সাইনা হরিয়ানার মেয়ে। ‘নেহওয়াল’ তাঁদের গোত্র। এই গোত্রের জাঠরা ‘হিম্মত’-এর জন্য প্রসিদ্ধ। সাইনাকে গত তেরো বছর ধরে প্রত্যেকটা টুর্নামেন্টের আগে তাঁর বাবা-মা একটাই ‘পেপ টক’ দিয়ে আসছেন, “হিম্মত সে খেলো, জিতোগে।” হিসারে সাইনাদের বাড়ির সামনে ৪০০ বর্গমিটারের বিশাল মাঠ ছিল। পাড়ার বড়রা সেখানে সকাল-সন্ধে স্বাস্থ্য ফেরাতে জগিং করতেন। ছোট্ট সাইনাও তাঁদের সঙ্গে পাল্লা দিয়ে দৌড়ত। ছোট ছোট পায়ে খানিকটা দৌড়ে পড়ে যেত মাঠে। উঠে দাঁড়াত। আবার ছুটত। পালিয়ে আসত না। হিসারেই একটা ক্লাবে সাইনার মা-বাবা ব্যাডমিন্টন খেলতে যেতেন। সেখানে সুইমিং পুল ছিল। বছর চারেকের সাইনা সেই পুলের তিন মিটার উঁচু ডাইভিং বোর্ড থেকে জলে ঝাঁপ মারত। ভয়? কোনও প্রশ্নই নেই।
কৃষিজীবী পরিবার। শিক্ষিত। প্রতিষ্ঠিত। সাইনার দাদু গাজিয়াবাদের স্কুলে শিক্ষকতা করলেও সেখানকার ধিনদার গ্রামে নেহওয়ালদের আড়াই একর জমি ছিল। বছরভর চাল, গম, বাজরা, আখের চাষ হত। সাইনার বাবারা চার ভাই। প্রত্যেকেই শিক্ষা এবং কর্মসূত্রে কৃষি বিভাগের সঙ্গে জড়িত। সাইনার সাত বছরের বড় দিদি আবু চন্দ্রাংশু নেহওয়াল দিল্লিতে চাকরি করছেন। শ্বশুরবাড়িও দিল্লিতেই। বড় মেয়েকে বাবা-মায়ের আদর করে আবু ডাকার কারণ, মাউন্ট আবু-ই হল হরবীর-উষারানির জীবনে বেড়ানো একমাত্র শৈলশহর।
সাইনার ডাকনাম স্টেফি। ছোটবেলায় তাঁর স্বপ্নের নায়িকা ছিল স্টেফি গ্রাফ। সে কারণে মেয়েকে শুধু আদর করে স্টেফি বলেই ডাকতেন না হরবীর, মেয়ের থেকে কাজ বাগিয়ে নিতে স্টেফির বাবা পিটার গ্রাফের ফর্মুলাও নিতেন মাঝেমধ্যে। চার বছরের স্টেফি গ্রাফ পূর্ণ সাইজের টেনিস কোর্টে র্যাকেট দিয়ে মেরে নেটের ও-পারে বল পাঠাতে পারলে তাঁর জন্য পিটার গ্রাফের বরাদ্দ ছিল একটা আইসক্রিম। না পারলে সেই আইসক্রিম রেফ্রিজারেটরে ঢুকিয়ে রাখা হত। স্টেফি যে দিন সফল হতেন, ফ্রিজ থেকে আইসক্রিম বেরোত। হরবীরও ছোট সাইনাকে বলতেন, দৈনিক আট ঘণ্টার প্রচণ্ড পরিশ্রমসাধ্য ট্রেনিং এক দিনও কামাই না করলে সপ্তাহের শেষ দিন তাঁকে একটা পিৎজা খাওয়াবেন, বা একটা পুতুল কিনে দেবেন। “কিন্তু বেচারি, সেই সময় ওর ব্যাডমিন্টনের সরঞ্জাম কিনতেই আমার পকেট এমন ফাঁকা হয়ে যেত যে, মেয়েকে একটা পুতুল কিনে দিতে পারিনি। কোনও দিন শখ করে ওকে একটা নামী রেস্তোরাঁয় নিয়ে গিয়ে খাওয়াতে পারিনি।” হরবীরের গলায় আবেগ, কষ্টও।
