প্রবন্ধ ১... যা দেখি, যা শুনি, একা একা কথা বলি
ভারতীয় পুরুষদের লিবিডো কি বেড়ে গেল, না...

নিউ ইয়র্কের অদূরে, নিউ জার্সি রাজ্যে ছড়িয়ে ছিটিয়ে অনেক বাঙালি বা বাংলাভাষীর বাস। এদের কয়েকটি ক্লাবও আছে। মাঝে মাঝে এরা নানান উৎসবের আয়োজন করে। সে রকমই একটা উৎসব উপলক্ষে আমি উপস্থিত ছিলাম সেখানে। একটা বিশাল স্কুল বাড়ির প্রাঙ্গণে চলছে গান-বাজনা ও নানা রকম উপভোগ্য অনুষ্ঠান, পাশে পাশে শাড়ি ও গয়নাগাটির প্রদর্শনী। আমরা কয়েক জন ভেতরের একটা ঘরে বাংলা ভাষার ভবিষ্যৎ নিয়ে চুল ছেঁড়াছেঁড়ি চালাচ্ছি, আসলে সেটা একটা আড্ডা। এক সময় আমাকে টয়লেটে যেতে হল, সেখানে গিয়েই আমার আক্কেল গুড়ুম! এখানে আক্কেল গুড়ুম ঠিক খাটে কি না তা জানি না, তবে বহু দিন পরে এত বেশি অবাক হয়েছি।
ও দেশের নানান জায়গায় থাকে এক ধরনের মেশিন, তাতে কিছু পয়সা দিয়ে একটা ছবি দেখে টিপলেই বেরিয়ে আসে একটা না একটা কেক বা পেস্ট্রি, আরও বিভিন্ন ধরনের খাদ্যদ্রব্য, এমনকী ঠাণ্ডা পানীয়ের বোতল। এখানে হিসিখানার মধ্যেও রয়েছে সে রকম একটা ছোটখাটো মেশিন, তাতে লেখা রয়েছে, পাঁচ বা দশ পয়সা দিলে পাওয়া যাবে একটি কনডোম। ইস্কুলের এলাকার মধ্যে কনডোম বিক্রির ব্যবস্থা? ফিরে এসে সেই আড্ডায় আমার বিস্ময়ের কথা জানাতেই এক জন মহিলা, যিনি বহু কাল ধরে ও দেশে আছেন, তিনি একটুও বিচলিত না হয়ে বললেন, হ্যাঁ, বেশ কিছু দিন আগে থেকেই এটা চালু হয়েছে। এ ছাড়া উঁচু ক্লাসের ছেলেমেয়েদের কিছুটা সাহায্য করার আর তো কোনও উপায় নেই!
সাহায্য? উঁচু ক্লাসের ছেলেমেয়েরা নানা রকম খেলা করতে শুরু করে, তার মধ্যে আছে শারীরিক খেলাও। এতে বাধা দেবার যে কোনও চেষ্টা করলেও কোনও সুফলও পাওয়া যাবে না, ওরা মানবেই না। অভিভাবকরা প্রায় অনেকেই, ছেলে বা মেয়েকে শাস্তি দেওয়ার কথা ভাবেন না, সেটা নাকি ওদের ব্যক্তিস্বাধীনতায় হস্তক্ষেপ!
এই ছেলেমেয়েদের শারীরিক মিলনের জন্য হন্যে হয়ে জায়গা খুঁজতে হয় না। সে রকম সুযোগ অগাধ। প্রকাশ্য চুম্বন নিয়ে মাথাই ঘামায় না কেউ। যে কোনও ঘাস জন্মানো জায়গায় দু’টি শরীর প্রায় এক হয়ে যায়, গড়াগড়ি দেয়, সে দিকে ফিরেও তাকায় না কেউ। সাময়িক উত্তেজনায় ছেলে ও মেয়েটি একেবারে চরমে চলে যায়, তাতে যদি কোনও মেয়ে গর্ভবতী হয়ে পড়ে, তখনই শুরু হয় নানা রকম বিপদের ছায়াপাত। ছেলেটি কোনও দায়িত্ব না নিয়ে সরে পড়তে পারে। মেয়েটি তো তা করতে পারে না। এমনকী গর্ভপাতের ব্যবস্থা থাকলেও একটা সতেরো-আঠারো বছরের মেয়ে তাতে রাজি হতে না-ও পারে। তখনও তার শ্বশুরবাড়ি বলতে কিছু নেই, কারণ তার তো বিয়েই হয়নি। তার বাবা-মা’ও এই অবস্থায় তাকে কাছে টেনে নিতে চায় না, তা হলে সে এক অতি শিশুকে সঙ্গে নিয়ে কোথায় যাবে, কী ভাবে বাঁচবে। এক বছর আগেও যে মেয়েটিকে স্বাস্থ্যোজ্জ্বল, সাহসিনী অবস্থায় দেখেছি, সে এখন সন্তানকে বুকে জড়িয়ে রাস্তার ধারে বসে অসহায় অবস্থায় ফুঁপিয়ে ফুঁপিয়ে কাঁদছে। রাস্তার ধারে ঝোপেঝাড়ে যে মাঝে মধ্যেই কোনও সদ্য শিশুর কান্নার আওয়াজ শোনা যায়, তা-ও নিশ্চিত ভাবেই এই রকম অবস্থারই একটি দুঃখজনক, কালো দিক। সেই জন্যই শিশুটিকে বাঁচানো ও তার মানে সুস্থ জীবনে ফেরাবার জন্য ওদের সামনে দুলিয়ে দেওয়া হচ্ছে কনডোম।
