রবিবাসরীয় গল্প
অগ্নিপুরাণ
সুকদেব ঠিক কত বছর বয়েসে ঝুকুটিয়া গ্রাম ত্যাগ করেছিল, সেটা যেমন কেউ মনে রাখেনি, তেমনই কত বছর বয়েসে, কোন দিন ও আবার গ্রামে ফিরে এল, সে কথাও সকলে ভুলে গিয়েছে। তবে একটা কথা সবাই, না, শুধু সবাই বললে ভুল হবে, দলমত নির্বিশেষে সবাই স্বীকার করে, ও যখন গ্রাম ছাড়ে তখন ঝুকুটিয়া গ্রাম ছিল বর্ধিষ্ণুসম্পন্ন গ্রাম। আর গ্রামে সবে পঞ্চায়েতরাজ শুরু হওয়ায় তখন গ্রামবাসীদের সব বিষয়ে দলমত নির্বিশেষে একমত না হলেও চলত।
গ্রামের আগে বর্ধিষ্ণুসম্পন্ন এ সব বিশেষণ বসালেই সকলে ধরে নেয়, এটা বোধ হয় কৃষিপ্রধান গ্রাম। কত বছর আগে যে এই গ্রামের লোকেরা কৃষিকাজ ভুলে গিয়েছে, তা কেউ জানে না। তখন গ্রামের আকাশে, ধূসর আকাশে, সরকারি কয়লাখনি আর ইস্পাত কারখানার কাঁচা টাকা সাদা বা কালো হরির লুটের খইয়ের মতো উড়ে বেড়াচ্ছে। ধরার জন্যে খুব একটা ছোটাছুটিরও দরকার হত না। পরিবারে এক জন ইস্পাত কারখানা বা খনিতে ঢুকতে পারলে পরিবারের সব সোমত্থ ছেলের চাকরি পাকা। শুধু ঠিক জায়গায় হাতটা পাতলেই হল, টাকা আপনেই ধরা দেবে। সাদা বা কালো।
এক সময় গ্রামে যারা কৃষিশ্রমিক ছিল, হাড়ি-ডোম-সাঁওতাল-বাউরি-বাগদি, তারা হল খনির মালকাটার। আর যারা জমির মালিক তারা হয়েছে লোডিং ম্যানেজার, সুপারভাইজার, ওয়েল্ডার, ফিটার, ক্লার্ক, পেটে একটু বিদ্যে থাকলে অফিসার পর্যন্ত। যারা একটু চালাকচতুর চাকরির পাশাপাশি তারা শুরু করেছে সাইড বিজনেস। মুদিখানার দোকান থেকে ট্রান্সপোর্ট পর্যন্ত। গ্রামে হাইস্কুল আছে, আছে খেলার মাঠ, লাইব্রেরি, ক্লাব, পাকা দালান বাড়ি। পুরনো ঐতিহ্যের মধ্যে রয়েছে টেরাকোটার দোল মন্দির, চাটুজ্জ্যেদের দুর্গা মন্দির। একটা গ্রামকে বর্ধিষ্ণু বলতে আর কী লাগে।
চাকরির সেই ভরভরন্তের যুগে সুকদেব যে কেন গ্রাম ছেড়ে চলে গেল সেটা বেশ রহস্য। কেউ সন্ধানও করেনি সবে কিশোর ছেলেটা কোথায় গেল, বেঁচে আছে না মরে গেল। ও ছোটবেলা থেকেই একটু ছিটেল। আর সবাই তো জানে, বাবা-মাও, ছিটেলরা এমনি করেই এক দিন পালায়। ও দিকে ঈশ্বর যেন পাগলদের সব নিরাপত্তা ছড়িয়ে রেখেছে ফুটপাথ, বাসস্ট্যান্ড, রেল স্টেশন, বন্ধ হয়ে যাওয়া কারখানার শেডে। এদেরকে ঝড়-বৃষ্টি-শীত চোর-গুন্ডা-তোলাবাজ-পুলিশ কেউ কাবু করতে পারে না। পাগল না খেতে পেয়ে মরে না, রোগে ভোগে মরে না, মরে না অ্যাক্সিডেন্টে। যুদ্ধ থেকে ফিরে অনেকের মাথা খারাপ হয়ে যায় শোনা গিয়েছে, কিন্তু কোনও পাগল যুদ্ধক্ষেত্রে মারা গিয়েছে এমন খবর আজ পর্যন্ত শোনা যায়নি। পাগল ফসলের দাম না পাওয়া কৃষকের বা কারখানা