কিন্তু চ্যাম্পিয়ন মেয়ের বাবা এটাও বিলক্ষণ বুঝিয়ে দিলেন, সাইনার ব্যাডমিন্টন-পাঠের ক্ষেত্রে তাঁরা কোনও রকম আপস করেননি কখনও। ন’বছর বয়সে লালবাহাদুর স্টেডিয়ামে তাঁর প্রথম কোচ ননীপ্রসাদ রাওয়ের কাছে সামার ক্যাম্পে ছ’মাস প্র্যাক্টিসের পরেই সাইনা ব্যাডমিন্টন জীবনের প্রথম টুর্নামেন্ট খেলতে যান চেন্নাইয়ে কৃষ্ণ খৈতান অনূর্ধ্ব দশ চ্যাম্পিয়নশিপে। ওই সময়ই তাঁর বাবা ২৭০০ টাকা দিয়ে তাঁকে আইসোমেট্রিক র্যাকেট কিনে দিয়েছিলেন। যদিও সেই সময় এ দেশের বেশির ভাগ প্রথম শ্রেণির ব্যাডমিন্টন প্লেয়ারও ১৭০০ টাকার কার্বোনেক্স র্যাকেটে খেলতেন।
কিন্তু, দামি র্যাকেট কিনে দিলেও মেয়ের হাতে চেন্নাইয়ে সেই র্যাকেট দেননি হরবীর-উষা। কেননা সাইনার বাবা-মা কেউই চেন্নাইয়ে মেয়ের সঙ্গে যেতে পারেননি বাড়তি খরচের ভয়ে। ওইটুকু বয়সে একা মেয়ে সাইনা কোচ আর অন্য টিমমেটদের সঙ্গে চেন্নাই গিয়ে কোয়ার্টার ফাইনালে হেরে যান। যদিও দশ বছর বয়েসেই ব্যাডমিন্টনের পৃথিবী থেকে জীবনের প্রথম আর্থিক পুরস্কার পান ৫০০ টাকা। কিন্তু ফেরার সময় সেকেন্দ্রাবাদ রেল স্টেশনে মেয়েকে বাবা আনতে গেলে হরবীরের বুকে মাথা রেখে সাইনা অঝোরে কাঁদতে থাকেন। “কেন তুমি আমার কিট্সে নতুন ভাল র্যাকেটটা দাওনি? তা হলে আমাকে কোয়ার্টার ফাইনালেই হেরে যেতে হত না! চ্যাম্পিয়ন হতাম।” অনেক দিনের পুরনো সেই গল্প শুনিয়ে সাইনা একটা মোক্ষম কথা এ বার হায়দরাবাদে বলছিলেন, “আমি ছোট থেকেই নিছক অংশ নিতে কোনও টুর্নামেন্টে খেলতাম না। আমার খেলা মানেই জেতার জন্য খেলা। আমি প্রতিটা টুর্নামেন্ট খেলি চ্যাম্পিয়ন হতে। এমনকী সত্যি বলতে কী, অলিম্পিকে অংশ নিতে পারাটাই আসল, জেতাটাই সব নয়এই আদর্শে আমি বিশ্বাসী নই। যে জন্য লন্ডনে মেডেল জিতলেও চার বছর আগে বেজিং অলিম্পিকে কোয়ার্টার ফাইনালে হারের ধাক্কাটা আমাকে এখনও মনের ভেতরে খোঁচা দেয়। নইলে আমিও সুশীল কুমারের মতোই দুটো অলিম্পিকে ব্যক্তিগত ইভেন্টে এ দেশের পদকজয়ী অ্যাথলিট হতেই পারতাম।”
