এক দিন রাতের বহরমপুরে। অন্য দিন দিনে দুপুরে। এক সপ্তাহে দু’বার শ্লীলতাহানির চেষ্টার অভিযোগ শুনে বহরমপুরের নাগরিক সমাজ উদ্বিগ্ন।
অথচ, কিছু দিন আগে পর্যন্ত বহরমপুরের আমজনতা এই শহরে ‘মেয়েরা সবচেয়ে নিরাপদ’ বলতে আত্মশ্নাঘা বোধ করতেন। শুক্র ও শনিবার পর পর দু’দিনের ঘটনার পরে এখন তা নিয়ে প্রশ্ন উঠে গিয়েছে।
শুক্রবার রাত ৯টা নাগাদ বহরমপুর স্টেশনে যাওয়ার পথে মিরমদন বাস টার্মিনাসের সুনসান রাস্তা দিয়ে এক দম্পতি হেঁটে খাগড়া ষষ্ঠীতলার বাড়িতে ফিরছিলেন। সেই সময়ে উল্টো দিক থেকে আসা কয়েক জন যুবক তাঁদের উত্ত্যক্ত করতে থাকে। মহিলার উদ্দেশ্যে কটূ কথা বলা হয়। মহিলার স্বামী প্রতিবাদ করলে ওই যুবকেরা তাঁকে ধরে পেটাতে শুরু করে। সেই দেখে স্বামীকে বাঁচাতে গেলে আহত হন চার মাসের অন্তঃসত্ত্বা ওই মহিলা। পরে খবর পেয়ে পুলিশ ঘটনাস্থলে পৌঁছে দু’জনকে গ্রেফতার করে। ওই ঘটনার ২৪ ঘন্টার মধ্যেই শনিবার দুপুরে স্কুল ছাত্রীদের সঙ্গে ‘আপত্তিকর’ আচরণ করায় গ্রেফতার করা হয় ভ্যান ‘কাকু’-কে। যার ভরসায় স্কুলে পাঠাতেন বাবা-মা, সেই ভ্যান চালক ‘কাকু’ই দিন কয়েক ধরে তাদের কাছে ‘আতঙ্ক’-এর কারণ হয়ে উঠেছিল। শেষ পর্যন্ত স্কুল কর্তৃপক্ষকে সব লিখিত ভাবে জানানো হয়। পরে থানায় লিখিত অভিযোগ হলে গ্রেফতার হয় ওই ভ্যান চালক।
খবর দু’টি জেনে ভীষণ ‘অসহায়’ বোধ করতে থাকেন প্রবীণ শিক্ষক বিজয় বন্দ্যোপাধ্যায়। তিনি বলেন, “আমার এই চেনা শহর কেমন যেন পাল্টে গিয়েছে ভেবে অসহায় বোধ করছি। কিন্তু মেয়েদের কাছে সবচেয়ে বেশি নিরাপদ ছিল এই শহরই। বহরমপুর স্টেশন থেকে কলকাতা থেকে একা একা রাতের অন্ধকারে বাড়ি ফিরেছেন মেয়েরা। কখনও কিছু হয়নি।” তাঁর কথায়, “অল্পবয়সী ছেলেরা অনেকে ভীষণ বেপরোয়া। তারা কোনও কিছুই মানতে চাইছে না। তাদের চাল-চলন, মুখের ভাষা, কাউকে গ্রাহ্য না করার মনোভাব দেখে আমি হতাশ। তারা যে ভাষায় কথা বলে, তাতে ছাত্রসুলভ কোনও আচরণ প্রকাশ পায় না। ভাগ্যিস আমি ২২ বছর আগে অবসর নিয়েছি। নয়তো শিক্ষক হিসেবে প্রতি দিন এদের মুখোমুখি হতে হত!”
মহাকালী পাঠশালার প্রধান শিক্ষিকা নন্দিনী দাশগুপ্ত বলেন, “আমার মেয়ের কথা, ছাত্রীদের কথা, বাইরে থেকে পড়তে আসা মেসের মেয়েদের কথা ভেবে আমি আতঙ্কিত বোধ করছি। কিছু দিন আগেও মেয়ে গৃহশিক্ষকের কাছ থেকে বাড়ি ফিরতে দেরি করলেও নিশ্চিন্তে থাকতাম। তবে কড়া প্রশাসনিক পদক্ষেপ গ্রহণ না করলে ওই ঘটনার প্রতিকার সম্ভব নয়।” সমাজকর্মী সীমা সরকার বলেন, “আমার শহর এখনও নিরাপদ, সেটা বিশ্বাস করি। তবে রাজ্যের অন্য জায়গায় যে ধরনের ঘটনা শুনতে পাচ্ছি, তাতে আমরা আতঙ্কিত। শহরের ওই দু’টি ঘটনার মধ্যে দিয়ে তার আভাসও পাচ্ছি। রাজ্যে এখন মেয়েরা তো নিরাপত্তাহীনতায় ভুগছে। যদি বহরমপুরেও শুরু হয়, তার চেয়ে দুঃখের কিছু হবে না।” সীমাদেবী বলেন, “এমনও হয়েছে দোলের দিন রাতের অন্ধকারে বহরমপুর স্টেশনে নেমে নিশ্চিন্তে বাড়ি ফিরেছি। এখনও শহরের বিভিন্ন প্রান্তে সাইকেলে-মোটরবাইক চালিয়ে কিশোরী-তরুণীরা উড়ে বেড়ায় দেখে ভাল লাগে। তাই বহরমপুরের যে সমস্ত রাজনৈতিক নেতৃত্বের কারণে এত দিন বহরমপুর শহর নিরাপদ ছিল, যাঁদের উপরে ভরসা রয়েছে মানুষের, আমি চাই তাঁরা এগিয়ে আসুন। পুলিশ ও প্রশাসন কিন্তু সব দায়িত্ব সঠিক ভাবে পালন করতে পারছে না।”
লালদিঘির বাসিন্দা মালঞ্চ রায়চৌধুরী বলেন, “ওই দুটি ঘটনা জানার পরেই কলেজ পড়ুয়া আমার মেয়ের কথা ভেবে চিন্তিত। এখন সন্ধ্যার পরে বাড়ি ফিরতে রাত করলেই চিন্তা হচ্ছে, যা আগে কখনও হয়নি। তার উপরে মোবাইল ফোন বন্ধ থাকলে রক্তচাপ বেড়ে যাওয়ার উপক্রম হয়। বাড়ি না ফেরা পর্যন্ত ঘর-বারান্দা করতে থাকি।”
কিন্তু এটাও তো ঠিক যে, প্রথম দিনের ঘটনায় শহরের ছেলেরাই এগিয়ে এসে আক্রান্ত দম্পতিকে আড়াল করেছিলেন। মধপুরের এক ক্লাব কর্তা তোতন পাণ্ডে বলেন, “পাড়ার ছেলেদের চরিত্রের মধ্যে অদ্ভূত বৈপরীত্য রয়েছে। বে-পাড়ার কেউ এসে পাড়ার মেয়েদের উত্ত্যক্ত করলে তারা সামলায়। আবার তারাই অন্য পাড়ায় গিয়ে ভিলেন হয়ে যায়। তবে কোনও ক্লাব-কর্তৃপক্ষ ওই ধরনের ছেলেদের সদস্য করে না। মধুপুর জামতলার যারা ওই ঘটনার সঙ্গে জড়িত তারা কিন্তু এলাকার কোনও ক্লাবের সঙ্গে জড়িত নয় বলেই জেনেছি।” |