বন্ধ হয়ে যাওয়া শ্রমিকের মতো আত্মহত্যাও করে না। ওদের নিয়ে পাড়াপ্রতিবেশী, বাপ-মা-ভাই-বেরাদার, গণতন্ত্র, সমাজতন্ত্র, স্বৈরতন্ত্র, একনায়ক, হাইকমান্ড, পলিটব্যুরো, সুপ্রিমো কেউ কিছু না ভাবলেও পাগলেরা দিব্য বেঁচে থাকে। পাগল যেন পাগল হয় শুধু বেঁচে থাকার জন্যে। ওদের বেঁচে থাকার এই রহস্যটা সকলেই জানে। তাই কেউ ওর খোঁজ করেনি। শুধু মনে মনে কামনা করেছে ছিটেল কিশোরটা এক দিন গভীর অধ্যাবসায়ে চর্চা করতে করতে পরিণত সফল পাগল হয়ে উঠবে, পাগলামির চূড়ান্ত সফলতা এক দিন অর্জন করতে পারবেই ও। প্রতিভা তো ওর আছেই, দরকার শুধু চর্চার।
সুকদেবের ফিরে আসার দিনটাকে কেউ মনে না রাখলেও, বা ফিরে আসার দিনটা আর সব দিনের সঙ্গে মিশে যাওয়ায় এখন আর খুঁজে পাওয়া না গেলেও, ওর ফিরে আসাটাকে অস্বীকার করতে পারে না গ্রামের লোকেরা। গ্রামের লোকের আতঙ্ক যত বাড়ছে, ততই ও যেন প্রতিদিন একটু একটু করে ওদের জীবনের সঙ্গী হয়ে যাচ্ছে। আকাশের যে ধূসরতায় এক দিন ছিল সমৃদ্ধির হাতছানি, আজ তা যেন আগুন হয়ে গিলতে আসছে গোটা গ্রামটাকে। আগুন আকাশে। আগুন মানুষের মনে। চণ্ডীমণ্ডপের বিচারসভা স্থান বদল করেছে পঞ্চায়েত অফিসের উঠোনে। ঐক্যমত মানে রাজনৈতিক ঐক্যমত, না হলে যাত্রাপালা বা ফুটবল খেলা কোনওটাই ঠিকমতো পরিচালনা করা যায় না। সুখের সময়ে এই গ্রামের মানুষ জানত কয়লা শুধু মাটির উপরে জ্বলে। আজ তারা জেনেছে কয়লা জ্বলছে মাটির নীচেও। এই গ্রাম একটা কড়াই, ওদেরকে ছাই করে দিতে শুধু তপ্ত হওয়ার অপেক্ষায়। আর এই আতঙ্কের দিনে গ্রামের মানুষের একমাত্র ভরসা, না, কোনও মন্ত্রী-সান্ত্রি-প্যাকেজ নয়— সুকদেব। আহা! ওর মতো যদি পেগলে যেতে পারতাম আমাদের ভাবতে হত না কোথায় যাব, কোথায় শোব, কী খাব, কী পরনে দেব। আহা! আমরা যদি সবাই ওর মতো হতাম! ঈশ্বর তো শুধু পাগলদের পাশেই থাকেন।
ঝুকুটিয়া গ্রাম তলিয়ে যাচ্ছে। এই কথাটার মধ্যে কোনও সাহিত্য নেই। নেই অলঙ্কারের সৌন্দর্য বা সংকেতের মহিমা। শুধু যেটুকু নতুনত্ব এই ঘটনাটার মধ্যে আছে, সেটা হল এই: স্থলভূমি তলিয়ে যাচ্ছে স্থলভূমিতে। ঝুকুটিয়া যেন দাঁড়িয়ে ছিল মাটির তলার আর একটা ঝুকুটিয়াতে। আজ দৃশ্যমান ঝুকুটিয়া সেঁধিয়ে যাচ্ছে সেই অদৃশ্য ঝুকুটিয়ায়। শুরু হল দৃশ্যমানদের অদৃশ্য হয়ে যাওয়ার ইতিহাস। আশেপাশের তিন-চারটে খনি আর সরকারি ইস্পাত কারখানা বন্ধ হয়ে গেলে সবার আগে অদৃশ্য হল বাতাসে উড়ে যাওয়া সাদা টাকাগুলো। কালো টাকা অবশ্য কয়লা মাফিয়াদের নেতৃত্বে তখনও উড়ছিল বন্ধ হয়ে যাওয়া খনির অবৈধ খননে। গ্রামের হাড়ি-বাগদি মালকাটাররা