|
|
|
|
সাক্ষাৎকার... |
খাদ্যের চাহিদা মেটাতে সেচ-পাম্পে বিদ্যুৎ চাই |
আশির দশকে পশ্চিমবঙ্গে কৃষি-উৎপাদন বৃদ্ধির পিছনে নলকূপ সেচের বড় ভূমিকা ছিল।
বিভিন্ন সরকারি নীতির ফলে এখন এ রাজ্যে সেচের জল অতি মহার্ঘ। তাতে কৃষকের ক্ষতি হচ্ছে,
দারিদ্রও কমছে না। স্বাতী ভট্টাচার্যের সঙ্গে সাক্ষাৎকারে বললেন অদিতি মুখোপাধ্যায় |
|
ভূগর্ভের জল নিয়ে আপনার গবেষণার ফলে এ রাজ্যের চাষিদের কী লাভ হবে?
এ রাজ্যের চাষির কাছে সেচের জল একটা মস্ত সমস্যা। চাষের জমির ৪০ শতাংশেই সেচের কোনও ব্যবস্থা নেই। যে সব জমিতে সেচ রয়েছে, সেগুলির অর্ধেকেরও বেশি নির্ভর করে ভূগর্ভের জলের উপর। অথচ রাজ্যের সেচ নীতি চাষিদের ভূগর্ভের জলের ব্যবহার অকারণে সীমিত করে রেখেছিল। জলের জন্য খুব চড়া মূল্য দিতে হচ্ছিল চাষিদের। নব্বইয়ের দশকের শেষ থেকে এই কারণে রাজ্যে কৃষিতে বৃদ্ধির হারে ভাঁটা পড়া শুরু হয়। পূর্ব ভারতের চার হাজার চাষির বিশদ সমীক্ষার ভিত্তিতে আমার সিদ্ধান্ত ছিল, কিছু ভুল সরকারি নিয়ম-নীতির জন্য, চাষিরা যথেষ্ট সেচের জল পাচ্ছেন না। তাই তাঁরা যথেষ্ট খাবার উৎপন্ন করতে পারছেন না, দারিদ্র কমছে না। এর ভিত্তিতে এ রাজ্যের সেচ নীতিতে দুটি পরিবর্তন আনা হয়েছে, যার ফলে কৃষি উৎপাদনে বৃদ্ধি, এবং দারিদ্র কমার সুযোগ তৈরি হয়েছে।
পশ্চিমবঙ্গের সেচের অসুবিধে ঠিক কোথায়?
এ রাজ্যে সেচের জলের দাম অত্যন্ত চড়া। তার কারণ অধিকাংশ সেচের পাম্পই ডিজেলে চলে, আর ডিজেলের দাম দ্রুত বেড়েছে। অন্য রাজ্যে এই সমস্যা অনেকটাই কম, কারণ অধিকাংশ সেচ পাম্প চলে বিদ্যুতে। কর্ণাটক, মহারাষ্ট্র, অন্ধ্র প্রদেশে ৮৫ শতাংশেরও বেশি সেচ পাম্প চলে বিদ্যুতে। অথচ আমাদের রাজ্যে মাত্র ১৭ শতাংশ সেচ পাম্পে বিদ্যুৎ সংযোগের অনুমতি দেওয়া হয়েছে। এ বিষয়ে আমরা ওড়িশা, বিহারের চাইতেও পিছিয়ে। কর্ণাটক, অন্ধ্র প্রদেশ, পঞ্জাবে সরকার সেচ পাম্পের জন্য বিদ্যুৎ বিনামূল্যে সরবরাহ করে, অনেক রাজ্যে সেচ পাম্পের বিদ্যুতে প্রচুর ভর্তুকি দেওয়া হয়। পশ্চিমবঙ্গে সেচ পাম্পের জন্য কোনও ভর্তুকি নেই। চাষিরা ডিজেল পাম্পের খরচ চালাতে পারছেন না, অনেকে চাষ বন্ধই করে দিচ্ছেন। এর সমাধান সেচ পাম্পে বিদ্যুৎ সংযোগ সহজ করা, এবং তার খরচ কমানো।
মনে রাখতে হবে, আশির দশকে এ রাজ্যে কৃষিতে যে অভূতপূর্ব উন্নতি হয়েছিল, তার পিছনে মস্ত অবদান নলকূপ সেচের। আশি এবং নব্বইয়ের দশকে নলকূপ সেচ ব্যবহার অনেক বেড়ে যায়, যা অধিকাংশ জমিকে দুই-তিন ফসলি করে তোলে, গ্রামীণ অর্থনীতিতে সচলতা নিয়ে আসে। অথচ সরকারি বিধিনিষেধ এবং বিদ্যুতের বিপুল খরচের কারণে চাষিরা এখন ইচ্ছে থাকলেও বিদ্যুৎ-চালিত পাম্প বসাতে পারছেন না। আবার ডিজেলের দাম বেড়ে যাওয়ায় ডিজেল-চালিত পাম্পও চালাতে পারছেন না। ফলে রাজ্যে সেচ পাম্পের সংখ্যা ২০০১ সালের থেকে ২০০৬ সালে এক লক্ষেরও বেশি কমে দাঁড়ায় পাঁচ লক্ষ ১৯ হাজারে। সেচ-সেবিত এলাকা বাড়ার বদলে কমতে শুরু করে। ভারতে এটা নজিরবিহীন। আর কোনও রাজ্যে এমন দেখা যায় না।