সাইনাকে ক্রীড়াজগতে ‘পাপা’জ ডটার’ বলা হয়ে থাকলেও দিন তিনেক নেহওয়াল পরিবারের সঙ্গে কাটিয়ে কিন্তু মনে হল, তিনি যতটা ‘বাবার মেয়ে’, ততটাই মায়েরও। হয়তো বা বেশিই। হরবীর শখের ব্যাডমিন্টন খেললেও উষারানি রীতিমতো সিরিয়াস ছিলেন নিজের খেলা নিয়ে। হিসার আর হায়দরাবাদ, দুটো শহরেই র্যাঙ্কিং টুর্নামেন্ট খেলেছেন। মাত্র চোদ্দো বছর বয়সে মেরঠ থেকে ২৫০ কিলোমিটার দূরে বিয়ে, বিয়ের পরের ছ’বছর বাপের বাড়িতেই থেকে পড়াশোনা করে স্নাতক হওয়া এ সব ঝক্কি সামলাতে গিয়ে নিজের ব্যাডমিন্টন-স্বপ্নকে পূর্ণ না করতে পারার আক্ষেপ তিনি সাইনার মধ্য দিয়ে মেটানোর চেষ্টা করে এসেছেন বরাবর। হরিয়ানভিদের স্বাভাবিক খাদ্যাভ্যাসের গুণে সাইনা বরাবরই গাট্টাগোট্টা, শক্তিশালী। কিন্তু তাও উষা মেয়েকে বাড়তি দুধ, ঘি, মাখন, মধু, বাজরার রুটি খাওয়াতেন জোর করে। “সাইনাকে ওর সাড়ে চার বছর বয়স পর্যন্ত আমি বুকের দুধ খাইয়েছি।” এটা বলতেও কোনও সংকোচ করলেন না যে, “সারা দিনে সাইনার দুধ খাওয়ার পরিমাণ দেখে হায়দরাবাদে প্রথম দিকে ওর ব্যাডমিন্টন কোচিং সেন্টারের বন্ধুরা ওকে ‘হরিয়ানার মোষ’ বলে খেপাতেও ছাড়ত না।”
কথায় কথায় জানালেন উষারানি, “ট্রেনিং করে ফেরার পরেও ক্লান্ত সাইনাকে আমি বাড়িতে রোজ আরও এক-দু’ঘণ্টা ব্যাডমিন্টনের নানান টেকনিক্যাল, ট্যাকটিক্যাল ব্যাপারস্যাপার বোঝাতাম। বিশ্বসেরা ব্যাডমিন্টন তারকাদের বেড়ে ওঠার গল্প নিজে যতটুকু জানতাম ওকে শোনাতাম। সে সব শুনতে শুনতে এক-এক দিন সাইনা ঘুমিয়ে পড়ত, কিন্তু আমি কোনও দয়ামায়া না দেখিয়ে ওকে ঘুম থেকে টেনে তুলে পুরোটা শেষ করতাম। ও ভাবেই ওকে মোটিভেটেড করার চেষ্টা করে গেছি ওর খুব ছোটবেলা থেকেই।”
রেত্তিবোলিতে সাইনাদের আগের খুপচি ফ্ল্যাটের উল্টো দিকে এখনও থাকেন কৃষ্ণাজি পরিবার। তাঁদের কর্তা বলছিলেন, “সাইনার যখন বারো বছর বয়স তখনই আমাদের বলত, বড় হয়ে আমি ডাক্তার হব আর প্রথম ইন্ডিয়ান মেয়ে হিসেবে অল ইংল্যান্ড চ্যাম্পিয়ন হব। দুটোই।”
