এসেছিলেন রাষ্ট্রপতি প্রণব মুখোপাধ্যায়ের হাত থেকে দেশের সর্বোচ্চ ক্রীড়া সম্মান রাজীব খেলরত্ন নিতে। চোখেমুখে বিস্ময়ের ঘোর মেখে ফেরত গেলেন রুপোলি পর্দার নায়ক হওয়ার প্রস্তাব পেয়ে!
এমন দুরন্ত চমক তাঁর জন্য অপেক্ষা করে ছিল, কল্পনাও করতে পারেননি অলিম্পিকের রুপোজয়ী শ্যুটার বিজয় কুমার।
অন্ধ্রপ্রদেশের এক চিত্র পরিচালক বিজয়কে একটি তেলুগু ছবিতে অভিনয় করার প্রস্তাব দিলেন এ দিন। রাইফেল হাতে শত্রু নিধনে নামা হিরোর চরিত্র। “পরিচালকের সঙ্গে প্রাথমিক কথাবার্তা হয়েছে। কিন্তু আমি তো সেনা অফিসার। আগে এ ব্যাপারে সেনাবাহিনীর অনুমতি নেওয়া দরকার,” কথাগুলো বলার সময় বোঝা যাচ্ছিল, ক্যামেরার সামনে নামার চিন্তায় অ্যাডভেঞ্চারের গন্ধ পাচ্ছেন শ্যুটার। “জীবনে কখনও অভিনয় করিনি। তবে বিজ্ঞাপনের প্রস্তাব হয়েছে,” সলজ্জ স্বীকারোক্তি রুপোজয়ীর। দিল্লির এক পাঁচ তারা হোটেলে বিজয়ের সঙ্গে যখন এই আড্ডা চলছে, তখন পাশে বসে বাংলার আর এক সর্বকালের সেরা শ্যুটার জয়দীপ কর্মকার। যিনি আজ রাস্ট্রপতির হাত থেকে অজুর্ন পুরস্কার নিলেন। |
অলিম্পিক সাফল্যের পরেও তাঁকে যোগ্য পদ দেওয়া হচ্ছে না বলে সেনাবাহিনী ছাড়ার হুমকি দিয়েছিলেন ডোগরা রেজিমেন্টের ১৬ নম্বর ব্যাটেলিয়ানের কর্মী। তাতে সুবেদার থেকে মেজর হয়েছেন। কিন্তু বিজয় চান আই এ এস পর্যায়ের পদ। “আমি চাই অন্য সব সরকারি অফিসের মতো সেনাবাহিনীতেও এটা চালু হোক। আমি দাবি তুলেছিলাম সবার জন্য। একা আমার জন্য নয়। সেনাবাহিনীর উপর ক্ষোভ নেই। আমার ক্ষোভ কিছু সরকারি আমলার উপর।”
হিমাচল প্রদেশের হারশৌর গ্রামের ছেলে শৈশবে কখনও রাইফেল ধরেননি। ছুঁয়েও দেখেননি বাবা, সুবেদার বাঁকুরামের রাইফেলটা। তবে ১৯ বছর বয়সে সেনাবাহিনীতে ট্রেনি হিসাবে যোগ দেওয়ার পরই জীবনের মোড় ঘুরে যায় আজকের মহানায়ক ‘ক্রোড়পতি’র।
ভারী মজাদার ছেলে বিজয়। ভীষণ মিশুকে। কথা বলার সময় চোখ দু’টো অদ্ভুত রকম স্থির থাকে। আর চিকচিক করে। বলছিলেন, “সেনা-ট্রেনিংয়ে রাইফেলে আমার লক্ষ্যভেদ দেখে কয়েক জন মেজর আমাকে পাঠিয়ে দেন মধ্যপ্রদেশের মুহুর মার্কসম্যানশিপ ইউনিটে। সেখানেই প্রথম পিস্তল ব্যবহার করা শুরু করি।”
আর পিছন ফিরে তাকাতে হয়নি। আট বছরের মধ্যে কমনওয়েলথ, এশিয়াড, বিশ্বকাপে সোনা-রুপো জেতার পর লন্ডনে ২৫ মিটার র্যাপিড ফায়ার পিস্তলে রুপো! অলিম্পিকে শেষ রাউন্ডের আগে বিজয়ের গুলি ফুরিয়ে যাওয়ায় পাশের রেঞ্জে চতুর্থ হওয়া জয়দীপ কর্মকারের কাছ থেকে গুলি ধার করে এনেছিলেন কোচ। জয়দীপ বলছিলেন, “সবার কথা মাথায় রেখেই বলছি, বিজয় আমার দেখা সেরা ভারতীয় শু্যটার। ওর মতো ডেডিকেশন থাকলে যে কেউ পদক পেয়ে যবে।”
সেনা-কর্মী কখনও যুদ্ধে যাননি। কিন্তু অলিম্পিক-যুদ্ধ জেতার পর যখন জাতীয় পতাকাটা উঠছিল তখন কেমন যেন একটা উত্তেজনা হচ্ছিল সারা শরীর জুড়ে। “ক্রিকেটে যতই ট্রফি আসুক, এটা ধোনি-সচিনরা কখনও অনুভব করবে না। অলিম্পিক অলিম্পিকই।” বিজয় রুপো জেতার পর ধোনি টুইট করেছিলেন, “অলিম্পিকে একটা রুপো তা হলে এল।” সেটা এক বন্ধু দেখিয়েছিলেন বিজয়কে। “আরে যারা কখনও অলিম্পিকে নামেনি তারা এর মর্ম কী বোঝে? ক্রিকেটাররা জানে না একটা পদকের জন্য কত পরিশ্রম করতে হয়,” বলছিলেন বিজয়। অত্যন্ত ঠান্ডা মাথার ছেলে কিন্তু অন্য খেলাধুলার সফলদের মতোই রাগ ক্রিকেটের উপর। হাসতে হাসতে রুপোজয়ী অলিম্পিয়ান বললেন, “এক বছর খেলাটা টিভিতে বন্ধ করে দিক সরকার। দেখবেন হাল কী হয়।”
বিজয়ের পরের লক্ষ্য, কলা বিভাগে স্নাতক হওয়া। সামনেই পরীক্ষা। এবং চান ফের কমনওয়েলথ গেমসে পদক জিততে। ২০০৭-এ অর্জুন, পাঁচ বছর পর আজ আবার রাস্ট্রপতি ভবনে। বলছিলেন, “সামনে কমনওয়েলথ গেমস। তারপর এশিয়াড। অল্পের জন্য অলিম্পিকের সোনা হাতছাড়া হল। পরের বার দেখব।” এখন বয়স ২৭। শু্যটিং চালিয়ে যেতে চান ৫০ বছর পর্যন্ত। ঠিক করেছেন দু’তিন বছরের মধ্যেই বিয়ে করবেন। পাত্রীর খোঁজ চলছে।
ইতিমধ্যেই হিমাচল প্রদেশ সরকার বিজয়কে দিয়েছে এক কোটি টাকা। রাজস্থান সরকার ৫০ লাখ। ২৫ লাখ রাইফেল অ্যসোসিয়েশন। একটি সোনার দোকান দিয়েছে তিন কিলো সোনা। প্রতিদিন ভাসছেন সংবর্ধনা আর পুরস্কারে। কিন্তু নিজের লক্ষ্য থেকে সরে আসতে রাজি নন। “এখনও কিছুই করিনি। আরও অনেক কিছু করতে হবে।’ শান্ত স্বভাবের বিজয়ের মুখ থেকে বেরিয়ে আসে জেদ আর তাগিদ। |