কলিকাতা ও শহরতলিতে অটোর দৌরাত্ম্য অব্যাহত। একে তো অটো-চালকদের অমানবিক আচরণ, সওয়ারি ও পথচারীদের সহিত আপত্তিকর ব্যবহার, বেশি ভাড়া দাবি, ট্রাফিক আইন না-মানিয়া বেপরোয়া গাড়ি চালানো ইত্যাদি সমস্যা আছেই। উপরন্তু যখন-তখন পুলিশি হয়রানির প্রতিবাদে যে কোনও রুটে অটো তুলিয়া লওয়া, সওয়ারিদের সহিত বচসা কিংবা হাতাহাতিতে জড়াইয়া পড়ার পর তাঁহাদের শায়েস্তা করিতে প্রতিহিংসামূলক আচরণ করা কিছুই বাদ নাই। নাগরিকরা উদ্ব্যস্ত। পরিবহণ মন্ত্রী তৎপর হইয়াছেন। তিনি ঘন-ঘন অটো-ইউনিয়নের সহিত আলোচনা করিতেছেন, সমাধানের উপায় বাহির করার চেষ্টাও করিতেছেন। পুলিশকে কড়া নজরদারি করিতে বলিতেছেন। তথাপি আশার আলো দেখা যাইতেছে না।
একটি সমীক্ষার হিসাব, কলিকাতার অটোচালকদের ৯১ শতাংশই স্কুলের গণ্ডিও অতিক্রম করেন নাই, ৯৩ শতাংশকে দিনে ১০ ঘণ্টারও বেশি সময় অটো চালাইতে হয়, শতকরা ৯৪ জনের কোনও-না-কোনও নেশাসক্তি রহিয়াছে। ইহারা কেন ঘন-ঘন আইন ভাঙেন, সওয়ারি বা পথচারীদের সহিত অমানবিক আচরণ করেন, তাহার একটা ব্যাখ্যা এই পরিসংখ্যানে মজুত রহিয়াছে। পরিবহণ দফতর যদি অটোরিক্শ ক্ষেত্রটিতে শৃঙ্খলা আনিতে চায়, তবে অটো-চালকদের সুস্থ জীবনের দিশা দেখাইতে হইবে। কাজটি রাতারাতি হওয়ার নয়। কিন্তু সচেতন প্রয়াস শুরু করা দরকার। অন্য একটি উদ্বেগজনক পরিসংখ্যান দেখাইয়া দেয়, ইউনিয়নে সংঘবদ্ধ অটো-চালকরা বেআইনি ক্রিয়াকলাপে লিপ্ত হইয়াও অব্যাহতি পাওয়ার জন্য নিয়মিত রাজনৈতিক দলের ইউনিয়নকে মোটা অঙ্কের চাঁদা দেন, বছরে যাহার মোট পরিমাণ সাড়ে পাঁচ কোটি টাকা। এই বিপুল অর্থে অনায়াসে অটো-চালকদের স্বাস্থ্য-বিমা করা যাইত। কিন্তু দলীয় ইউনিয়ন এই তহবিল সংগ্রহ করে কেবল বিনিময়ে আইনভঙ্গকারী অটো-চালককে রাজনৈতিক পৃষ্ঠপোষণা তথা অনাক্রম্যতার রক্ষাকবচ পরাইতে। আর এই প্রক্রিয়াতেই বেআইনি অটো, কাটা-তেলে চলা পরিবেশ দূষণকারী অটো, পথচারীকে চাপা দেওয়া কিংবা সওয়ারিকে মারধর করা অটোর চালকরা দাপাইয়া বেড়ান।
আর এ ভাবেই কলিকাতা ও শহরতলিতে ৩৫ শতাংশ অটোই বে-আইনি। অথচ আইনের শাসন বলে, একটি বে-আইনি অটোও কোনও শহরের রাস্তায় বাহির হওয়া উচিত নয়। পরিবহণ মন্ত্রী বে-আইনি অটোর কথা কবুল করিয়াছেন। কিন্তু প্রতিকারের যে পথ বাতলাইয়াছেন, তাহা রোমহর্ষক। কতকটা পুরসভার তরফে বে-আইনি অট্টালিকার কাছে জরিমানা আদায় করিয়া তাহাকে আইনসম্মত করিয়া লওয়ার মতো। সত্য, অটো-চালকরা অধিকাংশই স্বনিয়োজিত। কর্মসংস্থানের অভাবই তাঁহাদের এ পথে টানিয়া আনিয়াছে। তাঁহাদের রুজি নিশ্চিত করার একটা দায় নির্বাচিত সরকারের থাকিতেই পারে। কিন্তু ৩০ হাজার বে-আইনি অটো ‘আইনসম্মত’ হওয়ার পর আরও ত্রিশ হাজার অটো যে লাইসেন্স ছাড়াই মহানগরীর আনাচেকানাচে নূতন করিয়া ছড়াইয়া পড়িবে না, তাহার নিশ্চয়তা কি পরিবহণ মন্ত্রী দিতে পারেন? যদি বে-আইনিকে আইনসম্মত করিয়া তোলার সহজ ব্যবস্থা থাকে, তবে স্বনিযুক্তিপ্রবণ কর্মহীন যুবকেরা তো সেই পথেই যাইবেন। একই পথে কি কলিকাতার ব্যস্ত সড়কগুলির ফুটপাথও কালক্রমে ইউনিয়নবদ্ধ হকারদের জবরদখলে হারাইয়া যায় নাই? |