হায়দরাবাদে গিয়ে সাইনাকে প্রথমেই ব্যাডমিন্টনে না দিয়ে তাঁর বাবা-মা জুডো-ক্যারাটে শিখতে পাঠিয়েছিলেন! আসলে চাকরি সূত্রে পরিবার সমেত হায়দরাবাদে বদলি হয়ে এসে হরবীর একেবারে গোড়ার দিকে তাঁর গবেষণা কেন্দ্রের ভেতরেই কোয়ার্টার্সে থাকতেন। নতুন শহর সম্বন্ধে কিছুই জানা ছিল না। আট বছরের সাইনার সবচেয়ে সমস্যা ছিল ভাষা নিয়ে। ভাষা সমস্যায় প্রায় নির্বান্ধব হওয়ার জোগাড় হয়েছিল সব সময় বকবক করতে অভ্যস্ত মেয়ের। তখন মূলত একসঙ্গে বেশ কিছু হায়দরাবাদি ছেলেমেয়ের সঙ্গে সময় কাটালে সেখানকার স্থানীয় ভাষা সাইনা শিখতে পারবে এই আশায় হাতের কাছে আর কিছু না পেয়ে অফিস ক্যাম্পাসের ভেতর জুডো-ক্যারাটে স্কুলেই মেয়েকে ভর্তি করে দেন হরবীর। সাইনার ক্যারাটে শিক্ষক ইন্দ্রসেনা রেড্ডি এখনও সেই স্কুলে রয়েছেন। তিনি বলছিলেন, “এক বছরের মধ্যেই সাইনা অরেঞ্জ আর ব্লু বেল্ট পেয়ে গিয়েছিল। এতটাই আগ্রহ আর স্কিল ছিল। ক্যারাটেতে থাকলেও নির্ঘাত বিখ্যাত হত। কিন্তু এক বছরের মাথায় ঠিক করলাম, বুক আর হাতের ওপরে কী ভাবে মোটরবাইক নিতে হয় সেই ট্রেনিং সাইনাকে দেব। পরের দিনই সাইনার বাবা-মা ওকে ক্যারাটে স্কুল ছাড়িয়ে নিয়ে চলে যান।” ক্যারাটের কপাল খারাপ।
এবং ব্যাডমিন্টনের বরাতজোর। বছরখানেক পরের কথা। হরবীর অফিস টুর্নামেন্টের জন্য লালবাহাদুর স্টেডিয়ামে ইন্ডোর হল ভাড়া নিতে গিয়েছিলেন। সঙ্গে ন’বছরের সাইনা। বাবা ব্যাডমিন্টন কোর্টের পাশে দাঁড়িয়ে স্টেডিয়াম কর্তৃপক্ষের সঙ্গে কথা বলছেন, সাইনা সেখানে পড়ে থাকা র্যাকেট আর শাটলকক নিয়ে নিজের মনে একটার পর একটা শট মেরে চলেছে। হঠাৎ সেখানকার ব্যাডমিন্টন কোচ ননীপ্রসাদ রাও এগিয়ে এসে হরবীরকে বলেন, “এই মেয়েটা কি আপনাদের সঙ্গে এসেছে? এখানে আর কয়েক দিন পরেই ব্যাডমিন্টনের সামার ক্যাম্প শুরু হবে। ওকে কি তাতে দেবেন? ওকে এতক্ষণ যা সব শট মারতে দেখলাম, প্রত্যেকটা ঠিকঠাক। ওকে এখানে দিন।” হরবীর কথা সে শুনেছিলেন। মাত্র ছ’মাস পরেই জীবনের প্রথম প্রতিযোগিতামূলক ব্যাডমিন্টন টুর্নামেন্টে কোচ নতুন ছাত্রীটিকেই খেলতে পাঠান।
