এত দিন এই লড়াইয়ে শেষ পর্যন্ত দেখা যেত, রাষ্ট্রমেব জয়তে।
শেষ পর্যন্ত সে ছক ভাঙল বলিউড। একটি নতুন ছবি দেখলেন শিলাদিত্য সেন |
মহা ঝকমারিতে পড়েছেন কবীর খান। তাঁর এক থা টাইগার ছবিটা দেখে বেরিয়ে লোকজন তাঁকে এসে শুধোচ্ছে: ‘‘কী ব্যাপার বলুন তো? একটা হাড্ডাহাড্ডি ‘অ্যাকশন’ ছবি দেখব বলে এলাম, ওমা! এ যে দেখি ‘লাভ স্টোরি’।” পাবলিক’কে দোষ দেওয়া যায় না, বলিউডই আমাদের এমন প্রত্যাশা তৈরি করে দিয়েছে। এবং শেষ পর্যন্ত বলিউডই ভাঙছে তার ছক। কেবল ‘লাভ’ বনাম ‘অ্যাকশন’ নয়, ভালবাসা বনাম রাষ্ট্র।
নব্বইয়ের দশকটা বেশ মনে আছে, গোড়ার দিকে বাবরি মসজিদ ধ্বংস, আর শেষের দিকে কারগিল যুদ্ধ। ব্যস, গোটা দশক জুড়ে, এমনকী এই নতুন শতকে এসেও একের পর এক ছবিতে সাচ্চা ভারতীয় হওয়ার প্রমাণ দিতে হয়েছে বলিউডি হিরোদের। ছবিতে তাঁদের দেশপ্রেমের সংজ্ঞা আটকে থাকত শুধু সন্ত্রাসবাদীদের নিধনে, তুমুল মারপিটে। সে সময় আমাদের প্রতি ছাব্বিশে জানুয়ারি বা প্রতি পনেরোই অগস্টে, সিনেমাহলে তো বটেই, টিভি-র সরকারি বা বেসরকারি উভয় চ্যানেলেই এ ধরনের ছবিই দেখতে হত। কোনও বছর ‘রোজা’ তো পরের বছর ‘বর্ডার’ বা এ বছর ‘সরফরোশ’ তো ও বছর ‘মিশন কাশ্মীর’। দ্রোহকাল, তক্ষক, পুকার, গদর এক প্রেমকথা, কিছু কাল আগের ইন্ডিয়ান সব ছবির নাম চেষ্টা করলেও মনে করতে পারব না।
গত দু’দশকে এ ধরনের ছবির মূল জিগির: আমাদের দেশ সন্ত্রাসবাদে আচ্ছন্ন, দেশের সার্বভৌমতা আক্রান্ত। আর এ ক্ষেত্রে শত্রু সেই পাকিস্তান, এ দেশে সন্ত্রাসবাদের সঞ্চালকও তারা। আসলে পাকিস্তানের সঙ্গে ভারতের কূটনৈতিক সম্পর্ক এমন এক তলানিতে পৌঁছেছে, যেখানে পাকিস্তানকে পরম শত্রু ভাবা ছাড়া বিকল্প কোনও ব্যবস্থা রাখেনি আমাদের সরকার এবং অবশ্যই আমাদের বলিউডের ছবি। আর সে সব ছবিতে যে দেশপ্রেমের প্রমাণ দিতে হয় নায়কদের, তার প্রথম নমুনাই হল: পাকিস্তানকে প্রতিবেশী শত্রু হিসেবে চিনে নিয়ে প্রতিরক্ষা ব্যবস্থা আরও জোরদার করা। |
এক থা টাইগার-এর শুরুতেও সলমন দেশপ্রেমের ওই নমুনা পেশেই ব্যস্ত ছিলেন। ভারতীয় প্রতিরক্ষার গুপ্তচর সংস্থা ‘র’-এর এজেন্ট সলমন, সেখানে তাঁর নাম ‘টাইগার’। পাকিস্তানি গুপ্তচর সংস্থা ‘আই এস আই’-এর এজেন্টদের বেধড়ক পেটানো, বা ‘র’-এর যে-সব এজেন্ট ‘আই এস আই’-এর কাছে ‘বিক্রি’ হয়ে যাচ্ছে, তাদের খতম করা এ সমস্ত কাজেই প্রথমে ব্যস্ত থাকতে দেখি সলমনকে। কিন্তু কবীর খান স্পষ্ট বলেছেন ‘এক থা টাইগার ওয়াজ নেভার আ মিশন ফিল্ম... দ্য ফিল্ম হ্যাজ অলওয়েজ বিন আ লাভ স্টোরি’। ফলে সলমনের কাছে রাষ্ট্রের হুকুম তালিম করার থেকেও বড় হয়ে ওঠে প্রেম। আগের হিরোরাও কি প্রেম করতেন না, বা তাঁদের কি প্রেমিকা থাকত না? নিশ্চয়ই থাকত, প্রেমও হত, তবে সবই রাষ্ট্রের ফরমান মেনে। ব্যক্তি-নায়কেরা সেখানে আত্মস্বাতন্ত্র্য বজায় রাখতেই মেনে নিতেন রাষ্ট্রের আনুগত্য। ব্যক্তি হিসেবে তাঁদের মূল্যবোধ থেকে নিভৃত সম্পর্কের অনুভূতি সবই ঠিক করে দিত রাষ্ট্র। যেন ব্যক্তি নয়, ব্যক্তির বকলমে রাষ্ট্রই হয়ে উঠত সমস্ত ছবির নায়ক।
