন্ধুবান্ধবীর সঙ্গে কেলি করিতেছিলেন, সে ফোটো সমক্ষে প্রকাশিত হইয়া পড়িয়াছে। ঘটনা কৌতুকপ্রদ, কিন্তু কিছু অস্বস্তিকর প্রশ্ন-উদ্রেককারীও বটে। প্রথম ভাবনা: হ্যারি নিশ্চয় স্থানটিকে নিরাপদ ভাবিয়া ও সঙ্গের পাত্রপাত্রীদিগকে প্রবল বিশ্বাস করিয়া খেলাধুলা করিয়াছিলেন। এত সহজেই সেই ভরসা ভঙ্গ করিয়া ছবিগুলিকে প্রকাশ্যে ছাপাইবার জন্য জোগান দেওয়া গেল? মানুষ যখন কাহারও সংসর্গে সম্পূর্ণ উন্মুক্ত, নিরাবরণ হয়, সেই ক্রিয়া এতটাই ব্যক্তিগত ও ঘনিষ্ঠ, যে তাহার মধ্যে একটি অলিখিত চুক্তি থাকে: ইহা আর কেহ জানিবে না। জানিলে, ওই ঘটনার আনন্দ ও পবিত্রতাই কিছুটা নষ্ট হইয়া যায়, গোপনীয়তার ঢাকনাটুকু খসিয়া পড়িয়া সেই সম্পূর্ণ সমর্পণ ও উদ্দাম সভ্যতা-বেতোয়াক্কা উৎসবকে অশালীন বেআব্রু করিয়া দেয়। হ্যারি অনেকের সঙ্গে নগ্নখেলা খেলিতেছিলেন বলিয়া তাঁহার ব্যক্তিগত-বৃত্তটি কোনও অংশে হীন ও খর্ব-মহিমা হইয়া যায় না, সেটিকে অসম্মান করার অধিকার কাহারও জন্মায় না। একটি বদ্ধ স্থানে বহু মানুষ যদি নগ্ন হইয়া মজা করেন, তাহা হাট-বাজারের কাণ্ডসুলভ কাদা-ছোড়াছুড়ির অনুমোদন পায় না, পরন্তু সেখানে বহু মানুষের ব্যক্তিগত পরিসর সম্পর্কে শ্রদ্ধাশীল হওয়ার বাড়তি দায়িত্ব অংশভাকদের বিবেকে ন্যস্ত হয়। যে যুগে মানুষের গূঢ়তম ক্রিয়া তাহার সম্মতি ব্যতিরেকে তাহার দেহ-দোসর আপলোড করিতেছে, হয়তো মানুষের প্রতি সত্যই বিশ্বাস হারাইবার লগ্ন আসিল।
পরের প্রশ্ন, জীবনের প্রতিটি মুহূর্ত মোবাইলের ছবি-ভাণ্ডারে যুক্ত করিবার এই উদ্ভট তথ্যচিত্রী-সুলভ দায় মনুষ্যজাতিকে আক্রমণ করিল কেন? দার্জিলিং যাইলে সে চক্ষু ভরিয়া নিসর্গ না অবলোকন করিয়া মোবাইল’কে তাবৎ সিনারি দেখায়, দুর্গাপূজার সময় অসামান্য প্রতিমাগুলির প্রতি এক বার মাত্র নেত্রপাত না-করিয়া, মোবাইল উচ্চে তুলিয়া অনবরত ক্লিক করে। এমন দিন দূরে নাই, যখন শুভদৃষ্টির সময় বর নিজে না তাকাইয়া মোবাইল তাক করিবে, এবং স্তম্ভিত হইয়া দেখিবে পর্দায় ভাসিতেছে আর এক মোবাইলের নিতম্ব (কারণ কনেও তো সমক্ষিপ্রতায় মোবাইল বাহির করিয়া প্রস্তুত!) ওই ছবিই তাহারা তৎক্ষণাৎ সোৎসাহে ছশো ছাব্বিশটি বন্ধুকে পাঠাইবে। আধুনিক মনুষ্য আচাভুয়া, বাস্তবের মোক্ষম ক্ষণগুলি যে বিনা ইন্দ্রিয়-উপভোগে জীবন হইতে চিরকালের জন্য হারাইয়া গেল, তাহাতে আক্ষেপ নাই, কেবল ভার্চুয়াল জীবনে সপ্রতিভ সাজিতে ফাল পাড়িতেছে। পাঁচশোটি কখনও না-দেখা ও কখনও দেখার সম্ভাবনা না-থাকা বায়বীয় বন্ধুর নিকট হইতে নিজের জীবনের প্রতি ক্ষণকে প্রত্যায়ন করাইয়া লইবার প্রবণতা কেন? না কি সে সত্যই মনে করে মোবাইল হইল মস্তিষ্কের দুরন্ত বিকল্প, ক্রম-উপচীয়মান ও অ-নির্ভরযোগ্য স্মৃতির কলসের বদলে সে সত্তর বৎসর বয়সে ছত্রিশ লাখ ডিজিটাল ছবির ‘বিজ্ঞানসম্মত’ অ্যালবাম ছড়াইয়া বসিবে?
শেষ চিন্তাটি স্বস্তির। এই পাইকারি ঘনঘটা চলিতে থাকিলে, অচিরেই ছবি-তোলা ও ফাঁস করিয়া দেওয়ার কাণ্ড সব অভিনবত্ব হারাইবে। প্রায় সব মানুষেরই নাক-খোঁটার ভিডিয়ো আন্তর্জালে সুলভ হইবে, আরশুলারা আর একটু প্রগতি লাভ করিলে বাথরুম হইতে প্রস্রাবদৃশ্যও আপলোড হইবে। নগ্নতা ও যৌনতা দেখিতে ভূগোল পড়িবার মতো হাই উঠিবে। ফলে, যখন মিডিয়া ও প্রযুক্তি এমন সর্বগ্রাসী ছিল না, মানুষ অপেক্ষকৃত নির্ভাবনায় নগ্নতা পরকীয়া বা গণযৌনতা উপভোগ করিতে পারিত সেই সময়ই খিড়কির দুয়ার দিয়া ফের উপস্থিত হইবে। শুধু তফাত হইবে কী? ক্যাবলা করণিক যদি পূর্বে বলিত, ‘জানিস, অ্যাঞ্জেলিনা জোলি-র সঙ্গে ইয়ে করলেম’, লোকে বলিত ‘ঢাহা গুল!’ তখন করণিকের হাতে স্পষ্ট ছবি দেখিয়া টুসকি মারিয়া বলিবে, ‘ফোটোশপ’! |