দুটো পয়সার মুখ দেখছিল। এর পর হঠাৎ এক দিন অদৃশ্য হয়ে গেল গ্রামের মাঝে সবচেয়ে বড় পুকুরটার জল। একে একে দোল মন্দিরে, স্কুলবাড়িতে, পাকা দালানে দেখা গেল ফাটল। মাল কাটাররা ছাড়া সবাই যখন পালানোর ফিকির খুঁজছে, সেই সময় সুকদেব ফিরে এল যেন কোনও পৌরাণিক উপাখ্যানের নায়ক হয়ে। যে দিন সুকদেব এল তার কয়েক দিনের মধ্যেই সরকারি নোটিস জারি হল, মাইকে প্রচার হল এ গ্রাম ছেড়ে সবাইকে চলে যেতে হবে। গ্রামটা বিপজ্জনক। অবশ্য সেই প্রচারে এটা উল্লেখ করা ছিল না কোথায় যেতে হবে।
সুকদেব আসার পর একটা বড় প্রশ্নে গ্রামটা কয়েক দিন মেতে ছিল। যে এসেছে সে কি সত্যিই সুকদেব? গ্রামের একদল একটা যুক্তি খাড়া করল। ওরা বলল ওকে প্রথম দেখা গিয়েছিল অনেক দিন আগে মৃত ওর বাবা-মায়ের জরাজীর্ণ বাড়ির সামনে। অনেকে পাল্টা প্রশ্ন তুলল ওকে তো ভোরবেলা কারও না কারও বাড়ির উঠোনে শুয়ে থাকতে দেখা যায়। অন্য পক্ষ বলল তাতেই তো বোঝা যায় ও এই গ্রামের ছেলে। আর এ গ্রাম থেকে সুকদেব ছাড়া কোনও পাগল তো পালায়নি। বিশ্বাস ও সন্দেহের ঘোর কাটিয়ে এক সময় সকলে মেনে নিতে অভ্যস্ত হয়ে গেল আগন্তুক সুকদেব ছাড়া আর কেউ না। এর পরের প্রশ্ন ও খায় কী? ও ভিক্ষা করে না। ওকে প্রকাশ্যে কেউ কোনও দিন কিছু খেতে দেখেনি। তা হলে ও খায় কী? ওকে যে প্রশ্ন করে জানবে, যদি উত্তর না দেয়! আরও বিপদ যদি উত্তর দেয় আর সে উত্তর বোঝা না যায়! পাগলের উত্তর তো কেবল পাগলেই বোঝে। তাই গ্রামের আধপাগলা হেডমাস্টারকে গ্যাস খাওয়ানো হল, যে মানুষটা সরকারি ঘোষণার পর থেকে স্কুলের উঠোনে অবস্থান করছেন। প্রতিজ্ঞা: অন্য কোথাও আর একটা এ রকম স্কুল বানিয়ে না দিলে তিনি এখানেই দেহত্যাগ করবেন। প্রথম প্রথম মিডিয়া এটার খবরও করেছিল। তাতে গ্রামের ভদ্রলোকদের সঙ্গে তিনি নিজেও বেশ তেতে ছিলেন। তিনি অবস্থান করছিলেন, আর তাকে ঘিরে থাকা মাস্টারমশাইরা বাইট দিচ্ছিল। দু’দিনে মিডিয়ার মাতন মিটে গেল। তিনি কিন্তু অবস্থান বদল করতে পারলেন না দু’টি সামান্য বস্তুর অভাবে। কয়েক গাছা গাঁদার মালা আর এক গেলাস শরবত, যার জোগান গাঁয়ের লোকেরা কেউ দিল না, এমনকী তার বউও না।
এক দিন পাগলটা স্কুলের দিকে যেতে হেডমাস্টার ওকে ইশারায় কাছে ডাকলেন। পাগলটাও কেমন বাধ্য ছাত্রের মতো মাস্টারমশাইয়ের পাশে গিয়ে বসল। মাস্টারমশাই ওর মাথায় কপালে সস্নেহে হাত বুলিয়ে ফিসফিস করে জিজ্ঞেস করলেন, সুকু! তুই এত দিন কী করতিস রে! সুকু অনেকক্ষণ হেডমাস্টারের দিকে তাকিয়ে রইল। নিষ্পলক। তার পর ব্যাঙের মতো দু’বার থপ থপ করে লাফিয়ে বলল, ছরকাস! ছরকাস!
