কখনও সরস্বতী পুজোর কমিটি গঠন, কখনও ছাত্র সংসদের নির্বাচনে প্রার্থী বাছাই, আবার কখনও ছাত্র সংসদের সাধারণ সম্পাদক নির্বাচনকে কেন্দ্র করে বার বার প্রকাশ্যে এসেছে তৃণমূল ছাত্র পরিষদের গোষ্ঠীদ্বন্দ্ব। গোষ্ঠীদ্বন্দ্বের জেরে উত্তর ২৪ পরগনার অশোকনগর নেতাজি শতর্বাষিকী মহাবিদ্যালয়ে ব্যাহত হয়েছে পঠনপাঠন। কখনও আবার কোনও বিষয় ছাড়াই দু’পক্ষের মারপিট বেধে গিয়েছে। বস্তুত, বিধানসভা নির্বাচনের পর থেকে এই কলেজে তৃণমূল ছাত্র পরিষদের কোন গোষ্ঠী কর্তৃত্ব করবে তা নিয়েই বিবাদের সূত্রপাত। অধ্যক্ষকে কটূক্তি, শিক্ষক-শিক্ষিকাদের ঘেরাও করে রাখা থেকে কলেজের গেটে তালা ঝুলিয়ে দেওয়া, কোনও কিছুই বাদ যায়নি। দু’পক্ষের এই মারামারিতে যোগ দেয় বহিরাগতরা। সংঘর্ষে আহত হয়ে কারও মাথা ফাটে। কারও হাত-পা ভাঙে। অনেক ছাত্রছাত্রীকেই হাসপাতালে ভর্তি হতে হয়েছে। এ ব্যাপারে অশোকনগর থানাতেও বিস্তর অভিযোগ জমা পড়ে। কার্যত বিরোধীশূন্য এই কলেজে ছাত্র সংসদের নির্বাচনে অন্য কোনও ছাত্র সংগঠনকে প্রতিদ্বন্দ্বিতা করতে দেওয়া হয় না বলে অভিযোগ ওঠে।
এসএফআইয়ের অভিযোগ ছিল, মনোনয়নপত্রগুলি তৃণমূল ছাত্র পরিষদের সদস্যরা লুঠ করে পুড়িয়ে দেয়। ছাত্র সংসদের নির্বাচনের পর সংশ্লিষ্ট সবপক্ষই আশা করেছিলেন এ বার হয়তো গোলমাল থামবে। কলেজে পঠনপাঠনের সুষ্ঠু পরিবেশ ফিরবে। কিন্তু ভোট পর্ব মিটে যাওয়ার পর দিন কয়েক পরিস্থিতি শান্ত থাকলেও ছাত্রভর্তিকে কেন্দ্র করে ফের দুই গোষ্ঠীর বিবাদ শুরু হয়। গত বৃহস্পতিবার থেকে সোমবার পর্যন্ত দফায় দফায় সংঘর্ষ, মারামারির ঘটনা ঘটে। সব মিলিয়ে কলেজের পঠনপাঠন শিকেয়। কলেজের বর্তমান অবস্থায় ভয়ে অনেক ছাত্রছাত্রীর অভিভাবকেরা তাঁদের ছেলেমেয়েদের কলেজে পাঠানো বন্ধ করে দিয়েছেন। কলেজে তৃণমূল ছাত্র পরিষদের গোষ্ঠীদ্বন্দ্বের জেরে গোলমালে মদত দেওয়ার অভিযোগে উঠে এসেছে অশোকনগর ব্লক তৃণমূল ছাত্র পরিষদের সভাপতি পাপন সরকার এবং আর এক তৃণমূল ছাত্র নেতা প্রদীপ সিংহের নাম। যদিও কলেজে নিরন্তর গণ্ডগোলের জেরে পড়াশোনা ব্যাহত হওয়ার জন্য কলেজ কর্তৃপক্ষের বিরুদ্ধে দায় এড়ানোর অভিযোগ ইতিমধ্যেই উঠেছে। অভিযোগ উঠেছে, স্থানীয় তৃণমূল নেতৃত্বের বিরুদ্ধে পাপন ও প্রদীপকে ‘মদত’ দেওয়ার। গত কয়েক মাস ধরে কলেজে গণ্ডগোলের জেরে
পরিস্থিতি এতটাই খারাপ হয়েছে যে স্থানীয় বাসিন্দারাও নিত্য কলেজে গোলমালের ঘটনায় ধৈর্য্য হারিয়েছেন। তাঁদের অভিযোগ, কলেজের গোলমাল এলাকাতেও ছড়িয়ে পড়ে অশান্তি ছড়াচ্ছে।
