সাউথ সিটি আবাসনের সিসিটিভি ঘেঁটে পুলিশ জেনেছিল, বৃহস্পতিবার রাত পৌনে ১২টা নাগাদ রিসেপশনের রেজিস্টারে সই করে মুকুতা মুখোপাধ্যায় ভিতরে ঢুকেছিলেন। সেই রাতেই আবাসনের ছাদ থেকে ঝাঁপ দিয়ে আত্মঘাতী হন মুকুতা, তাঁর বোন খেয়া এবং মা অমিতা মুখোপাধ্যায়। কিন্তু শনিবার মুকুতাদের গাড়ির চালক পুলিশের কাছে দাবি করেছেন, অমিতাদেবী এবং খেয়া ওই দিনই তার আগে অন্তত চার বার ওই আবাসনে ঢুকেছিলেন।
চালকের দাবি যদি সত্য হয়, তবে কী ভাবে তা নজর এড়িয়ে গেল সকলের? আবাসনের রেজিস্টারেই বা সেই ঢোকা-বেরনো লেখা হয়েছে কি? সেটাই এখন খতিয়ে দেখছে পুলিশ। সেই সঙ্গে মুকুতার বাবার শেষকৃত্যের সময় যাঁরা সঙ্গে ছিলেন, তাঁদের সঙ্গেও কথা বলছে পুলিশ। যদিও তা থেকে মুকুতাদের মৃত্যুর ব্যাপারে এখনও উল্লেখযোগ্য কোনও সূত্র মেলেনি বলেই পুলিশ জানিয়েছে।
ওই গাড়িচালকের নাম প্রভাত কুণ্ডু। মুকুতাদের গাড়ির ভিতরে পাওয়া ‘ডিউটি স্লিপ’ থেকেই পুলিশ তাঁর সন্ধান পায়। প্রভাত পুলিশকে জানিয়েছেন, স্থানীয় একটি এজেন্সির মালিক শুধু বৃহস্পতিবারের জন্যই তাঁকে মুকুতাদের গাড়ি চালাতে বলেছিলেন। তিনি ওই দিন সকাল ৯টাতেই মুকুতাদের গল্ফ গ্রিনের বাড়িতে পৌঁছে যান। সেখান থেকে তাঁরা যান মুকুন্দপুরে একটি বেসরকারি হাসপাতালে। ওই হাসপাতালেই চিকিৎসাধীন ছিলেন মুকুতার বাবা নীহার মুখোপাধ্যায়। বুধবার সকালে মৃত্যু হয়েছিল নীহারবাবুর।
পুলিশ জেনেছে, মৃত্যুর পরে নীহারবাবুর দেহ আরও ২৪ ঘণ্টা হাসপাতালেই রাখার আর্জি জানিয়েছিলেন মুকুতারা। হাসপাতাল কর্তৃপক্ষ রাজি না হওয়ায় তাঁরা বলেছিলেন, আত্মীয়-স্বজনকে খবর দেওয়া হয়েছে। তাঁরা এলেই দেহ নিয়ে নেবেন। এর পরে মা ও দুই মেয়ে হাসপাতাল থেকে বেরিয়ে যান। বুধবার বিকেল সাড়ে ৪টে নাগাদ হাসপাতালের তরফে তাঁদের সঙ্গে মোবাইলে যোগাযোগ করা হয়। মুকুতা জানান, অন্ত্যেষ্টির জোগাড় নিয়ে ব্যস্ত আছেন। আরও কিছু ক্ষণ সময় লাগবে। সন্ধের দিকে ফের মুকুতাকে ফোন করা হলে তিনি জানান, বৃহস্পতিবার সকালের আগে তাঁরা দেহ নিতে পারবেন না।
কিন্তু ঘটনা হল, বৃহস্পতিবার সকালেও হাসপাতালে যাননি মুকুতারা। প্রভাতকে জেরা করে পুলিশ জেনেছে, বৃহস্পতিবার বাড়ি থেকে বেরিয়ে অমিতাদেবী ও তাঁর দুই মেয়ে আড়াই
ঘণ্টার মতো মুকুন্দপুরে ঘোরাঘুরি করলেও হাসপাতালে ঢোকেননি। প্রভাত পুলিশকে বলেছেন, মুকুন্দপুরে এক বয়স্ক ব্যক্তি ওই গাড়িতে এসে ওঠেন। বেলা সাড়ে ১২টা নাগাদ তাঁরা সাউথ সিটি আবাসনে আসেন। মুকুতা এবং তাঁর পরিচিত ওই ব্যক্তি গাড়ি থেকে নেমে একটি ট্যাক্সি ধরেন। প্রভাতের দাবি, যাওয়ার আগে মা-বোনকে মুকুতা জানিয়েছিলেন যে, তাঁরা কেওড়াতলা শ্মশানে যাচ্ছেন।