খুদে সাইনার প্রথম সাড়া ফেলা টুর্নামেন্ট চেন্নাই বা তিরুপতিতে নয়। পটনায়। ২০০২-এ। সাড়ে বারো বছরের মেয়ে একসঙ্গে চারটে বয়সভিত্তিক টুর্নামেন্টে নেমে চ্যাম্পিয়ন-রানার্স হিসেবে পাঁচটা জাতীয় খেতাবের মালিক হয়েছিল সেখানে। অনূর্ধ্ব তেরোয় সিঙ্গলস এবং ডাবলস চ্যাম্পিয়ন। অনূর্ধ্ব পনেরোয় ডাবলস চ্যাম্পিয়ন, সিঙ্গলসে রানার্স। অনূর্ধ্ব সতেরোয় ডাবলস চ্যাম্পিয়ন। এমনকী তার পরের মাসে গুন্টুরে জাতীয় অনূর্ধ্ব উনিশ ব্যাডমিন্টনেও সিঙ্গলসে রানার আপ হয়েছিলেন তিনি, বয়সে অনেক বড়দের বিরুদ্ধে খেলে, বেশির ভাগ ‘দিদি’দের হারিয়ে। অন্ধ্রপ্রদেশ সাই থেকে মাসিক সাড়ে সাতশো টাকা স্কলারশিপ পাওয়ারও সেই শুরু সাইনার।
ক্রমশ অন্য মুশকিল। টুর্নামেন্ট খেলার ব্যস্ততায় স্কুলে যাওয়া প্রায় বন্ধ হয়ে যায়। হরবীর স্বীকার করলেন, “হায়দরাবাদে এসে যে ছ’বছর সাইনা ভারতী বিদ্যাভবনে পড়েছে, আমি বা ওর মা একবারও পেরেন্ট-টিচার মিটিংয়ে যাইনি। যাব কোন মুখে? গেলেই তো বলবে, আপনাদের মেয়ে স্কুলে আসেই না। ওকে নাম কাটিয়ে নিয়ে চলে যান। তবু ইংলিশ টিচার রানি ম্যাডাম, যিনি এখনও ওই স্কুলে পড়ান, সাইনাকে ক্লাস নাইনে এক রকম হুমকি দিয়েছিলেন, অমুক দিনের মধ্যে সমস্ত হোমটাস্ক করে নিয়ে আসবে, নইলে স্কুলে আসা বন্ধ তোমার। হোমটাস্ক জমা দেওয়ার শেষ দিনই আবার সাইনার একটা টুর্নামেন্টের ফাইনাল ম্যাচ পড়েছিল। কী হবে ভেবে পাচ্ছি না আমরা। কিন্তু সাইনা দুটোই করে দেখিয়ে দিয়েছিল। টুর্নামেন্টটায় চ্যাম্পিয়ন হল। আবার হোমটাস্কেও ক্লাসের মধ্যে ফার্স্ট হয়েছিল।”
সাইনার খেলায় যত উন্নতি ঘটতে থাকে, ততই তার সঙ্গে তাল রাখার জন্য খরচের বহর বাড়তে থাকে। প্রথমে ব্যাঙ্ক ব্যালান্স খালি হয়ে যায় হরবীরের। তার পর বাজারের একটার পর একটা লোন প্রকল্প থেকে ধার নেওয়া শুরু করেন তিনি। শেষে হাত পড়ে প্রভিডেন্ট ফান্ডে। কিন্তু কোনও দিন সাইনাকে সে সব বুঝতে দেননি তাঁরা। “এখন ভাবলে শ্রদ্ধা আর বিস্ময়ে আমার মাথা নত হয়ে আসে আমার পরিবারের প্রতি”, বলছিলেন সাইনা, “সব পরিবারের মতোই আমাদের পরিবারেও সমস্যা ছিল। মাঝেমধ্যে ঝগড়াঝাঁটি বাঁধত বাবা-মা-দিদির মধ্যে। তার পর আমার খেলার জন্য বাবার কাঁড়িকাঁড়ি টাকা