ও। তা তুই সার্কাসে কী করতিস! দড়ির খেলা!
প্রবল অবজ্ঞায় মুখ বিকৃত করে ও বলল হিক হিক হুঃ! যেন দড়ির খেলাটা কোনও খেলাই নয়।
তা হলে কী খেলা?
এ বার সুকু দু’হাতের ভঙ্গিতে গোটা শরীরটা আগুনের শিখার মতো জ্বালিয়ে দিতে শুরু করল।
আগুনের খেলা?
ওর কথা বুঝতে পেরেছে দেখে সুকু আনন্দে খিলখিল করে হেসে যেন মাটিতে গড়িয়ে পড়ল।
আগুন নিয়ে তুই কী করতিস রে?
মেনু চার্ট। উল্প উল্প গব গব।
ও ও ও!
গ্রামের লোকেরা যখন হেডমাস্টারকে জিজ্ঞেস করল তিনি বললেন, আমরা যা খাই সুকুও তাই খায়।
নাছোড়বান্দা এক ছাত্র বলল, কিন্তু ওকে তো আমরা কিছু খেতে দেখি না!
তুই যা খাস সব দেখতে পাস?
পাই না!
না, পাস না।
কী খাবার স্যর, যা খাবার সময় দেখা যায় না?
ওরে গবেট, আগুন আগুন। আমাকে আর জ্বালাস না। যা তোরা।
মাস্টারমশাইয়ের কথায় কে কী বুঝল কে জানে, তবে সবাই, মানে দলমত নির্বিশেষে সবাই, একমত হল গ্রামে পাগলের সংখ্যা বাড়ছে।
কিন্তু দুর্গাপুজোর ভাসানের দিন হেডমাস্টারের কথার হাতে গরম প্রমাণ পাওয়া গেল। চাটুজ্জ্যেদের দুর্গা এখনও ঐতিহ্য মেনে শালবল্লির মাচানে কুড়ি জন কাহারের কাঁধে চেপে জলে পড়েন বা কৈলাসে ফেরেন। এখন কাহাররা মালকাটার, বছরে এক বার মা দুর্গা আর সারা বছর কয়লা বওয়া ছাড়া যারা আর কিছু বয় না। সেই ভাসানের সমারোহে সুকুকে দেখা গেল সবার প্রথমে। কোথা থেকে একটা মশাল জোগাড় করেছে। মশালটা কেরোসিনে চুবিয়ে এক বার জ্বালছে, তার পর মুখের ভিতরে ঢুকিয়ে গপ করে গিলে ফেলছে শিখা। আবার জ্বালছে, আবার গিলে ফেলছে। আর ঢাকের তালে তালে উদ্দাম নাচতে নাচতে বলছে, ঠাকুর আসতে যতক্ষণ/ঠাকুর যাবে বিসর্জন।
সুকদেবের খাওয়া নিয়ে সমস্যা মিটল। এ বার সুকদেবের পরনের কাপড়। সে সমস্যা গ্রামবাসীরা পুরনো কাপড় দিয়ে মিটিয়ে দিত ওর নয়, নিজেদের লজ্জা ঢাকতে। ওর মতো আমরা উলঙ্গ থাকতে পারব না, এই লজ্জাটুকুর জন্যেই হয়তো দারিদ্র মোচনে সরকারি প্রজেক্টগুলোর চাইতে এটা ছিল অনেক আন্তরিক, রেশন ব্যবস্থার চেয়ে অনেক বেশি সংগঠিত। লজ্জা মানুষের থাকে। সরকার মানুষ নয়, সে মানুষের চেয়ে মহান।