|
‘ওয়ার্ল্ড ফুড প্রাইজ ফাউন্ডেশন’ এ বছর ‘নর্ম্যান বোরলগ পুরস্কার’-এর জন্য নির্বাচিত করল বাঙালি গবেষক অদিতি মুখোপাধ্যায়কে। সবুজ বিপ্লবের জনক নোবেলজয়ী বোরলগের নামাঙ্কিত, দশ হাজার ডলার অর্থমূল্যের এই সম্মান এ বছরই দেওয়া শুরু হল। চল্লিশ অনূর্ধ্ব যে গবেষকরা হাতে-কলমে কাজ করে খাদ্য উৎপাদনে নতুন দিশা দেখাতে পেরেছেন, তাঁদের স্বীকৃতি দেয় এই পুরস্কার। এ রাজ্যে ভূগর্ভের জল নিয়ে অদিতির গবেষণা রাজ্যের সেচ নীতিতে যে পরিবর্তন এনেছে, তাতে খাদ্য উৎপাদন বৃদ্ধির সুযোগ তৈরি হয়েছে। প্রেসিডেন্সি কলেজের প্রাক্তন ছাত্রী অদিতি কেমব্রিজ বিশ্ববিদ্যালয় থেকে পিএইচ ডি লাভ করার পর ‘ইন্টারন্যাশনাল ওয়াটার ম্যানেজমেন্ট ইনস্টিটিউট’ সংস্থায় কর্মরত। |
|
কিন্তু যদি ভুগর্ভ থেকে বেশি জল তুলতে দেওয়া হয় চাষিদের, তা হলে জলের স্তর আরও নেমে গিয়ে সংকট তৈরি হবে না কি?
এ রাজ্যে বিদ্যুতের দর এত বেশি (ইউনিট প্রতি দেড় টাকা থেকে পাঁচ টাকা ৮৮ পয়সা) যে চাষিরা ইচ্ছে মতো জল তুলে নষ্ট করবেন, এমন সম্ভাবনা খুব কম। আটটি জেলাতে প্রায় ৯০০ চাষির মধ্যে সমীক্ষায় দেখেছি, বছরে তাঁদের গড়ে ছয় হাজার থেকে ১৫ হাজার টাকা বিল আসে। অথচ সরকারি আধিকারিকদের একটা বড়ো অংশ মনে করেন, চাষিরা সেচের জন্য যত কম বিদ্যুৎ ব্যবহার করেন তত ভাল। তাঁদের যুক্তি, এর ফলে জলস্তর নেমে যাচ্ছে, আর্সেনিক সমস্যা বাড়ছে, দেখা দিচ্ছে পানীয় জলের কষ্টও। শিক্ষিত নাগরিক সমাজের একটা বড়ো অংশও এই যুক্তিতে সহমত।
কিন্তু এই ধারণাটা নিয়ে আবার চিন্তা করার প্রয়োজন রয়েছে। পশ্চিমবঙ্গের মোট ৩৪১টা ব্লকের মধ্যে মাত্র ৩৮টি ব্লকে ভূগর্ভের জল আধা-সংকটজনক (‘সেমি-ক্রিটিক্যাল’) স্তরে নেমে গিয়েছে। সেখানে বিদ্যুৎ-চালিত পাম্পের উপর বিধি-নিষেধ অবশ্যই দরকার, এবং রয়েছেও। সেই সঙ্গে, রাজ্যের ৩৭ হাজারেরও বেশি গ্রামের মধ্যে যে ৩৪১৭টি গ্রামে নলকূপের জলে আর্সেনিক পাওয়া গিয়েছে, সেই সব গ্রামেও বিধি-নিষেধ থাকা দরকার। এই দুটি সমস্যার কোনও একটি রয়েছে, বা দুটিই রয়েছে, এমন গ্রামের সংখ্যা কোনও হিসেবেই ২০-২৫ শতাংশের বেশি হতে পারে না। তা হলে এ রাজ্যের যে ৭৫-৮০ শতাংশ গ্রামে জলস্তর নিরাপদ, আর্সেনিক দূষণও নেই, সেখানকার চাষিরা সেচ পাম্পে বিদ্যুৎ পাবেন না কোন যুক্তিতে?