এই পরিস্থিতিতে কলেজের সুনাম রক্ষায় এবং ছাত্রছাত্রীদের পড়াশোনার কথা মাখায় রেখে সব পক্ষকে নিয়ে সোমবার কলেজ কর্তৃপক্ষ একটি বৈঠক ডাকেন। বৈঠকে অধ্যক্ষ সুধানাথ চট্টোপাধ্যায়, পরিচালন সমিতির সভাপতি বাবুল কর, ওসি সুরেন্দ্রকুমার সিংহ, বিধায়ক ধীমান রায়, কংগ্রেস নেতা গুরুদাস চট্টোপাধ্যায়, অশোকনগর-কল্যাণগড় পুরসভার চেয়ারম্যান সমীর দত্ত ও ভাইস চেয়ারম্যান প্রবোধ সরকার প্রমুখ উপস্থিত ছিলেন। কলেজ কর্তৃপক্ষ ও পুলিশ সূত্রে জানা গিয়েছে, বৈঠকে সিদ্ধান্ত হয়েছে পাপন ও প্রদীপকে কলেজে ঢুকতে দেওয়া হবে না। ঢুকতে পারবে না কোনও বহিরাগত। ঢুকতে গেলে অধ্যক্ষের লিখিত অনুমতিপত্র লাগবে। যে সব পড়ুয়াদের কলেজের পরিচয়পত্র নেই, তাঁদের কলেজে ঢোকার জন্য আপাতত হাতে লেখা অনুমতিপত্র দেওয়ার সিদ্ধান্ত হয়েছে। কলেজের মূল ফটকে বেসরকারি দুই নিরাপত্তারক্ষী নিযুক্ত করা হবে। কলেজে গত কয়েক মাসে গোলমালের ঘটনায় যাঁদের নাম জড়িয়েছে এবং যাঁদের বিরুদ্ধে থানায় অভিযোগ দায়ের হয়েছে তাঁদের অভিভাবকদের ডেকে গোটা বিষটি জানানো হবে। ভবিষ্যতে অভিযুক্তদের কেউ ফের গোলমালে জড়ালে তাঁকে কলেজ থেকে বহিষ্কার করা হবে।
এ দিকে যাঁদের বিরুদ্ধে কলেজে গোলমালে ‘মদত’ দেওয়ার অভিযোগ উঠেছে তাঁদের একজন পাপন বলেন, “কলেজে যদি পঠনপাঠনের স্বাভাবিক পরিবেশ থাকে তাহলে আমি কোনওদিন সেখানে যাব না।” প্রদীপের কথায়, “আমরা শিক্ষার সুষ্ঠু পরিবেশের পক্ষে। তবে কলেজ কর্তৃপক্ষের কাছে আমার অনুরোধ এমন কিছু ছাত্রছাত্রী আছেন, যাঁরা একইসঙ্গে দু’তিনটি কলেজে ভর্তি হয়েছেন। তাঁদের চিহ্নিত করে বহিষ্কার করা হোক।” পাশাপাশি বিধায়ক ধীমানবাবু কলেজে সময়মতো অধ্যক্ষ ও শিক্ষক-শিক্ষিকাদের আসার উপরে জোর দিয়েছেন। আর সমীরবাবুর হুমকি, “কলেজে শিক্ষার সুষ্ঠু পরিবেশের স্বার্থে বৈঠকে যে সব সিদ্ধান্ত হয়েছে সেগুলি যদি ঠিকমতো পালিত না হয়, তাহলে কাউন্সিলারদের নিয়ে কলেজ ঘেরাও করা হবে।” প্রবোধবাবু বলেন, “কলেজে সুষ্ঠু শিক্ষার স্বার্থেই এই সিদ্ধান্তকে সকলের স্বাগত জানানো উচিত।”
তবে বৈঠকে নেওয়া সিদ্ধান্তকে স্বাগত জানিয়েছেন ছাত্রছাত্রী এবং অভিভাবকেরা। তাঁদের বক্তব্য, কলেজে পড়াশোনার স্বার্থে এই ধরনের সিদ্ধান্ত আরও আগে নেওয়া হলে পড়ুয়াদের উপকার হত। পাশাপাশি তাঁদের দাবি, ছাত্র সংগঠনগুলির মধ্যে বিবাদ-সংঘর্ষে যে সব কলেজের পঠনপাঠন ব্যাহত হচ্ছে সেখানেও সব পক্ষের সঙ্গে আলোচনা সাপেক্ষে এই ধরনের সিদ্ধান্ত গৃহীত হোক।
|