এ রকম ঘটনা দেখলেই যে আমরা এত বিস্মিত হই, ভেতরে ফুসফুস করে প্রতিবাদ, তার কারণ কী? আসল কারণ, আমাদের নৈতিক আপত্তি। আমাদের মধ্যে এক এক জনের এক এক রকম বিশ্বাস থাকতে পারে, কিংবা কোনও কিছুতেই বিশ্বাস না থাকতে পারে, কিন্তু যৌন সম্পর্কের ব্যাপারে আমরা এখনও কিছুটা রক্ষণশীল। কেননা, প্রকৃতিদেবী যিনি আমাদের ঘাড় ধরে বিভিন্ন জায়গায় ঘোরাচ্ছেন, তাঁর বিচারে তো এই সব ছেলেমেয়ের যৌন স্বাধীনতার দাবির মধ্যে অস্বাভাবিক কিছু নেই। মেয়েদের বোধহয় দশ-এগারো বছরে আর ছেলেদের সতেরো-আঠারো বছরে যৌন চেতনা এসে যায়, আর প্রথম প্রথম তা যেন বেশ অশান্ত থাকে। প্রকৃতি তখন ওদের বলতে থাকে, সন্তান উৎপাদন বাড়াও, যত পারো বাড়াও। তবু আমরা যে অনেকেই কিছুটা সংযত থাকি, সন্তান-সম্ভাবনা জমিয়ে রাখি ভবিষ্যতের জন্য, তার কারণ মোটেই বিজ্ঞানসম্মত নয়, সামাজিক, আর সেই সামাজিকতার নানান ধারা আমরা নিজেরাই তৈরি করে রেখেছি। বিয়ে নামে কৃত্রিম ব্যবস্থাটাও রয়েছে এর মধ্যে। বিয়ের প্রথার মূল উদ্দেশ্য দু’টি। নিজের পরিবারের ধারাবাহিক অগ্রগতি রক্ষা করা। (পুত্রার্থে ক্রিয়তে ভার্যা, অর্থাৎ ছেলেরাই বংশ রক্ষা করবে, এটা সম্পূর্ণ একটা ভুল ধারণা, চলে আসছে বহু দিন ধরে; মেয়েরাও বংশ রক্ষা করে যেতে পারে অবশ্যই।) আর দ্বিতীয় কারণ হচ্ছে বিষয়সম্পত্তির সুষ্ঠু ভাগাভাগি। যাতে সব কিছু চিলুবিলু না হয়ে যায়। যদিও তা হচ্ছে এখনও। ভাইয়ে ভাইয়ে বা আত্মীয়স্বজনের ঝগড়া ও মারামারি নিয়েই তো লেখা হয়েছে পৃথিবীর আদি সব মহাকাব্য। এখন নাকি ধষর্ণ-টর্ষণের ঘটনা খুব বেড়ে গিয়েছে। হঠাৎ ভারতীয় পুরুষদের লিবিডো বেশি বেশি চাঙ্গা হয়ে উঠল নাকি? কারও কারও মতে, অরাজক অবস্থায় পড়লেই এই সব অন্যায় কর্ম বেড়ে যায়, শুধু ধর্ষণ নয়, তার সঙ্গে খুনটুনও সমান তালে চলে। আবার অন্য মতে, এর অনেকগুলিই সত্যি নয়। বিরোধীদের সাজানো গল্প। কিছু কিছু সংবাদমাধ্যম সেগুলো রগরগে ভাবে প্রকাশ করে। এই রকম মিথ্যে দিয়ে উত্তেজিত করে তোলা হয় সাধারণ মানুষকে। আগেও এ রকম ধর্ষণের ঘটনা ঘটত, কিন্তু সব প্রকাশের সুযোগ থাকত না। এখন নাকি সাংবাদিকরা টাকা খেয়ে, কিংবা নিজেরা টাকা দিয়ে অনেক কিছু মিথ্যে সাজায়। এই নিয়ে আমরা মনে মনে অনেক কথাই বলি, কিন্তু প্রকাশ্যে কিছু বলতে ইচ্ছে করে না।
এই এক জীবনে আমরা কত রকম চমকপ্রদ ঘটনাই না দেখলাম! তার মধ্যে একটি হচ্ছে বীর্য-ব্যাঙ্ক। এখন যে কোনও রমণীই কোনও পুরুষের সঙ্গে ঘনিষ্ঠ সংস্পর্শে না এসেও সন্তানের জননী হতে পারে। ওই ব্যাঙ্ক থেকে কোনও অজ্ঞাতনামা পুরুষের বীর্য কিনে আনবে। তার পরের প্রক্রিয়াগুলোও আর তেমন কিছু জটিল নয়।
