দাদু ‘নায়ক’, স্মৃতিতেই বিভোর ট্রটস্কির নাতি
“বাচ্চা ছেলেটার সামনে কখনওই রাজনীতির আলোচনা করবে না।” আদরের নাতিটির নিষ্পাপ কৈশোর বাঁচাতে বাড়িতে এমনই ‘ফরমান’ জারি করেছিলেন দাদু। সে-ও প্রায় সাত দশক আগেকার কথা। কিন্তু তাতে কী? ছিয়াশি বছরের সেই নাতির মনে আজও যে তাঁর স্নেহশীল দাদুটির স্মৃতি অম্লান। দুনিয়া না হয় এস্তেবান ভলকভের দাদুকে চিনল রাশিয়ার অন্যতম বিতর্কিত নেতা লিওন ট্রটস্কি হিসাবে। কিন্তু ছিয়াশি বছরের এস্তেবানের কাছে আজও তিনি ‘নায়ক’। যিনি নাতির কৈশোর বাঁচাতে থুড়ি, প্রাণ বাঁচাতে বাড়িতে রাজনীতির আলোচনার উপর ফতোয়া বসাতে পারেন অনায়াসে।
এস্তেবান ভলকভ।
“আসলে তাঁর প্রায় গোটা পরিবারটিই তো এই রাজনীতির লড়াইয়ে শেষ হয়ে যায়। তাই বোধ হয় তিনি নাতিকে প্রাণে বাঁচাতে চেয়েছিলেন” বললেন এস্তেবান। বাস্তবিক। রাশিয়া থেকে নির্বাসিত হওয়ার পর ইউরোপের বিভিন্ন দেশে আশ্রয় পেতে ঘুরে বেড়াত ট্রটস্কি-পরিবার। এই রকম উদ্বাস্তু জীবন কাটাতে কাটাতেই ১৯৩৩ সালে চলে আসতে হয় ফ্রান্সে। আর ঠিক সে সময়ই আত্মহত্যা করেন ট্রটস্কির মেয়ে এবং এস্তেবানের মা জিনাইদা। মায়ের মৃত্যুর আগেই এস্তেবানের বাবাকে গুলাগের শ্রমিক ক্যাম্পে পাঠিয়ে দেওয়া হয়েছিল। বাবা-মা হারা এস্তেবানের কাছে দাদু ট্রটস্কিই তখন একমাত্র আশ্রয়। আর ট্রটস্কি এবং তাঁর দ্বিতীয় স্ত্রী নাতালিয়ার তখন একমাত্র লক্ষ্য নিরাপদ আস্তানা খোঁজা। যেখানে সুরক্ষিত থাকবে তাঁদের নাতি।
সেই খোঁজেই শেষ পর্যন্ত অতলান্তিক পেরিয়ে মেক্সিকোর রাজধানী মেক্সিকো সিটিতে এসে পৌঁছয় ট্রটস্কি-পরিবার। তার পরের শুধু একটা বছরই আর পাঁচ জনের মতো নির্ভেজাল সাধারণ জীবনের স্বাদ পেয়েছিলেন কিশোর এস্তেবান। ঠিক কেমন ছিল সে জীবন?
এস্তেবান বললেন “এখানে এসেই প্রথম একা একা স্কুলে যেতে শুরু করলাম। কারণ, এখানে স্কুলে বা আশপাশে কেউ জানতই না আমার পরিবারের কথা, দাদুর কথা।” তবে মুশকিল হয়েছিল একটাই। সেই ছেলেবেলা থেকে এ দেশ সে দেশ ঘুরে বেড়াতে বেড়াতে নিজের মাতৃভাষা রুশ কার্যত শিখেই উঠতে পারেননি তিনি। অগত্যা তাই নাতির সঙ্গে কথোপকথন চালাতে বাড়িতে ফরাসি ভাষারই ব্যবহার করতে হত রুশ নেতাকে। তবে ও টুকুই।
আক্রান্ত হয়ে এই টেবিলেই লুটিয়ে পড়েন ট্রটস্কি।
ভাষা বাদ দিলে আর কোনও দিক থেকেই নিজের জীবনযাপন পাল্টাননি ট্রটস্কি। এই সময়টা ঠিক কী করতেন তিনি?
