৩৩ বছরের চাকরি জীবনে কখনও বুক কাঁপেনি শঙ্কর রাউতের। দেশের প্রথম সারির মন্ত্রী, একাধিক রাজ্যের মুখ্যমন্ত্রী, শীর্ষ স্তরের আমলা, টলিউড, বলিউডের প্রথম সারির চিত্রতারকাদের মুখোমুখি হয়ে আপ্যায়ন করেছেন একেবারে স্বাভাবিক ভাবে। কিন্তু, চাকরি থেকে অবসর গ্রহণের দুদিন আগে বিমনবন্দরের অধিকর্তার প্রস্তাব শুনে বুকটা কেঁপে উঠেছিল শঙ্করবাবুর। তাঁর মতো একজন ‘সামান্য মানুষকে’ সরকারি-বেসরকারি যৌথ উদ্যোগের অনুষ্ঠানের ফিতে কাটতে হবে! প্রথমে বিশ্বাসই করতে পারেননি। কিন্তু, শেষ পর্যন্ত বেসরকারি ব্যাঙ্কের শীর্ষ কর্তা, কেন্দ্রীয় সরকারের পদস্থ আমলা, আধা সামরিক বাহিনীর দুঁদে অফিসারের সামনে দাঁড়িয়ে ফিতে কাটতে গিয়ে চোখ ভিজে উঠল তাঁর। হাততালিতে ফেটে পড়ল চারদিক। বুধবার দুপুরে এমন ঘটনার সাক্ষী থাকল শিলিগুড়ির বাগডোগরা বিমানবন্দর। সেখান অফিসার-কর্মীরা তো বটেই, সেখানে ভিড় করে থাকা ট্যাক্সি চালক, পুলিশ, আধা সামরিক বাহিনীর জওয়ানরা (যাঁরা পেশার সূত্রে ওই এলাকাতেই থাকেন) প্রথমে অবাক হয়ে গিয়েছিলেন। কারণ, এয়ারপোর্ট অথরিটি অব ইন্ডিয়ার বাগডোগরার অধিকর্তা কল্যাণ কিশোর ভৌমিক সহ অন্যান্য পদস্থ কর্তারা যেখানে উপস্থিত, সেখানে বিমানবন্দরের চতুর্থ শ্রেণির প্রৌঢ় কর্মীটি কেন কাঁচি হাতে বেসরকারি ব্যাঙ্কের এটিএম কাউন্টারের উদ্বোধন করতে এগোচ্ছেন? অবশেষে সকলে যখন দেখলেন, শঙ্করবাবুকে দিয়ে এটিএমের উদ্বোধন করিয়ে তাঁকে অবসরগ্রহণের দুদিন আগে ‘বিশেষ সম্মান’ জানানোর কথা যখন ঘোষণা হল, তখনই হাততালি, হর্ষধ্বনিতে ভেসে গেল বিমানবন্দরের চৌহদ্দি। |
দেখে নেওয়া যাক শঙ্করবাবুর বায়ো ডেটা, অন্য কর্মকাণ্ড।
বাগডোগরার বাসিন্দা শঙ্করবাবু স্কুলের চৌকাঠ পেরোনেনি। বাবা চাকরি করতেন এয়ারপোর্ট অথরিটি অব ইন্ডিয়ায়। অস্থায়ী হিসেবে বাগডোগরা বিমান বন্দরে চতুর্থ শ্রেণির কর্মী হিসেবে যোগ দেন। ছুটি থাকলেও অফিসে আসা, মুখ বুজে পরিশ্রম করার সুবাদে মন কেড়ে নেন সকলেরই। ধীরে ধীরে স্থায়ী কর্মী হন। ধীরে ধীরে বাগডোগরা বিমানবন্দরের ‘ভিআইপি’দের আপ্যায়ানের মূল দায়িত্ব পান তিনি। বিমানবন্দরের