শিক্ষিকারা কী পোশাক পরে স্কুলে আসবেন, তা ‘স্থির করে দিয়েছিলেন’ পরিচালন সমিতির সম্পাদক ও সভাপতি। তিন জন শিক্ষিকাকে ‘ফতোয়া’ দেওয়া হয়েছিল, সালোয়ার কামিজ পরে স্কুলে আসা যাবে না। ডুয়ার্সের আলিপুরদুয়ারের শামুকতলার তালেশ্বরগুড়ি হাইস্কুলের এই ঘটনা রাজ্যে নতুন নয়। গত কয়েক বছরে হাওড়ার শ্যামপুরের আয়মা গাজনকোল হাইস্কুল, সিঙ্গুরের গোলাপমোহিনী মল্লিক উচ্চ বালিকা বিদ্যালয়, উত্তর ২৪ পরগনার হালিশহরের রামপ্রসাদ বিদ্যালয় সহ রাজ্যের বিভিন্ন স্কুলে এমনই ফতোয়া দেওয়া হয়েছে। কিন্তু তালেশ্বরগুড়িতে পরিচালন সমিতির আট জন সদস্য সম্পাদকের এমন ফতোয়ার বিরোধিতা করেছেন। তাঁরা এমনকী এই ফতোয়া দেওয়ার জন্যই ওই সম্পাদক ও সভাপতির বিরুদ্ধে লিখিত ভাবে অনাস্থা এনেছেন।
গোলাপমোহিনী হাইস্কুলের যে শিক্ষিকাদের এই পোশাক বিতর্কে বিব্রত হতে হয়েছিল, তাঁদের মধ্যে ছিলেন স্বাতী পুরকাইত। তিনি বলেন, “পরিচালন সমিতির সদস্যেরা নিজেরাই যে বুঝতে পেরেছেন যে, কোনও শিক্ষিকা কী পোশাক পরবেন, এটা গুরুত্বপূর্ণ নয়, তা খুবই আনন্দের বিষয়।” তাঁর কথায়, “পরিচালন সমিতি স্কুলের অভিভাবক। তাঁদের উচিত স্কুলের পরিবেশ এমনই রাখা যাতে, ছাত্রছাত্রীদের মতো শিক্ষিকারাও সুস্থ ভাবে তাঁদের দায়িত্ব পালন করতে পারেন। আমাদের ক্ষেত্রে তখন সেই সৌভাগ্য হয়নি, কিন্তু শামুকতলায় যা হয়েছে, তাতে আমি খুবই খুশি। আশা করি এটা দৃষ্টান্ত হয়ে থাকবে।”
তালেশ্বরগুড়ি হাইস্কুলের পরিচালন সমিতি বামফ্রন্টের নিয়ন্ত্রণাধীন। পরিচালন সমিতির সম্পাদক রমেশচন্দ্র রায় সিপিএমের স্থানীয় লোকাল কমিটির সদস্য। সভাপতি হিমাংশু সরকার আরএসপি নেতা। স্কুলে ফতোয়া জারির খবর পেয়ে দুই দলের নেতৃত্বই ক্ষুব্ধ। সিপিএমের জলপাইগুড়ি জেলা সম্পাদক কৃষ্ণ বন্দ্যোপাধ্যায় বলেন, “পরিচালন সমিতির সম্পাদক কী আইন তৈরি করেন! ফতোয়া জারির কোনও এক্তিয়ার তাঁর নেই। ঘটনাটি জানার পরে দলের তরফে আপত্তি জানানো হয়েছে। এখন আর কোনও সমস্যা নেই।” দলের জেলা সম্পাদকমণ্ডলীর সদস্য তথা প্রাক্তন সাংসদ মিনতি সেন বলেন, “চুড়িদার মোটেই দৃষ্টিকটু নয়। সুবিধার জন্য মেয়েরা সেটা ব্যবহার করে। সমাজ অনেক এগিয়েছে। তাই ওই পোশাক নিয়ে বিতর্কের অবকাশ নেই।” এ দিকে আরএসপির আলিপুরদুয়ার ২ জোনাল কমিটির সম্পাদক গুরুদাস ভৌমিক বলেন, “সোমবার স্কুল পরিচালন সমিতির সভাপতিকে ডেকে পাঠিয়ে জানতে চেয়েছিলাম কী হয়েছে। শুনলাম ওঁরা মুখে বলেছেন চুড়িদার না পরে আসতে। এর পরে সভাপতিকে সতর্ক করা হয়েছে, ভবিষ্যতে যেন ওই ঘটনা না ঘটে।” অবাক আলিপুরদুয়ার মহকুমা অতিরিক্ত বিদ্যালয় পরিদর্শক মণীন্দ্রনাথ সরকারও। তিনি বলেন, “পোশাক নিয়ে ফতোয়া মানা যায় না। বিষয়টি খোঁজ নিয়ে প্রয়োজনীয় ব্যবস্থা নেব। তবে শিক্ষিকারা এখনও আমাকে কিছু জানাননি।”
যদিও সম্পাদক রমেশবাবু বলেন, “দৃষ্টিকটু লাগায় আমি শিক্ষিকাদের চুরিদার না পড়ে শাড়ি পড়তে অনুরোধ করেছি মাত্র। কোনও ফতোয়া দেওয়া হয়নি।”
কিন্তু ওই সমিতির সদস্য বামফ্রন্টেরই মনোরঞ্জন দাস বলেন, “শিক্ষক শিক্ষিকাদের সঙ্গে খারাপ ব্যবহার করেন সম্পাদক ও সভাপতি। এমনকী শিক্ষিকাদের সম্প্রতি পোশাক নিয়েও ফতোয়া জারি করেছেন তাঁরা। এ সব মেনে নেওয়া সম্ভব না হওয়ায় সোমবার প্রধান শিক্ষকের কাছে লিখিতভাবে সম্পাদক ও সভাপতির বিরুদ্ধে অনাস্থার কথা জানানো হয়।” প্রধান শিক্ষক সৌমেন রায় বলেন, “পোশাক নিয়ে ফতোয়া জারির বিরোধিতা করেছিলাম আমিও। সম্পাদক তাতে কর্ণপাত করেনি।” তিনি বলেন, “পরিচালন সমিতির সিংহভাগ সদস্য সভাপতি ও সম্পাদকের বিরুদ্ধে অনাস্থার চিঠি দিয়েছেন।”
স্কুলে শিক্ষিকা রয়েছেন ৬ জন। শিক্ষক ১১ জন। পড়ুয়ার সংখ্যা ৭৮০। নাম প্রকাশে অনিচ্ছুক স্কুলের একাধিক শিক্ষিকা বলেন, “দু’মাস আগে সম্পাদক ও সভাপতি ডেকে চুড়িদার পড়ে স্কুলে আসতে মানা করেন। এর পরে কিছুদিন শাড়ি পড়ে স্কুলে যাতায়াত করি। এর পরে ফের চুড়িদার পড়লে সম্পাদক ছাত্রছাত্রীদের সামনে আমাদের অপমান করেন। এর পর থেকে ভয়ে শাড়ি পড়ে যাচ্ছি।” |