এর পরে অমিতাদেবী ও খেয়া গাড়ি নিয়ে আবাসনের ভিতরে ঢোকেন। প্রভাত পুলিশকে বলেছেন, সেই সময় তাঁরা মিনিট দশেক সাউথ সিটিতে ছিলেন। পৌনে ১টা নাগাদ বেরিয়ে তাঁরা গল্ফ গ্রিনের বাড়িতে ফিরে আসেন। বাড়ির সামনে গাড়ি লাগিয়ে ঘুমিয়ে পড়েন প্রভাত। পুলিশকে তিনি বলেছেন, দুপুর পৌনে ৪টে নাগাদ বাড়ি থেকে বেরিয়ে মা ও মেয়ে ফের সাউথ সিটিতে যান। আধ ঘণ্টা কাটিয়ে ফিরে আসেন গল্ফ গ্রিনে। রাত ৮টা নাগাদ ফের তাঁরা এক বার সাউথ সিটিতে যান। তখন খেয়ার হাতে বেশ কিছু ফাইল ছিল বলে পুলিশকে জানিয়েছে প্রভাত। ওই ফাইলেই ছিল রবীন্দ্রভারতীকে দান করা সম্পত্তির হিসেব, ব্যাঙ্কের পাশ বই এবং মৃত্যুর আগের বয়ান। জি এবং এইচ ব্লকের ৩৪ তলার সিঁড়ি থেকে পরে সেগুলিই উদ্ধার করে পুলিশ।
এত বার আবাসন চত্বরে গাড়ি নিয়ে ঢুকলেও অমিতাদেবীরা কোথায়, কার কাছে গিয়েছিলেন, তা পুলিশকে জানাতে পারেননি প্রভাত। তিনি দাবি করেছেন, প্রতি বারই তিনি এক নম্বর টাওয়ারের উল্টো দিকে গাড়ি রেখেছিলেন। সেখান থেকে আবাসনের ভিতরের অংশ দেখার সুযোগ নেই। প্রভাত পুলিশকে বলেছেন, রাত পৌনে ৯টা নাগাদ সাউথ সিটি থেকে বেরিয়েছিলেন অমিতাদেবী ও তাঁর মেয়েরা। শেষ বারের মতো তাঁরা আবাসনে আসেন রাত ১০টা নাগাদ।
প্রভাতের বক্তব্য অনুযায়ী, দুপুর বারোটা নাগাদ সাউথ সিটির সামনে নেমে মুকুতা এবং তাঁর পরিচিত ব্যক্তি ট্যাক্সি নিয়েছিলেন।
তার পর থেকে রাত দশটায় শেষ বারের মতো অমিতা-খেয়াকে সাউথ সিটিতে পৌঁছে দেওয়া পর্যন্ত মুকুতাকে তিনি আর দেখেননি। ওই ব্যক্তির পরিচয়ও এখনও জানা যায়নি। এই বয়ান অনুযায়ী, অমিতা-খেয়া নীহারবাবুর শেষকৃত্যেও উপস্থিত থাকেননি।
শ্মশানে তা হলে মুকুতার সঙ্গে কারা ছিলেন? নীহারবাবুর এক বন্ধুর খোঁজ পেয়েছে পুলিশ। তিনি পুলিশকে জানান, বৃহস্পতিবার বিকেলে ফোন করে মুকুতার তাঁর কাছে সাহায্য চেয়েছিলেন। তিনি শ্মশানে গিয়ে মুকুতার সঙ্গে দেখা করেন। মুকুতার সঙ্গে আরও চার-পাঁচ জন ছিলেন বলে জানিয়েছেন ওই ব্যক্তি। মুকুতা ওই পিতৃবন্ধুকে বলেন, শ্মশান থেকে বেরিয়ে তিনি সাউথ সিটি যাবেন।
শ্মশান থেকে বেরিয়েই কি মুকুতা সোজা সাউথ সিটি চলে গিয়েছিলেন? আবাসনের সিসিটিভি বলছে, রাত পৌনে ১২টা নাগাদ রিসেপশনের রেজিস্টারে সই করে আবাসনের ভিতরে ঢোকেন মুকুতা। রেজিস্টারে তিনি তাঁর সঙ্গে আরও দু’জন আছেন বলে লিখেছেন। টিভিতে তাঁকে একাই দেখা যাচ্ছে। পৌনে বারোটা পর্যন্ত মুকুতা কি সাউথ সিটিতেই কোথাও ছিলেন? এর মধ্যে কি অমিতা-খেয়ার সঙ্গে তাঁর দেখা হয়েছিল? কেন এত বার সাউথ সিটি আবাসনে গিয়েছিলেন অমিতাদেবী ও খেয়া? তাঁরা কি সপরিবারে আত্মঘাতী হওয়ার ‘উপযুক্ত’ স্থানের খোঁজে ছিলেন? উত্তর খুঁজছে পুলিশ।
প্রভাত বলেছেন, “রাত ১২টায় মুকুতা আমাকে ফোন করে বলেন, রাতের চালক না আসায় আমাকেই থাকতে হবে। আমি যেন রাতের খাবার খেয়ে নিই।’’ এর পরে প্রভাত বাইরে থেকে খেয়ে এসে চালকদের বিশ্রামঘরে শুয়ে পড়েন বলে জানিয়েছেন। প্রভাতের বয়ানের সত্যতা যাচাই করছে পুলিশ। তবে যুগ্ম সিপি (অপরাধ) পল্লবকান্তি ঘোষ বলেন, বয়ানে এখনও সন্দেহজনক কিছু তাঁরা পাননি। ময়না তদন্তের প্রাথমিক রিপোর্টেও মৃত্যুর কারণ হিসেবে উপর থেকে নীচে পড়ার কথাই বলা হয়েছে। শনিবার অঞ্জন চট্টোপাধ্যায় নামে মুকুতাদের এক দূর সম্পর্কের আত্মীয় তিন জনের দেহ সৎকারের জন্য নিয়ে গিয়েছেন। |