অশোক মিত্র-র ঋজু আক্ষেপ ‘এই গুন্ডাভোগ্য বসুন্ধরাই কি আমরা চেয়েছিলাম’ সশ্রদ্ধ সহমতের সঙ্গে একটি তিক্ত প্রশ্নও তুলতে বাধ্য করে। সমাজে ‘শূদ্রায়ণ’, ‘বৈশ্যায়ন’ যেমন কাম্য নয়, তেমনই যে ‘আধিপত্যায়ন’ বিদ্যমান, সেটা বজায় থাকাও কাম্য নয়। সমাজে সকল মানুষ সমান মর্যাদা ও সুযোগের অধিকারী হয়ে পূর্ণ মানবের পরিচিতি অর্জন করবে এটাই কাম্য। কিন্তু বড় সমস্যাটা এই যে, সাংস্কৃতিক উৎকর্ষ ও সাহচর্যে মিত্র মশাইয়ের মনন ও কলম এত পরিশীলিত, সেখানে পূর্ণ মানবের ধারণাটা তাঁদের উচ্চবর্ণীয় স্বাজাত্যবোধের বাইরে বড় একটা যেতে পারেনি। মানুষের সমানতার কথা বলা হয়েছে যত বেশি, সমমর্যাদার বিশ্বাস করা হয়েছে তত কম। না-হলে, মুদ্রিত বাংলা ভাষা ও সাহিত্যচর্চার জগতে নক্ষত্রবিশেষ অশোক মিত্রর কলম ‘ফস্কে’ কী করে বেরিয়ে আসে ‘চুরিচামারি’র মতো একটা শব্দ? নীতিশীলতার ক্ষয় ও তার বৈশ্যসংস্কৃতির প্রাবল্য নিয়ে মনস্তাপের প্রকাশ (‘...মুনাফা বাড়াও, চুরিচামারি করে হলেও...’) দুটো বিপরীত ধর্মী জীবিকার সমার্থে প্রকাশের ব্রাহ্মণ্য ধারাটাকেই আশ্রয় করল কেন? ‘চুরি’র মতো একটা ঘৃণ্যতাকে ‘চামারি’র মতো একটা স্বেদ-পবিত্র কাজের সঙ্গে যোগ করে দেওয়া হয়েছিল, চামারদের নিম্নবর্ণ বা পরিচিতিটাকে আরও ঘৃণ্য ও শোষণসুলভ করে তুলতে।
মিত্রমশাই ব্যক্তিগত ভাবে চামারদের ঘৃণা করেন, এমন কথা নিশ্চয়ই মনে করি না, বরং তাঁদের প্রতি তাঁর সশ্রদ্ধ থাকাই স্বাভাবিক। কিন্তু সমাজে সাংস্কৃতিক দৈন্যের বিরুদ্ধে তিনি যে সাংস্কৃতিক উৎসটি থেকে কথা বলেন সেটিই যদি একটা যুক্তিরোধী কারাগার হয়, তা হলে সেই সংস্কৃতিরও পরীক্ষা-নিরীক্ষার প্রয়োজন। বৈশ্যায়ন-বিরোধিতাটা যত জরুরি, ততটাই অপরিহার্য সামাজিক ন্যায্যতার একটা যুক্তিসিদ্ধ অনুসন্ধান যেখানে চোর ঘৃণিত হবে আর চামার সম্পূর্ণ স্বাধীন ভাবে নিজের মতো থাকার এক পূর্ণ মানবিক অধিকার অর্জন করবে।
অনাম দাস। মহুলবনী, পশ্চিম মেদিনীপুর
|
‘গুন্ডাভোগ্য বসুন্ধরা’ শব্দবন্ধটি উপহার দেওয়ার জন্য (২০-৮) অশোক মিত্রকে ধন্যবাদ। বসুন্ধরার এই অংশকে গুন্ডাভোগ্য করার কারিগর যে সি পি এম, সে ব্যাপারে আশা করি কোনও দ্বিমত নেই তাঁর।
অশোকবাবু তাঁর পূর্বতন বন্ধু-জমানাকে ‘রবীন্দ্র নজরুল সুকান্ত’ প্রসঙ্গে এই ‘ধারা বলে’ অভিযুক্ত করেছেন। কিন্তু তাঁদেরই বা এ ক্ষেত্রে কী করার ছিল? অর্থ, সময় ও সদিচ্ছা একাসনে মেলাতে গেলে আমাদের মতন রাজ্যে এর বিকল্প কী? আর মহাকরণে যখন পাশাপাশি রাখা প্রাক্তন প্রধানমন্ত্রী রাজীব গাঁধী এবং লেখক-কবি জ্যোতিরিন্দ্র নন্দীর ছবিতে মুখ্যমন্ত্রী ১৯ অগস্ট মালা পরান, তখন এই ঘটনাকে এক জন কংগ্রেসি আপনার ভাষায়, ‘মুড়ি ও মুড়কিকে একাসনে বসিয়ে দেওয়া হচ্ছে’ বলবে। অশোকবাবু পূর্বনির্ধারিত অসূয়া যদি বর্জন করতে পারতেন, তা হলে এই অভূতপূর্ব ঘটনার জন্য মুখ্যমন্ত্রী মমতা বন্দ্যোপাধ্যায়কে দু’হাত তুলে অভিবাদন জানাতেন এবং বলতে পারতেন: এমন ঘটনা মুখ্যমন্ত্রী মমতার সাত জন পূর্বসূরির কারও কাছ থেকে আশা করাটাও ছিল চরম অবিমৃশ্যকারিতা। |