এক দিন রাতে একটা বিকট শব্দ, সেই সঙ্গে হুড়মুড় করে কিছু একটা ধসে পড়ার আওয়াজে গ্রামের মানুষের ঘুম ভেঙে গেল। বিকট শব্দটা সকলের চেনা। কয়লা মাফিয়ারা অবৈধ খাদানে কয়লা চুরি করছে। কিন্তু ওই শব্দটা কীসের? বাইরে বেরিয়ে এসে সকলে দেখল শহরের সঙ্গে যোগাযোগ রাখা মূল সড়কটার একটা অংশ মাটির তলায় সেঁধিয়ে গিয়েছে। এ বার সম্পন্নদের মধ্যে হুড়োহুড়ি পড়ে গেল গ্রাম ছেড়ে পালানোর। হয়তো এই আতঙ্কে গোটা রাস্তাটাই যদি নেই হয়ে যায় আমরা কোন অদৃশ্য সেতু দিয়ে গ্রাম ছেড়ে পালাব!
প্রথম গ্রাম থেকে যে পরিবারটা পাত্তাড়ি গোটালো তাদের কত্তার কয়লা মাফিয়া বলে সুনাম ছিল। সে দিন সুকদেব একটা বিচিত্র কাণ্ড ঘটিয়ে বসল। মালপত্র সব বাঁধা হয়ে গিয়েছে ট্রাকে। দো-ঠো টাটা সুমোয় পরিবারের লোকেরা অপেক্ষা করছে দুর্গাপুরের সিটি সেন্টারে নতুন বাসস্থানের দিকে রওনা দিতে। বাড়ির কত্তা শিব মন্দিরে প্রণামটি সেরে যে গাড়ির দিকে এগোবে, হঠাৎ সুকু যেন আকাশ থেকে পড়ল সামনে, হাতে একটা কাঠি। কেউ কিছু বোঝার আগেই ‘মেজিক মেজিক মেজিক’ বলে কর্তার চার দিকে একটা গণ্ডি কেটে দিল। তার পর গণ্ডিটা পাক খায় আর বলে আঃ তু তু তু... বেরো বেরো... দেখি কেমন বেরোতে পারিস... বেরো... আঃ তু তু তু...
প্রথমে কত্তামশাই হেসে ম্যানেজ দেওয়ার চেষ্টা করেছিল। কিন্তু গণ্ডির বাইরে বেরোলেই যে তার নামের আগে সারমেয় বিশেষণটির সিলমোহর লেগে যাবে! তাই এক জায়গায় স্থির হয়ে দাঁড়িয়ে রইল। তার পর কত্তামশাইয়ের চোয়াল শক্ত হতে শুরু করল, গালে লালের আভা, শরীর কাঁপছে। কত্তামশাই আরও রেগে গেল আশেপাশে যারা ঘটা করে বিদায় দিতে এসেছিল তারা কেউ সুকুকে কিছু বলছে না দেখে। শেষে পরিবারের লোকেরা গাড়ি থেকে নেমে রে রে করে তেড়ে আসতে সুকু ব্যাঙের মতো লাফাতে লাফাতে অদৃশ্য হয়ে গেল। কর্তা গাড়িতে উঠেই ড্রাইভারকে নির্দেশ দিল, হর্নটা জোরে বাজিয়ে তাড়াতাড়ি বেরিয়ে চল, যাতে বিদায় জানাতে আসা লোকেদের বেদম হাসি কানে না যায়।
লোকে তারিফ করে বলল পাগল হো তো অ্যাইসা।
আস্তে আস্তে সব সম্পন্ন লোকই পাত্তাড়ি গোটালো। শুধু হেডমাস্টারমশাই বসে রইল স্কুলে, চিরতরে বিদায় নেওয়ার সময়েও তাকে কেউ অবস্থান ভাঙার অনুরোধ না করায়।
মাস্টারমশাইয়ের দজ্জাল বউ অবস্থানের তিন দিনের মাথায় দুই ছেলেকে নিয়ে গ্রাম ছেড়ে বাপের বাড়ি চলে গেছিল। সকলের গ্রাম ছাড়ার খবরটা কানে যেতে এক দিন একটা ট্রাক নিয়ে তিনি সোজা স্কুল মাঠে হাজির। দুম দুম করে পা ফেলে কাছে গিয়ে সটান প্রশ্ন তোমার দেহত্যাগ করা কি শেষ হয়েছে?
