বহুতলে ‘আত্মহত্যা’
নিছক অবসাদ থেকেই কি সমবেত আত্মহনন
ক জন পরিবেশকর্মী। এলাকায় ‘সবুজ বাঁচাও-পুকুর বাঁচাও’ আন্দোলনের নেতৃত্ব দিতেন। অন্য জন বৃদ্ধা গৃহবধূ। তৃতীয় জন টেবিল টেনিসের শিক্ষিকা। একই পরিবারের সদস্য হলেও তিন জন পৃথক বৃত্তের মানুষ। কিন্তু নিজেদের অন্তিম পরিণতিটা বেছে নিলেন একই সঙ্গে, একই ভাবে।
প্রশ্ন উঠেছে, তিন পৃথক অবস্থানের মানুষ এমন একটা সিদ্ধান্তের ক্ষেত্রে একজোট হলেন কী ভাবে?
সাধারণ ভাবে আত্মহত্যার সিদ্ধান্তকে তাৎক্ষণিক বলে অনেকে মনে করলেও মনোবিদেরা বলছেন, বেশির ভাগ আত্মহত্যাই সুপরিকল্পিত। এ ক্ষেত্রেও হয়তো সেটাই হয়েছে। সম্পত্তি হস্তান্তরের ব্যাপারে রবীন্দ্রভারতী বিশ্ববিদ্যালয়ের সঙ্গে কথা বলা থেকে শুরু করে শহরের বহুতল বাড়িগুলির তালিকা তৈরি করা (তালিকায় থাকা একটি বহুতল থেকেই ঝাঁপ দেন তাঁরা), গাড়ি চালিয়ে একটি বহুতলে পৌঁছনো, তার পরে প্রায় আড়াই ঘণ্টা ধরে অপেক্ষা এবং শেষমেশ তিন জনের ঝাঁপ দেওয়ার যে বিবরণ পুলিশ অফিসারেরা দিয়েছেন, তা থেকে এমন সিদ্ধান্তে পৌঁছনোই যায় বলে মনোবিদদের অভিমত।
প্রাথমিক ভাবে পুলিশের তদন্তকারী অফিসারদের অনুমান, মা অমিতা এবং বোন খেয়াকে সঙ্গে নিয়ে সাউথ সিটি আবাসনের ৩৫ তলার ছাদ থেকে লাফিয়ে পড়ে আত্মহত্যা করেছেন পরিবেশকর্মী মুকুতা মুখোপাধ্যায়। প্রশ্ন উঠছে, যে ভাবে ঠান্ডা মাথায়, পরিকল্পিত ভাবে নিজেদের পরিণতি স্থির করে নিয়েছিলেন ওঁরা, মানসিক অবসাদ থাকলে আদৌ কি তা সম্ভব? নাকি অবসাদ গভীর থেকে গভীরতর হলে তবেই পৌঁছনো যায় এমন অবস্থায়?
মনোরোগ চিকিৎসক জ্যোতির্ময় সমাজদারের মতে, তাৎক্ষণিক আবেগজনিত আত্মহত্যার কিছু সিদ্ধান্ত বাদ দিলে বেশির ভাগ আত্মহত্যার সিদ্ধান্তই সুপরিকল্পিত। তিনি বলেন, “যাঁরা সিদ্ধান্ত নেন, তাঁদের কাছে তো ওটা মুক্তির পথ। শান্তির জায়গা। তাই এক বার সিদ্ধান্তটা নেওয়ার পরে ওঁরা মানসিক ভাবে অনেকটাই হাল্কা হয়ে যান।”
কিন্তু একা নয়, পরিবারের অন্যদের সঙ্গে নিয়ে এমন একটি সিদ্ধান্ত আবেগের বশে কেউ যদি নিয়েও ফেলেন, কিছু সময় পেরোনোর পরে সেটা কি বদলানোর সম্ভাবনা তৈরি হয় না? জ্যোতির্ময়বাবুর ব্যাখ্যা, “হয়তো হয় না। কারণ, এ ক্ষেত্রে সাধারণ ভাবে পরস্পরের মধ্যে মানসিক যোগ এমনই নিবিড় হয় যে, এক জন সিদ্ধান্তটা নিলে অন্যেরাও তাতে প্রভাবিত হন। তাই কারও মনে পরিবর্তনের চিন্তা এলেও তিনি সেটাকে আমল দেন না।”