অফিসার-কর্মীরা জানাচ্ছেন, কেন্দ্রীয় মন্ত্রী থাকাকালীন প্রিয়রঞ্জন দাশমুন্সি বাগডোগরায় পৌঁছেই ‘শঙ্কর কোথায়’ বলে কাছে ডেকে নিতেন। সিকিমের মুখ্যমন্ত্রী পবন চামলিং ও তাঁর পরিবারের লোকজনের কাছে ‘শঙ্কর তাজু’ হল ঘরের লোক। বর্তমান মুখ্যমন্ত্রী মমতা বন্দ্যোপাধ্যায় তাঁকে ‘ভাই’ বলে ডেকে থাকেন। নিজে পড়াশোনা করতে পারেননি। তা বলে ছেলেমেয়ের পড়াশোনায় খামতি রাখেননি শঙ্করবাবু ও তাঁর স্ত্রী। ৩ মেয়ে, ১ ছেলের সকলেই উচ্চ শিক্ষিত। ১ মেয়ে বিমানবন্দর কর্তৃপক্ষের অধীনেই কর্মরতা। এক মেয়ে শিক্ষিকা। আরেক মেয়ে গৃহবধূ। একমাত্র ছেলেও শিক্ষকতা করেন। মৃদুভাষী হিসেবে পরিচিত শঙ্করবাবু এদিন আবেগপ্রবণ হয়ে অনেক কথাই বললেন। তাঁর কথায়, “সারা চাকরি জীবন আমি ভিভিআইপি, ভিআইপিদের আপ্যায়নের চেষ্টা করেছি। সেটাই আমার কাজ। অবসরের দুদিন আগে আমাকে দিয়ে এটিএম উদ্বোধনের প্রস্তাব শুনে সত্যি বলতে কী ঘাবড়ে গিয়েছিলাম। অনেক নেতা-মন্ত্রী আমাকে ভালবাসেন। মনে রাখেন। কিন্তু, এটা আমার জীবনে পাওয়া অন্যতম সেরা সম্মান।” এমন একজন ‘কাজ-পাগল’ মানুষকে দিয়ে এটিএম উদ্বোধন করাতে পেরে উচ্ছ্বসিত বেসরকারি ব্যাঙ্কের শিলিগুড়ির আঞ্চলিক অধিকর্তা জয়দীপ বসু। তাঁর কথায়, “শিলিগুড়ি ও লাগোয়া এলাকায় আমাদের ২৫টির বেশি এটিএম আগেই চালু হয়েছে। এবার বাগডোগরায় এটিএম চালু হল। এটা অবশ্যই মনে রাখার মতো ঘটনা।” বিমানবন্দরের বাইরে ট্যাক্সি চালক, এজেন্টদের অনেকেই এ দিন শঙ্করবাবুর সঙ্গে হাত মিলিয়ে অভিনন্দন জানিয়েছেন। সারা জীবন যিনি ‘ভিআইপি’ সামলেছেন, চাকরির মেয়াদ ফুরোনোর ৪৮ ঘণ্টা আগে তাঁকে কয়েক মুহূর্তের জন্য হলেও ‘ভিআইপি’-র মর্যাদা দিতে পেরে গর্বিত এএআইয়ের অফিসার-কর্মীদের অনেকেই। তাঁদের অনেকেই বললেন, “অবসরের পরে ওঁকে চুক্তিতে রেখে দেওয়া যায় কি না তা ভেবে দেখার জন্য ঊর্ধ্বতন কর্তৃপক্ষকে অনুরোধ করা হবে।” বিমানবন্দরের এক শীর্ষ কর্তাকে ওই অনুরোধ শোনার পরে বলতে শোনা গেল, “শঙ্কর, রবিবার মুখ্যমন্ত্রীর মমতা বন্দ্যোপাধ্যায় বাগডোগরা হয়ে কলকাতা ফিরবেন। অবসর নিলেও ওই দিন একটু এসে কাজ করে দিয়ো।” |