বেশ তো চলছিল, এরই মধ্যে আর একটি গোলমেলে খবর পাওয়া গেল বিজ্ঞানীদের মহল থেকে। একটি আন্তর্জাতিক বিজ্ঞান সংস্থা জানিয়েছে যে, ভারতীয় পুরুষদের (হ্যাঁ, বিশেষ করে ভারতীয় পুরুষদের) বীর্যে কিছু কিছু দুর্বলতা দেখা যাচ্ছে। নানা কারণে। তার মধ্যে অন্যতম রেডিয়েশন-এর বিস্তার। এই দুর্বল বীর্য নিয়ে তাদের সন্তানের জন্ম দেওয়ার ক্ষমতাও কমে যাবে, কিংবা তারা দুর্বল সন্তানের জন্ম দেবে। সংখ্যাটা অবশ্য এখনও খুব বেশি নয়, শতকরা দুটি মাত্র। কিন্তু আমরা তো অনবরতই দেখছি, এই ধরনের ঘটনা কখনও কমে না, বাড়তেই থাকে। তা হলে কি অদূর ভবিষ্যতে, কিংবা দূর ভবিষ্যতে এই অবস্থা বাড়তে বাড়তে এমন একটা চূড়ান্ত অবস্থায় আসতে পারে, যখন ভারতীয় পুরুষদের সন্তানের জন্ম দেওয়ার ক্ষমতা একেবারেই চলে যাবে? কোনও পুরুষই যদি আর না থাকে, তা হলে নরীবাদীরাই বা আন্দোলন করবে কার বিরুদ্ধে? এরই মধ্যে একটামাত্র আশার কথা এই যে, এই অবস্থা থেকে অনেক আগেই আমি কেটে পড়তে পারব পৃথিবী থেকে।

একটি বছর পাঁচেকের শিশুকে নানান গল্প শোনায় তার মা। ভূত-প্রেত বা যুদ্ধ-বিগ্রহের গল্প এড়িয়ে যেতে চেষ্টা করে মা, যাতে ছোটবেলা থেকেই তার ছেলে ওই সব কুসংস্কার থেকে মুক্ত থাকতে পারে। কিন্তু বাচ্চাদের গল্পে কোথাও না কোথাও দৈত্য-দানো, রূপকথার কাহিনি এসেই পড়ে। ছেলেটি সে রকম কোনও ছবির দিকে আঙুল দেখালে মা তখন সেই গল্প শোনাতে বাধ্য হলেও বার বার বোঝাতে থাকে যে এই সব আসলে কোথাও নেই। ডানাওয়ালা পক্ষীরাজ ঘোড়া, কিংবা দৈত্য-রাক্ষসদের সঙ্গে ভীমের লড়াই, এ সবই কল্পনা, মানুষের ইমাজিনেশন। এক সময় ওরা তিন জনে মিলে বেড়াতে গেল আমেরিকার এক প্রান্তে একটা পেট্রিফায়েড ফরেস্ট-এ। সেখানে মাইলের পর মাইল সবুজ গাছপালা। সে রকম একটা জায়গাতেই গাড়ির গতি কমিয়ে দিল বাবা। খুব কাছে এসে দেখা গেল, তার দিয়ে ঘেরা সেই স্থানটি একটি ছোটখাটো চিড়িয়াখানাও বটে। প্রথমেই চোখে পড়ল, একটা ঝাঁকড়া গাছের নীচে বসে আছে একটা ভাল্লুক। বাচ্চা ছেলেটি সে দিকে আঙুল দেখিয়ে বলে উঠল, ওই তো এক জন রাজকুমারী। শি ইজ আ প্রিন্সেস, শুধু তার বাবা-মা’ই নয়, কাছাকাছি কিছু লোকও এই কথা শুনে অবাক। একটা ভাল্লুক দেখেই তাকে রাজকুমারী বলল কেন বাচ্চাটি। তার মা তাকে এই কথাটা জিজ্ঞেস করতেই অয়ন নামে বাচ্চাটি বেশ জোরের সঙ্গে বলে উঠল, ‘আই ইউজ্ড মাই ইমাজিনেশন, আমি কল্পনা করেছি।’


First Page| Calcutta| State| Uttarbanga| Dakshinbanga| Bardhaman| Purulia | Murshidabad| Medinipur
National | Foreign| Business | Sports | Health| Environment | Editorial| Today
Crossword| Comics | Feedback | Archives | About Us | Advertisement Rates | Font Problem

অনুমতি ছাড়া এই ওয়েবসাইটের কোনও অংশ লেখা বা ছবি নকল করা বা অন্য কোথাও প্রকাশ করা বেআইনি
No part or content of this website may be copied or reproduced without permission.