বিল পাশ করাইতে সংযুক্ত প্রগতিশীল মোর্চার সরকার সংসদে ব্যর্থ হইয়াছে, ইহা আর কোনও খবর নহে। গত তিন বৎসরে এই ব্যর্থতাই দস্তুর হইয়াছে। কিন্তু, যে ভঙ্গিতে জমি অধিগ্রহণ বিলটি আটকাইয়া গেল, তাহা এই সরকারের ক্ষেত্রেও ব্যতিক্রমী। এক অজিত সিংহ ব্যতীত কোনও শরিক আপত্তি করেন নাই, এমনকী মমতা বন্দ্যোপাধ্যায়ও নহেন। মন্ত্রিসভার অনুমোদনের জন্য বিলটি তোলার পর জানা গেল, কংগ্রেসেরই বেশ কয়েক জন মন্ত্রীর আপত্তি আছে। অতএব, বিলটি ফের হিমঘরে অধুনা যাহার পোশাকি নাম মন্ত্রিগোষ্ঠী পৌঁছাইল। গত এক বৎসর বিলটি হিমঘরেই ছিল। মন্ত্রীরা একেবারে শেষ বেলায় যে ভাবে আপত্তি জানাইয়াছেন তাহাতে স্পষ্ট, এই এক বৎসরে এই বিল সংক্রান্ত আলোচনা বিশেষ হয় নাই। কংগ্রেস একেবারে বিপাকে না পড়িলে শরিকদের সঙ্গে আলোচনা করে না বলিয়া শরিকরা যৎপরোনাস্তি ক্ষুব্ধ। এক্ষণে স্পষ্ট, সরকারের শীর্ষ নেতৃত্ব দলের মন্ত্রীদের সঙ্গে আলোচনা করিবার প্রয়োজনও বোধ করেন না। এই নীরবতা প্রধানমন্ত্রীর পক্ষে কাব্যময় হইতে পারে, প্রশাসনের পক্ষে সুসংবাদ নহে। কমল নাথ, আনন্দ শর্মা, সি পি যোশী বা বীরাপ্পা মইলি-রা জমি বিল লইয়া যে আপত্তিগুলি তুলিয়াছেন, সেইগুলি ন্যায্য কি না তাহা ভিন্ন প্রশ্ন, কিন্তু প্রত্যেকটিই সন্দেহাতীত ভাবে আলোচনার যোগ্য। তাঁহারা যে দফতরগুলির মন্ত্রী, তাহার প্রতিটিই জমি অধিগ্রহণের নীতির দ্বারা প্রভাবিত হইবে। কাজেই, সংশ্লিষ্ট মন্ত্রীদের আপত্তি কোথায়, তাহা জানা; আপত্তি অগ্রাহ্য করিতে হইলে তাহার যথার্থ কারণ দর্শানো; আলোচনার মাধ্যমে একটি গ্রহণযোগ্য মধ্যপন্থা নির্ধারণ করা যে কোনও স্বাভাবিক প্রশাসন গত এক বৎসরে এই কাজগুলি করিত। মনমোহন সিংহের সরকার কিছুই করে নাই। এই ব্যাধি যে ইউ পি এ সরকারকে, এবং গোটা দেশকে, আর কোন বিপদের পথে লইয়া যাইবে, তাহাই প্রশ্ন।
একটি কথা স্পষ্ট করিয়া বলা প্রয়োজন মন্ত্রীদের প্রতিটি আপত্তি লইয়া আলোচনা করা উচিত ছিল বটে, কিন্তু আপত্তির মূল সুরটি যুক্তিগ্রাহ্য নহে। জমি বিল লইয়া মন্ত্রীদের আশঙ্কা কার্যত একটিই: ইহার ফলে জমির দাম বিপুল ভাবে বাড়িবে, ফলে বহু প্রকল্পই আর আর্থিক ভাবে লাভজনক থাকিবে না। এই আপত্তির সহজ উত্তর সম্ভব জমির বর্ধিত দাম সত্ত্বেও যে প্রকল্পগুলি লাভজনক থাকিবে, একমাত্র সেই প্রকল্পগুলিই রূপায়িত হইবে। পেট্রোলিয়ামের মূল্যবৃদ্ধি মানিতে সমস্যা না হইলে কোন যুক্তিতে জমির মূল্যবৃদ্ধিতে আপত্তি সম্ভব? বিভিন্ন রাষ্ট্রায়ত্ত প্রকল্পের ব্যয়বৃদ্ধি লইয়াও প্রশ্ন উঠিতেছে। জমি অধিগ্রহণ বিলের সূত্র মানিলে যে ভাবে জমির দাম বাড়িবে, তাহাতে পরিকাঠামোর ন্যায় ক্ষেত্রে বিনিয়োগ করা সরকারের পক্ষে কার্যত অসম্ভব হইবে বলিয়াই আশঙ্কা। আশঙ্কাটি অমূলক। সরকার উন্নততর সড়ক নির্মাণ করিলে তাহাতে যাঁহারা গাড়ি চালাইবেন, তাঁহাদের নিকট হইতে পরিষেবা মূল্য আদায় করিতে হইবে বইকি। কয়লার দাম বাড়িলে যদি বিদ্যুতের দাম বাড়ে, বিদ্যুৎকেন্দ্র গড়িবার জমির দাম বাড়িলেই বা তাহার অন্যথা হইবে কেন? যে কথাটি ভুলিলে চলিবে না, তাহা হইল, জমি অধিগ্রহণের কেন্দ্রে উন্নয়নের নির্ভুল সম্ভাবনা রহিয়াছে। যাঁহারা বাজার অর্থনীতির মূলধারার অংশ, জমি অধিগ্রহণে তাঁহাদের লাভ। অধিগ্রহণের পূর্বে জমি যাঁহাদের ছিল, জমির উপর যাঁহারা নির্ভরশীল ছিলেন, এই লাভের প্রক্রিয়ায় তাঁহারা সাধারণত অংশগ্রহণ করিতে পারেন না। জমির ভবিষ্যৎ-মূল্য মাথায় রাখিয়া তাঁহাদের দাম দেওয়া প্রকৃত প্রস্তাবে তাঁহাদের ভবিষ্যৎ সমৃদ্ধির অংশী করিয়া লওয়া। কোনও যুক্তিতেই তাঁহাদের জন্য বরাদ্দ এই ভাগ কাড়িয়া লওয়া যাইবে না। রুষ্ট মন্ত্রীরা যত দ্রুত এই কথাটি বুঝেন, ততই মঙ্গল। |