খরচের ধাক্কা তো ছিলই। কিন্তু জীবনে একটা দিনের জন্যও, একবারের জন্যও আমার সামনে সেই সব নিয়ে বাড়ির কেউ কোনও রকম আলোচনা করত না। আমাকে সব সময় আনন্দে রাখার চেষ্টা করত সবাই। কোনও সমস্যা নিয়ে আমার সামনে কেউ কোনও কথা বলত না। আজ বুঝি, আমার যাতে খেলাটার থেকে মন অন্য দিকে একটুও না সরে যায়, এক সেকেন্ডের জন্যও আমি যাতে ব্যাডমিন্টনে ডি-ফোকাস্ড না হয়ে পড়ি, সে জন্য আমার বাবা-মা-দিদি এত বড় আত্মত্যাগ করেছে। এখনও করছে।”
অথচ সাইনার জন্মের সময় তাঁর বাবা ও মা, কারও দিক থেকেই কেউ হাসপাতালে উপস্থিত ছিলেন না। এক সপ্তাহ পর উষার মা নাতনিকে দেখতে এসেছিলেন। হরবীরের মা কলাবতী গাজিয়াবাদ থেকে হিসারে তাঁর দ্বিতীয় নাতনিকে দেখতে আসেন এক মাসেরও পর। ছেলেকে বলেছিলেন, “তুই তো আমাদের ডাকিসই না তোর বাড়িতে!” এমনও শোনা যায়, উষার পর পর দুটি মেয়ে হওয়ায় তাঁর শ্বশুরবাড়িতে তেমন খুশির বাতাবরণ ছিল না। ভারতীয় সমাজের চিরকালীন সমস্যা! পরে অবশ্য ডানপিটে সাইনাকে দেখে তাঁর ঠাকুমা সোহাগ করে বলতেন, “আর একটা কলাবতী এসেছে। আমিও ছোটবেলায় এ রকমই দুরন্ত ছিলাম।”
ঘুম খুব প্রিয় সাইনার, ছোটবেলা থেকেই। ননীপ্রসাদের হাতে পড়ার পর মেয়েকে নিয়ে তাঁর বাবা রোজ ভোর চারটেয় ঘুম থেকে উঠে ২৬ কিলোমিটার স্কুটার চালিয়ে লালবাহাদুর স্টেডিয়ামে যেতেন। প্র্যাক্টিসের পর মেয়েকে স্কুলে নামিয়ে অফিস পৌঁছতেন। বিকেলে আবার স্কুল থেকে মেয়েকে নিয়ে স্টেডিয়ামে প্র্যাক্টিস করিয়ে ফের ২৬ কিলোমিটার স্কুটার চালিয়ে বাড়ি ফিরতেন। রোজ ৫০ কিলোমিটারেরও বেশি জার্নি করতে করতে এক-এক দিন ভয়ঙ্কর ক্লান্ত সাইনা স্কুটারের ওপরেই ঘুমিয়ে পড়ত। কিন্তু লড়াই ছাড়েনি। “আমার জেদটা ঠিক বাইরে থেকে বোঝা যায় না,” বলছিলেন সাইনা। “বড় হয়ে মা-র কাছে শুনেছি, একদিন বাবা নাকি তাড়াহুড়োয় আমাকে স্কুল থেকে নিতে ভুলে গিয়ে সিধে বাড়িতে এসে গিয়েছিলেন। বিকেল চারটেয় মনে পড়ে যে আমি স্কুলে রয়ে গেছি। আবার ২৬ কিলোমিটার স্কুটার চালিয়ে বাবা আমার স্কুলে গিয়ে দেখেছিলেন, আমি একটুও কান্নাকাটি না করে ফাঁকা ক্লাসরুমে দিব্যি ঘুমোচ্ছি। এখনও সারা