খাদ্য নিরাপত্তার জন্যও কিন্তু সেচ পাম্পে বিদ্যুৎ সংযোগ জরুরি। বর্তমানে ধানের চাহিদা ১৩৫ লক্ষ টন। আগামী চার-পাঁচ বছরে তা প্রায় ৫০ লক্ষ টন বাড়বে। আমন ধানের এলাকা বা উৎপাদন বাড়ানো সম্ভব নয়, বাড়তি চাহিদা মেটাতে হবে বোরো ধান দিয়েই। কিন্তু দেখা যাচ্ছে, বোরো চাষের এলাকা ক্রমশ কমছে। ডিজেল-চালিত পাম্প ব্যবহার অসম্ভব হয়ে পড়া এর একটা প্রধান কারণ।
আপনার প্রধান কাজ ভূগর্ভের জল নিয়ে। আপনার মতে পশ্চিমবঙ্গে ভূগর্ভের জলের পরিস্থিতি কী? তা কি উদ্বেগজনক নয়?
রাজ্যে সাধারণত বৃষ্টিপাত বেশ ভালই হয়। তাই পলি-সমৃদ্ধ এই রাজ্যে ভূগর্ভের জলস্তর গ্রীষ্মে নেমে গেলেও, বর্ষায় আবার পরিপূর্ণ হয়ে যায়। রাজ্য সরকারের ‘জলসম্পদ অনুসন্ধান ও বিকাশ দফতর’ যে সব নলকূপ পরীক্ষা করে, তার ৭৫ শতাংশেই গত কুড়ি বছরে জলস্তর অপরিবর্তিত রয়েছে। বর্ষার আগে ২৫ শতাংশ নলকূপে জলস্তর নেমে যায়, কিন্তু বর্ষার পর অনেকগুলোতেই তা আগের স্তরে উঠে আসে। একশো দিনের কাজ প্রকল্পে খাল-বিল সংস্কারের যে কাজ চলছে, রাজ্য সরকার তাকে অগ্রাধিকার দিলে বর্ষার জল আরও দ্রুত ভূগর্ভের জলস্তর বাড়িয়ে দেবে।
আসলে সমস্যাটা চাষির প্রতি মনোভাবে। পশ্চিমবঙ্গ রয়েছে গাঙ্গেয় উপত্যকায়, কেবল ভারত কেন, গোটা বিশ্বের নিরিখে পশ্চিমবঙ্গ ভূগর্ভের জলে অত্যন্ত সম্পদশালী। অন্যান্য রাজ্যে কি ভূগর্ভের জল নেমে যাওয়ার আশঙ্কা নেই? তা সত্ত্বেও সেখানে চাষিরা অনেক সহজ শর্তে অনেক বেশি জল ব্যবহার করছেন। গুজারাতে, মহারাষ্ট্রে, পঞ্জাবে সরকারি কর্তাদের সঙ্গে কথা বলে দেখেছি, তাঁরা বলেন, ‘বেচারা কিসান।’ পশ্চিমবঙ্গে চাষির প্রতি সেই সহানুভূতি দেখি না। সরকারি তথ্যই দেখাচ্ছে, ২০০৭ থেকে ২০১০, এই তিন বছরে ২৩ হাজার চাষি নতুন পাম্প বসানোর জন্য আবেদন করেছেন, পেয়েছেন মাত্র সাড়ে আট হাজার। পারমিট পেতে গিয়ে অনেক চাষি ঘুষ দিতে বাধ্য হয়েছেন, কিছু আধিকারিক ধরাও পড়েছেন। উত্তরবঙ্গের জেলাগুলো, যেখানে জলস্তরের সমস্যা বা আর্সেনিকের সমস্যার কোনও চিহ্নই নেই, সেখানেও সেচ পাম্পে বিদ্যুৎ সংযোগের জন্য হয়রান হচ্ছেন চাষিরা। |
|
আকাশই ভরসা: এ রাজ্যের ৪০ শতাংশ জমিতেই সেচের কোনও ব্যবস্থা নেই। ছবি অনির্বাণ সেন |
আপনার গবেষণা সরকারের কাজে কি কোনও পরিবর্তন এনেছে?
