প্রবন্ধ ২...
ধর্ষণের ‘মিথ্যা’ অভিযোগ
কেন, কখন, কার চাপে
তটা চাপের মধ্যে থাকলে এক জন মেয়ে ধর্ষণের ঘটনা নিয়ে মিথ্যে বয়ান দিতে পারেন? বিচারপতি জে এম পাঞ্চাল ও দীপক ভার্মা নিয়ে গঠিত সুপ্রিম কোর্টের ডিভিশন বেঞ্চ ২০১০ সালের জানুয়ারি মাসে একটি নাবালিকা ধর্ষণের মামলায় রায় দিতে গিয়ে বলেছিলেন: কোনও ভারতীয় মেয়ে বা মহিলা এ নিয়ে মিথ্যে বলবে না, কারণ তারা এর ফলাফলটা জানে। যদি সে মিথ্যা বলেছে প্রমাণিত হয়, তা হলে সারা জীবন সমাজ তাকে হেনস্থার চোখে দেখবে।
এটা কোনও বিচারপতি বলবেন তবে মেয়েরা জানবেন, তা নয়। মেয়েরা নিজেরাই এ ধরনের ঘটনার ফলাফল জানেন। তা হলে, চেতলার যে মেয়েটি দিন কয়েক আগে ধর্ষিতা হওয়ার দাবি করেও পরে অভিযোগ প্রত্যাহার করে নিল, তার ওপরে চাপের পরিমাণটা ভাবুন। ‘ধর্ষণের ঘটনা’ ঘটার আগেই শাসক দলের নেতা হাসপাতালে ফোন করে পরীক্ষার জন্য ডাক্তার তৈরি রাখতে বলছেন, শাসক দলের পুর প্রতিনিধি মেয়েটিকে থানায় নিয়ে যাচ্ছেন অভিযোগ দায়ের করাতে, মেয়েটি নিজে প্রথমে অভিযোগ দায়ের করে ফের তাকে ‘সাজানো ঘটনা’ বলছে এই ঘটনাপরম্পরায় মেয়েটির ওপর চাপ অনুমান করা কি খুব কঠিন?
ধর্ষনের ঘটনায় দিল্লি পুলিশকে কাউন্সেলিং দেয় ‘সঞ্চেতন’ নামে একটি স্বেচ্ছাসেবী সংস্থা। তারা মানসিক স্বাস্থ্য নিয়ে কাজ করে। সংস্থাটি ২০০৮ সালে তার আগের পাঁচ বছরের ১১৩টি ধর্ষণের ঘটনা নিয়ে একটি রিপোর্ট তৈরি করে। সেখানে দেখা গেছে মাত্র ১৮ শতাংশ মামলা মিথ্যে। সেই মিথ্যে মামলার এক-চতুর্থাংশ দায়ের করা হয়েছে সংশ্লিষ্ট ব্যক্তিটির প্রতি ক্রোধে, ২৫ শতাংশ পরিবারের অন্য সদস্যদের প্ররোচনায়, ২০ শতাংশ ক্ষেত্রে পারিবারিক বিবাদের ফলে কোনও নাবালিকাকে শিখিয়ে দেওয়া হয়েছে, ১৫ শতাংশ ক্ষেত্রে প্রাথমিক সম্মতি থাকলেও পরে ভয়ে অভিযোগ আনা হয়েছে, আর বাকি ১৫ শতাংশকে তাঁরা কোনও ভাগে ফেলতে পারেননি। দিল্লি প্রশাসনকে ঝামেলায় ফেলার জন্য বিরোধীরা ‘ধর্ষণ’ ঘটাচ্ছে, এ রকম কোনও তথ্য তাতে ছিল না।
প্রতিবাদের ভাষা। আলিপুর কোর্টের সামনে।
সঞ্চেতনের তরফে যিনি এই রিপোর্ট করেছেন, সেই ক্লিনিকাল সাইকোলজিস্ট রজত মিত্র চাপের উদাহরণ দিতে গিয়ে বলেছেন যে, বহির্দিল্লির দ্বারকা অঞ্চলের একটি ১৩ বছরের মেয়ের ডাক্তারি পরীক্ষায় দেখা গেল যে ধর্ষণের ঘটনা ঘটেছে। কিন্তু যাদের বিরুদ্ধে অভিযোগ, তাদের গতিবিধির সঙ্গে ওই ঘটনার সময়কে মেলানো যাচ্ছে না। পরে তদন্তে দেখা যায়, আসলে পরিবারের তিন জন ওই ঘটনা ঘটিয়েছিল, কিন্তু পরিবার তাদের আড়াল করতে অন্য তিন জনের নাম বলতে মেয়েটিকে বাধ্য করে।
রিপোর্টে যে ঘটনাগুলি আলোচনা করা হয়েছিল, তার প্রায় এক-তৃতীয়াংশ ক্ষেত্রে দেখা গিয়েছে, ধর্ষিতা মেয়েটি প্রবল ট্রমা বা মানসিক আঘাতের শিকার হয়েছে। এ রকম ঘটনার মধ্যে আবার ৩০ শতাংশ মেয়ে একেবারে স্তব্ধ হয়ে গিয়েছে, এমন ভাবে যে তার মধ্যে আর ট্রমার প্রকাশ্য
কোনও চিহ্ন থাকে না। সেই সব ক্ষেত্রে কি পুলিশের তদন্তের মানেও হেরফের হয়?