নাতি জানাচ্ছেন, দিনের বেশির ভাগ সময়টাই দাদু নিজের ঘরে কাটাতেন লেখালেখির কাজ নিয়ে। কখনও বা বাড়িতে আসা সাংবাদিকদের সাক্ষাৎকার দিতেন। আবার কখনও বা নিজের মত বোঝাতে গরমাগরম আলোচনা বা বিতর্কের ঝড় তুলে দিতেন তাবড় রাজনৈতিক ব্যক্তিত্বের সঙ্গে। তবে সমস্তটাই চেষ্টা করতেন নাতির আড়ালে করতে।
এস্তেবানের স্মৃতিতে অবশ্য নেতা ট্রটস্কি যতটা না রয়েছেন তার চেয়ে ঢের বেশি রয়েছেন দাদু ট্রটস্কি। আর পাঁচটা নাতির মতোই সকালে বাড়ির পোষ্যগুলোর পরিচর্যায় দাদুকে সাহায্য করতেন এস্তেবান। কখনও বা আবার ছুটির দিনে শহরের বাইরে ‘পিকনিক’ করতে যাওয়ার আব্দার করতেন দাদুকে। দাদুও রাজি।
এ ভাবেই বেশ চলছিল। কিন্তু ‘সুখ তো ক্ষণিকের’ দীর্ঘশ্বাস ফেলেন এস্তেবান। মনে পড়ে গেল ১৯৪০ সালের ২৪ মে-র দিনটা। প্রচণ্ড গোলাগুলির শব্দে ঘুম ভেঙে উঠে এস্তেবান দেখলেন তাঁদের বাড়ি লক্ষ্য করে গুলি চালাচ্ছে স্তালিনের বন্দুকবাজেরা। গুলি লাগল এস্তেবানের পায়ের পাতায়ও। যদিও ট্রটস্কি ও তাঁর স্ত্রী নাতালিয়ার কিছুই হয়নি, তা সত্ত্বেও ওই দিনটার পর থেকে কী রকম যেন বদলে গেল সব। বেড়ানো বন্ধ, খেলা বন্ধ, বাড়িতে বাড়তি সেনা মোতায়েন স্বাভাবিক জীবনের ছন্দপতন যে সে দিনই হয়েছিল সে ব্যাপারে আজ নিশ্চিত এস্তেবান।
তার পরের গল্পটা সবাই জানে। ১৯৪০ সালেরই ২০ অগস্ট রামন মেরকাদের নামে এক স্তালিন-অনুগামী ট্রটস্কির বাড়িতে ঢুকে অতর্কিতে আক্রমণ করে তাঁকে। বরফ ভাঙার কুঠার দিয়ে এমনই আঘাত করে তাঁর মাথায় যে অতিরিক্ত রক্তক্ষরণে মৃত্যু হয় ট্রটস্কির। কিন্তু এস্তেবানের মনে অন্য ছবি। বাড়িতে ফিরে জুতোর ফিতে খোলার আগেই তাঁর নজরে আসে নিজের পড়ার টেবিলে নেতিয়ে পড়ে আছেন ট্রটস্কি। রক্তে ভেসে যাচ্ছে চার দিক। পাশে দাঁড়িয়ে দিদিমা নাতালিয়া।
সেই দিদিমাও মারা গিয়েছেন ১৯৬২তে। তাঁর আগেই অবশ্য লেখাপড়া শেষ করে বিয়ে-থা করেন এস্তেবান। স্ত্রী ও চার মেয়েকে নিয়ে সংসারও করছিলেন। এখন অবশ্য স্ত্রী মারা গিয়েছেন। প্রায় একা বাড়ি খাঁ খাঁ করে।
কিন্তু সেই বাড়িতে তিনি শুনতে পান, রক্তাক্ত অবস্থাতেও দাদু দিদিমাকে বলছেন, “বাচ্চাটা যেন আমাকে এ ভাবে না দেখতে পায়।” আর তাই বোধহয় এ হেন স্মৃতির আঁতুড়ঘরকে তাঁর স্নেহশীল দাদুর নামাঙ্কিত যাদুঘর করে ফেলেছেন এস্তেবান।



First Page| Calcutta| State| Uttarbanga| Dakshinbanga| Bardhaman| Purulia | Murshidabad| Medinipur
National | Foreign| Business | Sports | Health| Environment | Editorial| Today
Crossword| Comics | Feedback | Archives | About Us | Advertisement Rates | Font Problem

অনুমতি ছাড়া এই ওয়েবসাইটের কোনও অংশ লেখা বা ছবি নকল করা বা অন্য কোথাও প্রকাশ করা বেআইনি
No part or content of this website may be copied or reproduced without permission.