বীভৎস মজা’ কথাটি আজ বাঙালির নৈমিত্তিক শব্দভাণ্ডারে ঠাঁই পেয়েছে। যে কলকাতা মন্বন্তর দেখেনি, দেশভাগ দেখেনি, দাঙ্গা দেখেনি, সে শহরও আজ সিনেমায় ও সিনেমার বাইরে অনেকখানি বাস্তব। কিন্তু সুনীতা উইলিয়ামস মহাকাশ স্টেশন থেকে অলিম্পিক দেখবেন, এ কথা পঞ্চাশ বছর আগের ঈশ্বর চক্রবর্তীর জানা ছিল না। যেমন তার বোন সীতার জানা ছিল না, এক দিন পিঙ্কি প্রামাণিক সাংবাদিকদের জানাবেন নিজের অগ্নিপরীক্ষার বিবরণ। সীতা জানতই না আরও অনেক দিন সর্বনাশের মধ্যরাতে তাকে দরজা খুলে দিয়ে দেখতে হবে নিয়তি অপেক্ষমাণ: ঈশ্বর! ঋত্বিককুমার ঘটকের ‘সুবর্ণরেখা’ পঞ্চাশ বছরে পা দিল, কিন্তু কলকাতা থেকে ছাতিমপুরের দূরত্ব তিলমাত্র কমেনি। টেলিফোটো লেন্সে ধরা সীতার সেই মৃত চক্ষু ফ্রেমের বাইরে এসে আমাদের শনাক্ত করে যায় অবিরত।
সুবর্ণরেখা বহুচর্চিত, প্রায় কিংবদন্তিপ্রতিম। শিল্পকর্ম হিসেবে তাকে সমর্থন বা বিরোধিতার চাইতেও যা জরুরি, তা হল, ঋত্বিক এই ছবিতে ইতিহাস রচনার নুড়িপাথর অন্য ভাবে সাজাতে চেয়েছেন। সে দিক থেকে ভাবলে সুবর্ণরেখা হয়তো ভারত চরিত মানস। কী অন্যমনস্কই না আমরা ছিলাম! দেখতেই পাইনি, ছাতিমপুর নামের স্টেশনটিতে যখন অভিরাম মরণোন্মুখ হতভাগিনীর মুখে হারিয়ে যাওয়া মায়ের পরিচয়পত্র খুঁজে পায়, তখন আমাদের যাবতীয় সংস্কারে বিস্ফোরণ ঘটে।
এই মা প্রকৃতই কৌশল্যা কিন্তু ইক্ষ্বাকুবংশীয়া রাজমাতা নন, বাগদি-বউ। স্টেশন চত্বরে যে ছেলেকে আর্তনাদ করতে দেখি, সেও অযোধ্যার রাজপুত্র নয়, অন্ত্যজ ও অনার্য। সুবর্ণরেখার পাশ দিয়ে অশৌচজনিত পোশাকে যখন সে কনেবেশী সীতাকে সঙ্গী করে নেয়, তখন বিরহ মধুর হতে পারে, কিন্তু বোঝা যায় এক ‘অন্দর’ ইতিহাসের প্ররোচনায় ঋত্বিক নায়কের সিংহাসনে অন্ত্যজকে বরণ করে নিচ্ছেন। হে পাঠক! খেয়াল করুন, ইতিহাসের সাব-অলটার্ন পাঠ তখনও শুরুই হয়নি। এমনও নয় যে চিত্রনাট্য আধুনিক দলিত রাজনীতির অনুসিদ্ধান্ত। তখন মার্ক্সবাদীরা তো বটেই, অন্যান্যরাও পশ্চিমবাংলায় জাতপাতের তত্ত্ব নিয়ে অত মগ্ন ছিলেন না। বরং অবাক হয়ে যাই যে, ঋত্বিকের লোকেশন আজ মাওবাদী রাজনীতির হাত ধরে রাষ্ট্রের মূল আখ্যানটিকে প্রশ্ন করছে। |
হতেই পারতেন ওঁরা কোকরাঝাড়ের মানুষ। ‘সুবর্ণরেখা’র একটি দৃশ্য। |
প্রজাতন্ত্র নয়, ছবির সূচনাতেই ছাব্বিশে জানুয়ারি জালিওয়ানালাবাগ দিবস হিসেবে চিহ্নিত হয়েছে। কিন্তু ঋত্বিকের প্রত্যাঘাত তো শুধু প্রত্যক্ষ রাজনীতির স্তরে নয়। তার মূল লক্ষ্য গল্পবিস্তার নয়, বরং দর্শন ও ইতিহাস। আমরা সম্প্রতি হয়তো মিশেল ফুকো প্রমুখ মহাজন সান্নিধ্য করে যুক্তিবাদ ও ‘আলোকপ্রাপ্তি’কে সন্দেহ করতে শিখেছি। ঋত্বিকের ইতিহাসবোধ ‘সুবর্ণরেখা’য় এনলাইটেনমেন্টের সোজা পথ মেনে নেয়নি। মনে করি কারখানার ভেতরের সেই দৃশ্য, যেখানে গাগারিনের অভিকর্ষ অতিক্রমের ছাপা হেডিং ‘মানুষ চূর্নিল যবে নিজ মর্ত্যসীমা’ উপহসিত হয় বয়লারের দাউ দাউ আগুনে। পরবর্তী ডিজলভ সীতার নিম্নবিত্ত কলোনিজীবনে ফিরে এলে মনে হয় ‘বিজ্ঞানের বিজয়-বৈজয়ন্তী’ কি সত্যিই পারে মনের সংস্কার ও অন্ধকারের পাঁচিল পার হতে?