আমি যোজনা কমিশনের কাছে আমার গবেষণার ফলাফল পেশ করি। কমিশনের সহায়তায় পশ্চিমবঙ্গের জলসম্পদ, কৃষি, অর্থ এবং গ্রামোন্নয়ন দফতরের সচিবদের সঙ্গে কথা বলি। আমার গবেষণার তথ্যের ভিত্তিতে জলসম্পদ দফতর (WRIDD) একটি নতুন বিজ্ঞপ্তি জারি করেছে যে, যে হেতু রাজ্যের জলসম্পদের মাত্র ৪২ শতাংশ ব্যবহার করা হয়, তাই ৩৮টি আধা-সংকটজনক ব্লক ছাড়া অন্য কোথাও পাঁচ অশ্বশক্তি বা তার কম ক্ষমতাসম্পন্ন সেচ পাম্প বসাতে আর সরকারি অনুমতি লাগবে না। এই নীতি পরিবর্তন হয় নতুন সরকার আসার পর, গত বছর নভেম্বরে। এ ছাড়া রাজ্য বিদ্যুৎ সরবরাহ সংস্থা (WBSEDCL) ২০১০ সালে নিয়ম করেছে যে, বিদ্যুৎ সংযোগের পুরো খরচ চাষিকে বহন করতে হবে না। একটা নির্দিষ্ট পরিষেবা মূল্য (আট হাজার থেকে ১২ হাজার টাকা) নেবে কোম্পানি। এই দুটি ব্যবস্থা কার্যকর হলে চাষের খরচ অনেক কমবে। ক্ষুদ্র ও প্রান্তিক চাষিকে যদি বিদ্যুৎ সংযোগে অগ্রাধিকার দেওয়া হয়, তা হলে কৃষি উৎপাদন বৃদ্ধির হার তো বাড়বেই, ভূগর্ভস্থ জলের উপর মুষ্টিমেয় ধনীর একচেটিয়া অধিকারও তৈরি হবে না। গরিব চাষির আর্থিক সক্ষমতা বাড়বে।
মুশকিল হল, নিয়মবিধির এই পরিবর্তনের খবর চাষিদের কাছে পৌঁছে দেওয়ার কোনও ব্যবস্থা নেই। অধিকাংশ চাষিই এ বিষয়ে ওয়াকিবহাল নন। আর বিদ্যুৎ সরবরাহ দফতরেও দেখছি সেচ পাম্পে বিদ্যুৎ সংযোগ দেওয়ার ব্যাপারে চূড়ান্ত উদাসীনতা। ‘আমাদের কাছে কোনও সার্কুলার আসেনি,’ এমন অজুহাত প্রায়ই শোনা যায়। অথচ অন্য সব রাজ্যের চাইতে পশ্চিমবঙ্গেই সবচেয়ে বেশি গ্রামবাসী খিদে নিয়ে শুতে যায় (১০ শতাংশ)। খাদ্য উৎপাদন বাড়াতে, চাষির রোজগার বাড়াতে, সেচ পাম্পের বিদ্যুদয়ন জরুরি। রাজ্যের প্রায় সব পাম্পেই মিটার বসানো থাকায় চাষিদের অপচয়ের সুযোগ সামান্যই। |
|
|
|
|
|