এ ছবিতে কিন্তু রাষ্ট্র নয়, সলমনই নায়ক, বা সলমনের প্রেম। বড় বিপজ্জনক সে প্রেম, ‘আই এস আই’-এর এক এজেন্টকে ভালবেসে ফেলে রাষ্ট্রের অবাধ্য হতে থাকেন সলমন। ‘র’-এর চোখেও ধুলো দিয়ে পালাতে থাকেন প্রেমিকাকে নিয়ে, এ-দেশ থেকে ও-দেশ। সলমনের ‘বস্’ গিরিশ কারনাড তাঁকে ভর্ৎসনা করেন, বলেন: ‘র’-এর কাজে ফাঁকি মানে রাষ্ট্রের প্রতি কর্তব্যে অবহেলা। আর প্রেম করার জন্যে অন্য কোনও দেশের মেয়ে জুটল না, পাকিস্তানি প্রেমিকা!
গিরিশের কথাগুলিই কিন্তু আগেকার ছবির ‘বিষয়’। সে সব ছবি ছেয়ে থাকত এমন এক রাষ্ট্রীয় অভিমানে, যেখানে প্রতিবেশী শত্রু-দেশ মানেই প্রতিপক্ষ, এবং তারা অন্যায়কারী ও বধ্য। রাষ্ট্রব্যবস্থা তার ‘যুক্তি’তে দমন-পীড়ন-হিংসায় অভ্যস্ত হওয়ার দীক্ষা দিত বলিউডি হিরোদের। সেই যুক্তিতে সলমনেরও উচিত ছিল তাঁর পাকিস্তানি প্রেমিকাকে ‘খতম’ করে দেওয়া। অথচ এ ছবিতে সলমন তাঁর প্রেমিকাকে নিয়ে পালাচ্ছেন, প্রায় জোটবদ্ধ হয়ে ‘র’ আর ‘আই এস আই’-এর এজেন্টরা তাঁদের দিকে এলোপাথাড়ি গুলি ছুড়ছেন। নিজের প্রেম ও প্রেমিকাকে নিয়ে একটা চমৎকার জবাব দেন সলমন গিরিশকে: স্যর, প্রেম করার সময় জানতাম না যে ও আমার ‘দুশমন’, আর প্রেম হয়ে যাওয়ার পর এখনও বুঝে উঠতে পারিনি যে ও কেন আমার ‘দুশমন’!
সলমন এ ছবিতে স্বাধীন গলায় কথা বলেছেন। নানা রকম সংলাপে জানিয়েছেন তাঁর খেদ—‘মুলুক’-এর চাপে চাপা পড়ে গেছে ‘ইনসান’, বা ‘র’-এর দেওয়া নাম ‘টাইগার’ একটা পোষা কুকুরেরও হতে পারে, তাঁর বাপ-মা’র দেওয়া নামটাই হারিয়ে গেছে রাষ্ট্রের সেবা করতে করতে। আরও বলেন, পালানো ছেড়ে সে দিনই তিনি ফিরবেন তাঁর প্রেমিকাকে নিয়ে, যে দিন ভারত-পাকিস্তানের প্রতিরক্ষা ব্যবস্থার পারস্পরিক রেষারেষি বন্ধ হবে।
আসলে, সমষ্টির মধ্যে ব্যক্তি এক ধরনের আত্মপরিচয়ও লাভ করে। ফলে সমষ্টি যখন নিজেকে মিথ্যা পরিচয়ে ভোলায়, ব্যক্তিও তখন সেই মিথ্যা পরিচয়কেই আত্মপরিচয় বলে মনে করে। স্বাধীনতার সময় থেকে এই সমষ্টিবোধই রাষ্ট্রকে ক্রমাগত শক্তি জুগিয়ে চলেছে, আর ব্যক্তিও তার বশ হয়ে থাকছে। ওই মিথ্যা পরিচয় ছিঁড়ে ব্যক্তির প্রকৃত আত্মপরিচয়ে দাঁড়ানোর কথা বলল একটা বলিউডি ফর্মুলা-ফিল্ম, এ বারের স্বাধীনতা দিবসে! সিনেমা নিয়ে যাঁরা তত্ত্ব করেন, তাঁরা একটু ভেবে দেখবেন কি? |