অসমের পরিস্থিতি ক্রমেই আরও উদ্বেগজনক। মাঝেমধ্যেই বড়ো জনজাতি কিংবা বাঙালি মুসলমানের মৃতদেহ ঝোপেঝাড়ে আবিষ্কৃত হইতেছে, আর অমনি নূতন করিয়া উত্তেজনা ও অশান্তি ছড়াইতেছে। ত্রাণ শিবির হইতে ভিটায় ফিরিয়াই নূতন করিয়া আক্রান্ত হওয়ার ঘটনাও ঘটিতেছে। ফলে সহসা কেহ আর শিবিরের নিরাপত্তা ত্যাগ করিয়া ঘরে ফিরিতে চাহিতেছে না। ফৌজি টহল, কার্ফু, পুলিশি বন্দোবস্তকিছুই আর দুর্গত সর্বহারা উদ্বাস্তুদের আত্মবিশ্বাস ফিরাইতে পারিতেছে না। মাসাধিক কালেও হানাহানি থামিল না। ইহার পিছনে প্রশাসন তথা সরকারের ব্যর্থতা নিন্দনীয়। তবে তাহার সহিত যুক্ত হইয়াছে দুই বিরুদ্ধ শিবিরের রণং দেহি মনোভাবও। পরস্পরের প্রতি বিদ্বেষ ও ঘৃণার নিরবচ্ছিন্ন প্রচার এবং উত্তেজনা জিয়াইয়া রাখার প্রয়াসে কোনও ছেদ নাই।
বড়ো জনজাতির সমর্থনে বিজেপি, বিশ্ব হিন্দু পরিষদ ও বজরঙ দলের মতো হিন্দুত্ববাদীদের সমাবেশ স্বভাবতই অসমের নিজস্ব সামাজিক-রাজনৈতিক প্রেক্ষিতে তাহার বিপ্রতীপ বর্গ মুসলিমদের ঐক্যবদ্ধ করিয়া ফেলিয়াছে। বড়োল্যান্ডে আক্রান্ত বাঙালি মুসলমানদের প্রতি সংহতি জানাইতে আগাইয়া আসিয়াছেন অসমিয়াভাষী মুসলিমরাও। বজরঙ দল দাঙ্গার প্রতিবাদে অসম বন্ধ ডাকিলে তাহার জবাবে সারা অসম মুসলিম ছাত্র ইউনিয়নও পাল্টা বন্ধ ডাকিতেছে। উভয় বন্ধ-এরই সমর্থক ও বিরোধী জনগোষ্ঠী পরস্পরকে আক্রমণ করিয়াছে। এই প্রক্রিয়ায় এক দিকে যেমন অসমিয়া সমাজের সাম্প্রদায়িক মেরুকরণ ঘটিয়া চলিয়াছে, অন্য দিকে তেমনই সাম্প্রদায়িক বিদ্বেষ বড়োল্যান্ডের অর্থাৎ নমনি অসমের জেলাগুলি ছাপাইয়া অবশিষ্ট অসমেও ছড়াইয়া পড়িতেছে। ইহা অতীব বিপজ্জনক। এই সাম্প্রদায়িক মেরুকরণ হিন্দুত্ববাদীদের ভোটের বাক্স ভরাইয়া দিতে পারে, বিশেষত অসম গণ পরিষদ ও আসু’র মতো খণ্ডজাতীয়তাবাদী অসমিয়া সংগঠনের সহিত হিন্দুত্বের শক্তির বোঝাপড়া যখন ঐতিহাসিক ভাবেই নিবিড়। কিন্তু সেই নির্বাচনী হিসাব-নিকাশের লক্ষ্যে অসমের বর্তমান রাজনীতিকে সঞ্চালিত করা এক ভয়ঙ্কর এবং আত্মঘাতী পদক্ষেপ হইবে।
কেন্দ্রীয় সরকার তাই গোল পাকানোর লক্ষ্যে আহূত বন্ধ ও পাল্টা বন্ধ-এর উপর কঠোর নিষেধাজ্ঞা আরোপের পক্ষপাতী। এই মর্মে রাজ্যকে নির্দেশও দিয়াছে। এই পদক্ষেপ সঙ্গত ও যুক্তিপূর্ণ। একই সঙ্গে বক্তৃতা, ভাষণ ও বিবৃতি মারফত উত্তেজনা ছড়ানো সকলকে দলীয় আনুগত্য নির্বিশেষে জেলে ভরার নির্দেশও দেওয়া হইয়াছে। ইতিমধ্যেই দাঙ্গায় জড়িত থাকার দায়ে বড়ো বিধায়ক প্রদীপ ব্রহ্মকে গ্রেফতার করা হইয়াছে। তাহাতে জনজাতিদের মধ্যে বিরূপ প্রতিক্রিয়া হইলেও প্রশাসন অনমনীয় থাকিয়াছে। সেনাবাহিনী ব্যাপক ভাবে আগ্নেয়াস্ত্র উদ্ধারের অভিযানে নামিয়াছে। এই অভিযান আরও আগেই হওয়া দরকার ছিল। বড়োল্যান্ড হাসিল করার প্রক্রিয়ায় যে-সব জঙ্গি জনজাতীয় সংগঠন বন্দুক-বিস্ফোরকের ভাষা রপ্ত করিয়াছিল, তাহারা যেমন বড়ো সমাজে মিশিয়া আছে, তেমনই ইতস্তত মজুত রহিয়াছে তাহাদের ব্যবহৃত আগ্নেয়াস্ত্রও। এগুলি বাজেয়াপ্ত করা সর্বাগ্রে দরকার। আগ্নেয়াস্ত্রের নিজস্ব ভাষা আছে, এক বার হাতে তুলিয়া লইলেই যাহা ব্যবহারকারীকেও নিয়ন্ত্রণ করিতে শুরু করে। অসমের বর্তমান পরিস্থিতিতে কেবল স্বশাসিত বড়োল্যান্ডের জেলাগুলি হইতে নয়, সমগ্র অসম হইতেই আগ্নেয়াস্ত্র বাজেয়াপ্ত করার অভিযান চালানো প্রয়োজন। |