মাস্টারমশাই মিনমিন করে বলার চেষ্টা করলেন না, মানে ওরা কেউ আমাকে কিছু বললো না তাই...
চোপ! ওরা তোমার কে যে বলবে! লোকে দলত্যাগ করে পয়সা কামাতে আর পদত্যাগ করে সম্মান বাঁচাতে। আর উনি বিশ্বব্রহ্মাণ্ডে ত্যাগ করার আর জিনিস পেলেন না, ঘটা করে বসলেন দেহত্যাগ করতে। জীবনে না হল পয়সা, না হলো সম্মান। ওঠো!
মাস্টারমশাই সুড়সুড় করে উঠে দাঁড়ালেন।
এ বার চলো।
কোথায়?
কোথায় আবার কী! আমার বাপের বাড়ি। তা ছাড়া তোমার যাওয়ার জায়গা আছে কোথায়! দেহত্যাগ না করে আমাকে ত্যাগ করলে বেঁচে যেতুম।
আমি না হয় শ্বশুরবাড়ি গেলাম। কিন্তু যাদের শ্বশুরবাড়ি নেই।
তাদের ভাবনায় তোমার কী কাজ?
কাজ নেই?
না।
তা হলে নেই।
এক দিন গভীর রাতে পুলিশ আর র্যাফ বেশ কিছু খালি ট্রাক নিয়ে এসে নিঃশব্দে নেমে পড়ল হাড়ি-বাগদি-ক্যাওট-ডোমেদের পাড়ায় পাড়ায়। আচমকা আক্রমণে নারী-শিশু-বৃদ্ধ-বৃদ্ধা-জোয়ান সবাইকে ঠেলে তুলল গাড়িতে। ওদের চোখের সামনে জ্বালিয়ে দেওয়া হল পাড়াকে পাড়া। তার পর মাইকে করে ওয়ারেন্ট শোনানো হল বন্ধ হওয়া খনিতে কয়লা চুরির অপরাধে তোমাদের সবাইকে গ্রেফতার করা হল।
ট্রাকগুলো ওদের নিয়ে যে কোথায় অদৃশ্য হয়ে গেল কেউ জানে না।
ছায়া গ্রামে থেকে গেল ছায়া মানুষ সুকদেব। কোনও এক ভৌতিক প্রজ্ঞায় ও ঘুরে বেড়ায় ভেঙে পড়া পাঁচিল, ফাটল ধরা দেওয়াল, চোখের কোটোর থেকে খুবলে নেওয়া মণির মতো হা হা করা জানলা দরজার ফ্রেমের ফাঁকে ফাঁকে। এই স্থির জগতে একমাত্র চলমানতা সুকদেব আলো-ছায়ার মায়ায় সাঁতার কাটতে কাটতে ভেসে যায় এক অনন্ত বেঁচে থাকার দিকে।
যে বেঁচে থাকা রাষ্ট্রের সংরক্ষণের খাতায় এখনও তালিকাভুক্ত হয়নি।

ছবি: সুমন চৌধুরী



First Page| Calcutta| State| Uttarbanga| Dakshinbanga| Bardhaman| Purulia | Murshidabad| Medinipur
National | Foreign| Business | Sports | Health| Environment | Editorial| Today
Crossword| Comics | Feedback | Archives | About Us | Advertisement Rates | Font Problem

অনুমতি ছাড়া এই ওয়েবসাইটের কোনও অংশ লেখা বা ছবি নকল করা বা অন্য কোথাও প্রকাশ করা বেআইনি
No part or content of this website may be copied or reproduced without permission.