মনোবিদ উশ্রী বন্দ্যোপাধ্যায়ের মতে, “মানসিক ভাবে স্বাবলম্বী ছিলেন না ওঁরা কেউই। বাবার মৃত্যু এবং বৃদ্ধা মা-ও যে কোনও সময় চলে যাবেন, এই আশঙ্কা দুই বোনকে আরও একাকিত্বের দিকে ঠেলে দিয়েছিল। হয়তো সেই কারণেই এক জনের মৃত্যুর পরে অন্যেরাও জীবন থেকে নিজেদের সরিয়ে নিতে চেয়েছেন। সুখ-দুঃখ ভাগ করে নেওয়ার পাশাপাশি অবসাদটাও ভাগ করে নেওয়ার এমন প্রবণতা অনেকের মধ্যেই দেখা যায়।”
গল্ফগ্রিনের ৪এ ফেজের অধিকাংশ বাসিন্দাই মুকুতা মুখোপাধ্যায়কে এক ডাকে চিনতেন। বেহালা ক্লাব থেকে এক হাজার ঘণ্টা বিমান চালানোর অভিজ্ঞতাও ছিল তাঁর। পরিবেশ আন্দোলন নিয়ে মন্ত্রী থেকে উচ্চপদস্থ আধিকারিক সবার সঙ্গেই নিজের যুক্তি নিয়ে লাগাতার লড়াই চালিয়েছেন তিনি।
‘ফ্রেন্ডস অফ দ্য নেচার’ সংস্থার একাধিক সদস্য জানিয়েছেন, মাস চারেক ধরে পরিবেশ সংক্রান্ত আন্দোলনের নানা পরিকল্পনা সংক্রান্ত বৈঠকে অনুপস্থিত থাকছিলেন মুকুতা। এ নিয়ে প্রশ্ন করায় তিনি সকলকে বাবার অসুস্থতার কথা বলেছিলেন।
মনোবিদ নীলাঞ্জনা সান্যালের মতে, “স্বামী বা বাবা ছিলেন জীবনের খুঁটি, সেই খুঁটি নড়ে যাওয়ার পরে তাঁদের সব কিছুই আলগা হয়ে যায়। এর পিছনে বাস্তববোধের অভাবের পাশাপাশি বড় কোনও সমস্যাও থাকতে পারে। ওই ভদ্রলোকের মৃত্যুর পরে যেটা প্রকট হয়ে ওঠার আশঙ্কা ছিল ওই তিন জনের মনে। সেই আশঙ্কা থেকেই ওঁরা জীবনে দাঁড়ি টানতে চেয়েছেন।”
ওই চার জনের নিজস্ব বৃত্তের বাইরে আর কারও সঙ্গে কি সুখ-দুঃখ ভাগ করে নেওয়ার মতো সম্পর্ক ছিল না? নীলাঞ্জনাদেবীর মতে, “তাঁদের অবসাদের বিষয়টি কেউ সত্যিই বুঝতে পারেননি, নাকি বুঝেও বুঝতে চাননি, সেটাই ধোঁয়াশা। বর্তমান সামাজিক পরিকাঠামো হয়তো কম-বেশি সকলকেই এ ভাবে একা করে দিচ্ছে।”
 
 
 


First Page| Calcutta| State| Uttarbanga| Dakshinbanga| Bardhaman| Purulia | Murshidabad| Medinipur
National | Foreign| Business | Sports | Health| Environment | Editorial| Today
Crossword| Comics | Feedback | Archives | About Us | Advertisement Rates | Font Problem

অনুমতি ছাড়া এই ওয়েবসাইটের কোনও অংশ লেখা বা ছবি নকল করা বা অন্য কোথাও প্রকাশ করা বেআইনি
No part or content of this website may be copied or reproduced without permission.