এই রিপোর্টই কিন্তু বলছে, ৮২ শতাংশ ক্ষেত্রে অভিযোগটি সত্য। অথচ পুলিশের অবহেলা বা চাপের মুখে দায়সারা তদন্তে যদি অভিযুক্ত ছাড়া পেয়ে যায়, তা হলেই রব ওঠে অভিযোগকারিণী আসলে ঘটনাটা চেয়েছিল। না হলে বলা হবে, এটাই ওর ব্যবসা, ফাঁসানোর ধান্দা, ইত্যাদি।
বিরোধী নেত্রী হিসেবে মুখ্যমন্ত্রী নিজে ১৯৯৮ সালে ভাঙড়ের অশ্বত্থবেড়িয়ার চম্পলা সর্দারের ধর্ষণের অভিযোগ নিয়ে লড়েছিলেন। কেন্দ্রের বিজেপি সরকারের সঙ্গে তখন মমতা বন্দ্যোপাধ্যায় জোটে, কেন্দ্রীয় সরকার তদন্ত দল পাঠানোয় মুখ্যমন্ত্রী জ্যোতি বসু বিধানসভায় রাজ্যের বিষয়ে হস্তক্ষেপ, নোংরা রাজনীতি, শরিকদের তুষ্ট রাখা, এই সব বলেছিলেন।
আদালতে কিন্তু চম্পলা সর্দারের ধর্ষণ প্রমাণিত হয়নি, অভিযুক্তরা বেকসুর খালাস পেয়েছিল। তা হলে কি তা সাজানো ছিল? যদি চম্পলা মিথ্যে অভিযোগ করে থাকেন, কোন চাপে, কতটা চাপে তা করেছিলেন? আজ ধর্ষণের মিথ্যে অভিযোগে মুখ্যমন্ত্রী শাস্তির কথা বলছেন, তা হলে চেতলা কাণ্ডে কে কে শাস্তি পাবেন?
শুধু চেতলার মেয়েটি নয়, দিল্লির কারকারদুমা আদালত গত অগস্টে সঞ্জীব বলে এক জন রিকশাচালককে নাবালিকা কন্যাকে ধর্ষণের অভিযোগ থেকে অব্যাহতি দেয়। তদন্তে দেখা যায়, বাবা সংসারে খরচ দেয় না, প্রচণ্ড মদ খায় আর ফিরে বউ-বাচ্চা সব্বাইকে মারধর করে। নাচার মা ভেবেছিলেন এই ভাবে হয়তো বাবাকে সিধে করা যাবে। আবার, বলিউডের অভিনেতা শাইনি আহুজার ক্ষেত্রে পরিচারিকাকে ধর্ষণের মামলায় নিম্ন আদালতে ‘অপরাধ প্রমাণ’ এবং সাত বছরের জেল হবার পর যখন পরিচারিকা নিজেই বয়ান দিয়ে মামলা তুলে নেন তার পিছনে কী চাপ করেছিল আমরা কি জানি?
চাপটা জানেন শুধু অভিযোগকারিণী আর অভিযুক্ত। রাজনৈতিক দলরাও যদি এটিকেই হাতিয়ার করে, তা হলে ‘ঠিক মতো দাদা-কাকা ধরলে ধর্ষণ করলেও পার পেয়ে যাওয়া যায়’, সেটাই আবার প্রমাণিত হবে। সেটা শাসক-বিরোধী আর মাঝখানে থাকা অসংখ্য সাধারণ নাগরিক নারী ও পুরুষ, তাঁদের কারওর জন্যই ভাল ইঙ্গিত নয়। সব চাপান-উতোরে হয়তো ধর্ষণের অভিযোগ তার অপরাধ গুরুত্ব হারিয়ে বসবে, যা নামিয়ে আনতে পারে সেই অদ্ভুত অন্ধকার।


First Page| Calcutta| State| Uttarbanga| Dakshinbanga| Bardhaman| Purulia | Murshidabad| Medinipur
National | Foreign| Business | Sports | Health| Environment | Editorial| Today
Crossword| Comics | Feedback | Archives | About Us | Advertisement Rates | Font Problem

অনুমতি ছাড়া এই ওয়েবসাইটের কোনও অংশ লেখা বা ছবি নকল করা বা অন্য কোথাও প্রকাশ করা বেআইনি
No part or content of this website may be copied or reproduced without permission.