মহাকরণে রাজীব গাঁধী ও জ্যোতিরিন্দ্র নন্দীর ছবিতে মাল্যদান। |
‘মুখ্যমন্ত্রীকে সামান্য অস্বস্তিকর প্রশ্ন করা অগণতান্ত্রিক, রাষ্ট্রদ্রোহের শামিল। করেছ কী কোতল হয়েছ’। এই অংশটি সম্পর্কে মাননীয় প্রাক্তন অর্থমন্ত্রী অশোক মিত্রকেই প্রশ্ন করি, ‘মন্ত্রিসভার গুরুত্বপূর্ণ সদস্য হিসাবে আপনি তদানীন্তন মুখ্যমন্ত্রীকে ক’টি প্রশ্ন করতে পেরেছিলেন? আর যে ক’টি প্রশ্ন করেছিলেন তার উত্তর আপনি কী ভাবে পেয়েছিলেন?’ মিডিয়ার মুখোমুখি যাতে জ্যোতি বসুকে দাঁড়াতে না-হয় তাই মরিচঝাঁপি ও আনন্দমার্গীদের গণহত্যাকাণ্ডের পর বুদ্ধদেব ভট্টাচার্য মহাকরণের প্রেস কর্নারটাই লুঠ করে নিয়েছিলেন। সে দিন ওই ভাবে সাংবাদিকদের গণতান্ত্রিক অধিকার লুঠ করার দায়ভার অশোক মিত্র অস্বীকার করতে পারেন না। কারণ, অশোকবাবু তখন ছিলেন সেই মন্ত্রিসভার গুরুত্বপূর্ণ সদস্য। সি পি এম লুণ্ঠিত সেই প্রেস কর্নারটিকে আবার ফিরিয়ে এনেছেন মুখ্যমন্ত্রী মমতা। এই ফিরিয়ে আনাটা কি প্রশ্ন ‘করেছ কি কোতল হয়েছ’-র জন্য? মাননীয় অশোক মিত্রকে সবিনয় অনুরোধ করব, মমতা ছাড়া ১৯৪৭ সালের পরের আর এক জন মুখ্যমন্ত্রীর নাম করুন, যিনি রাজ্যে যে কোনও ঘটনা ঘটলে বা মন্ত্রিসভায় যে কোনও আলোচনা হলে তার সারাৎসার প্রেস কর্নারে এসে জানিয়ে গেছেন।
পুরনো কাসুন্দি ঘেঁটে আর অশোকবাবুদের কষ্ট দিতে চাই না। কিন্তু অশোক মিত্র ও সত্যব্রত সেন ছিলেন সি পি এম তাঁবুর সবচেয়ে নির্ভরযোগ্য অর্থনীতিবিদ।
দ্বিতীয় বামফ্রন্ট সরকারের আমল থেকে সি পি এম-এ অশোকবাবু ও সত্যব্রতবাবুর অবস্থান কী ছিল এবং কেন?
অশোকবাবুদের ‘মাওবাদী’ তকমা দেওয়া হয়নি ঠিকই, কেননা তখন ‘মাওবাদী’ কথাটাই আসেনি। কিন্তু যে বিচ্ছিন্নকরণ প্রক্রিয়ায় এই দুই মার্কসবাদী অর্থনীতিবিদকে নিক্ষেপ করা হয়েছিল, তা অশোকবাবুর থেকে ভাল কে জানে! এবং সেটা যে অপ্রিয় কিছু প্রশ্ন করার জন্যই, তাও সবচেয়ে ভাল জানেন অশোক মিত্র মহাশয় স্বয়ং।
আর মাওবাদী বলে যাকে বেলপাহাড়িতে গ্রেফতার করা হয়েছে, সেই প্রসঙ্গে বলি, বেলপাহাড়ির মতন জায়গায় জেড প্লাস নিরাপত্তা বলয় ভেঙে কেউ যদি ঢুকে পড়ত জ্যোতি বসু বা বুদ্ধদেব ভট্টাচার্যর বলয়ে তা হলে তার কী পরিণতি ঘটতে পারত, তা কি অশোকবাবুরা জানেন না? ভুলে গেলেন, কলকাতায় জ্যোতি বসুকে ‘আপকো সরকার টিকেগা কেয়া?’ প্রশ্ন করার জন্য সেই অবাঙালি যুবকের ভয়াবহ পরিণতির কথা!
পাচু রায়। কলকাতা-৭০০০৫৫ |