দিনে আমি যতক্ষণই প্র্যাক্টিস করি না কেন, কিংবা যখনই খেলি না কেন, দুপুরে একটা ‘ন্যাপ’ আমি নেবই। কারও আটকানোর সাধ্য নেই। মনে হয়, সেই স্কুলে বাধ্য হয়ে দুপুরে ঘুমিয়ে পড়ারই বদভ্যাস এটা,” বলেই বিশাল কিন্তু অনাড়ম্বর ডিলাক্স ফ্ল্যাটে বসা সাইনা হেসে ফেললেন। যে হাসির সঙ্গে দাঁতের মাড়িও দেখা যায়। রেত্তিবোলির ঋষিসাঁই রামানা এনক্লেভের এক কোণের দু’খানা ঘর ছেড়ে সাইনারা বছর দুই হল গাচ্চিবোলির ‘টিউটিপ এনক্লেভ’-এ আট তলায় তিন কোটি টাকার এই বাংলো টাইপ ফ্ল্যাটে উঠে এসেছেন। প্রিয় পোষ্য লাব্রাডর ‘মাচো’ গত বছর তেরো বছর বয়সে মারা যাওয়ার পর আর কুকুর আনেননি বাড়িতে।
ব্যাডমিন্টনের পৃথিবীতে সাইনার বালিকা থেকে নারী হয়ে ওঠা গোপীচন্দের অ্যাকাডেমিতে তালিম পেয়ে। সকাল-দুপুর-সন্ধে, তিন দফা মিলিয়ে রোজ আট ঘণ্টা অত্যাধুনিক ট্রেনিং শিডিউল। শাটল নিয়ে প্র্যাক্টিস, শাটল ছাড়া প্র্যাক্টিস, জিম, যোগব্যায়াম সাইনার নিত্যকার অনুশীলন সূচির অন্তর্গত। এমনকী অলিম্পিকের আগে সাইনাকে ‘জুম্বা’-তেও বেশ কয়েক বার পাঠিয়েছিলেন ‘গোপী স্যর’। জুম্বা এক ধরনের ‘ফিটনেস ডান্স’, আবার নাচ নয়ও। শরীরের ভারী জায়গাগুলো ‘টোন্’ করে দেয় জুম্বা। “চিনা মেয়েদের ফিটনেস লেভেলের সঙ্গে টক্কর নিতে হলে এ ছাড়া উপায় নেই ভারতীয় বা ইউরোপিয়ানদের। সাইনাকে লক্ষ করবেন, একেবারে মেদহীন,” নিজের অ্যাকাডেমির বিশাল অফিসে বসে সাইনার ফিটনেস-রহস্য ফাঁস করছিলেন গোপীচন্দ। পারুপল্লি কাশ্যপ বা জ্বালা গাট্টার মতো গোপীর অ্যাকাডেমিতে প্রস্তুত হয়ে লন্ডন অলিম্পিক খেলে আসা আরও দুই হায়দরাবাদি ব্যাডমিন্টন প্লেয়ার এর সঙ্গে যোগ করলেন, “সাইনাকে আমরা এখানে গত আট বছর ধরে প্রতিদিন প্র্যাক্টিসে সবার আগে পৌঁছতে দেখে আসছি। কোনও দিন এর অন্যথা হতে দেখলাম না। ওর অ্যাটিটিউডটাই আলাদা!” কোর্টের বাইরে যাবতীয় জাগতিক আকর্ষণ থেকে নিজেকে সম্পূর্ণ ভাবে বিচ্ছিন্ন রাখো আর সর্বদা প্র্যাক্টিসে ছেলেদের বিরুদ্ধে খেলো গোপীচন্দের দুটো মোক্ষম প্রেসক্রিপশন তাঁকে চড়চড় করে উত্থানে দারুণ সাহায্য করেছে, অকপটে বলেন সাইনা।