বাস্তুহারা কলোনির নিতান্ত স্থানিক ও কালিক বিপর্যয়কে গাঁধী প্রয়াণের মতো ইতিহাস পতনের সঙ্গে জুড়ে দিয়ে ঋত্বিক আসলে অবতরণ করতে চান এক পুরাণকথার পৃথিবীতে, সেখানে বৃদ্ধটি টাইরেসিয়সের মতো বিলাপোক্তি উচ্চারণ করে যায়। বেশ্যালয়ে ‘হে রাম’ কে বলেছিল? এই খেদ কোনও চরিত্রের মুখনিঃসৃত নয়। নায়িকার আত্মহত্যার পর পরিচালক যে নায়িকার অন্তিম উচ্চারণকে দূরাগত ও নৈর্ব্যক্তিক ভাবে ব্যবহার করেন তার কারণ, তিনি সীতার অন্তিম অগ্নিপরীক্ষা বিষয়ক কাহিনিটিকে চালনা করেন অন্তর্ঘাতের দিকে। ইতিহাস যাকে ধারণ করেনি, এমন অতীত ও সাম্প্রতিক বর্তমানকে তিনি একটি গ্রন্থিতে জুড়ে দেন। সমস্ত আখ্যান জুড়েই ‘সুবর্ণরেখা’ সময়ের দুটি স্তরকে কাছে ডেকেছে। পরিত্যক্ত রানওয়েতে পরিপ্রেক্ষিত পাল্টে দিয়ে যখন তিনি সীতার প্রভাতসংগীত নথিভুক্ত করেন, তখন সীতা চকিতে মীরাবাঈ’তে রূপান্তরিত হয়ে যায়; এক বৃদ্ধের দূরাগত সান্ত্বনাবাক্য মনে হয় আকাশবাণী যে, এ বালিকা আসলে আমাদের সভ্যতার রূপক: জনকনন্দিনী সে কৃষিকন্যা!
রামায়ণ বা মহাকাব্যের উপাদান ব্যবহার করলেও সুবর্ণরেখা এতই মৌখিক লোক-আখ্যানের ট্যাপেস্ট্রি যে, ঔপনিবেশিকতার আড়ালে হারিয়ে যাওয়া কোনও গহন ধারাকে মুক্ত করা বরং তাঁর অভিপ্রেত।
মনে পড়ে জীবনানন্দ দাশকে:
‘দূরে কাছে কেবলই নগর। ঘর ভাঙে;
গ্রাম পতনের শব্দ হয়;
মানুষেরা ঢের যুগ কাটিয়ে দিয়েছে পৃথিবীতে,
দেয়ালে তাদের ছায়া তবু
ক্ষতি, মৃত্যু, ভয়,
বিহ্বলতা বলে মনে হয়।’
প্যালেস্তাইনে, গুয়াতেমালায়, শ্রীলঙ্কায় বা কোকরাঝাড়ে গৃহচ্যুত মানুষ কেবলই আশ্রয় খুঁজে ফেরে। স্থানচ্যুতি, নির্বাসন, লুকিয়ে থাকা তার থেকেও এক জন ছিন্নমূল মানুষের আতঙ্কের হল দু’টি স্মৃতির মধ্যবর্তী শূন্যতার পরিসর। যার কোনও শিকড় নেই, তার সাংস্কৃতিক ঠিকানা কী হবে? তাঁর ইমেজ কাহিনির বেড়াজাল ভেঙে উপচে পড়ে। রেল স্টেশনে মাতৃ আবিষ্কারের মুহূর্তে ঋত্বিক শব্দের যে ভয়াবহ মন্তাজ তৈরি করেন, তা বিধ্বস্ত করে দেয় আমাদের পলকা নিরাপত্তামদির গার্হস্থ্য জলবায়ু। ‘সুবর্ণরেখা’র দু’পাড়েই পতন-অভ্যুদয়ময় ভারত সভ্যতার যাত্রাপথ উৎকীর্ণ। ‘সুবর্ণরেখা’ অতিশয়োক্তি ও সমাপতনের আড়ালে শিল্প ও ইতিহাসের চুক্তিপত্র। |