প্রকাশ পাড়ুকোনের সঙ্গে বেঙ্গালুরুতে মধ্যাহ্নভোজের আমন্ত্রণ, দীপিকা পাড়ুকোনের সঙ্গে প্রদর্শনী ব্যাডমিন্টন খেলার আকর্ষণও সে জন্য সাইনাকে আকৃষ্ট করতে পারে না। অলিম্পিকের আগে চার মাস সম্পূর্ণ ফ্যাট-কার্বোহাইড্রেট বর্জিত নতুন ডায়েট ছাড়া অন্য কিচ্ছু মুখে তোলেননি। প্র্যাক্টিসে একসঙ্গে ডান-হাতি গোপী (চন্দ) আর বাঁ-হাতি গোপী (রাজু)-র বিরুদ্ধে খেলে স্কিল আরও বাড়িয়ে লন্ডন গিয়েছিলেন। অক্লেশে ব্যাখ্যা দেন, কেন এক জনও বয়ফ্রেন্ড নেই তাঁর। “আরে, আজ বয়ফ্রেন্ডের সঙ্গে ঘুরলাম, খেলাম, সিনেমা দেখলাম। কাল সে যখন বলবে সাইনা তুমি কোথায়, তখন আমি হয়তো কোথাও খেলছি। মাসের তিন সপ্তাহই যে মেয়ে বাইরে থাকে তার সঙ্গে কোন ছেলে বন্ধুত্ব রাখবে?” গাচ্চিবোলিতে গোপীচন্দের অ্যাকাডেমির অফিস রুমের নোটিস বোর্ডে যে ছাপানো কাগজটা টাঙানো আছে, সেটা সাইনার বাড়িতে তাঁর ঘরেও সুদৃশ্য ফ্রেমে বাঁধিয়ে রাখা আছে দেখলাম। ‘ইফ ইউ স্যালিউট ইয়োর ডিউটি ইউ নিড নট স্যালিউট এনিবডি, বাট ইফ ইউ পলিউট ইয়োর ডিউটি ইউ হ্যাভ টু স্যালিউট এভরিবডি!’
একবিংশ শতকেও এ দেশে মেয়ে খেলোয়াড়দের সার্বিক অবস্থা বলতে গিয়ে গলা বুজে আসে সাইনার। “এখনও আমাদের দেশের আর্থ-সামাজিক প্রেক্ষাপট এমন যে, মেয়েদের খেলাধুলোয় কিছু করে দেখাতে গেলে তাদের অনেক প্রতিবন্ধক পেরোতে হয়। কিছু অভিজ্ঞতা খুব তিক্তও। কিন্তু মেয়েদেরই এগিয়ে এসে এ সব দেওয়াল ভেঙে ফেলতে হবে। সে জন্য দরকার আন্তর্জাতিক সাফল্য। এ দেশের মেয়েরা যত আন্তর্জাতিক ভাবে সফল হয়ে দেখিয়ে দিতে পারবে সমাজকে, ততই মেয়েদের ক্ষমতার প্রতি আস্থা, বিশ্বাস, শ্রদ্ধা বাড়বে পুরুষশাসিত সমাজের।”
একটা ছোট্ট গল্প দিয়ে শেষ করি। ২০০৪-এ ভারত পেট্রোলিয়াম চোদ্দো বছরের সাইনাকে সাম্মানিক চাকরি দেয়। ইন্টারভিউ দিতে গিয়ে সাইনা দেখেন ইন্টারভিউ বোর্ডের অন্যতম সদস্য প্রকাশ পাড়ুকোন। হরবীরও গিয়েছিলেন সাইনার সঙ্গে। প্রকাশ সাইনাকে জিজ্ঞেস করেছিলেন, বৈজ্ঞানিক না হয়ে ব্যাডমিন্টন প্লেয়ার হলে কেন? সাইনার সংক্ষিপ্ত জবাব ছিল, “ব্যাডমিন্টনটা বুঝি বলে।” আবার পাড়ুকোন: পেট্রোলিয়াম সম্পর্কে কী বোঝো? এ বার সাইনার আরও সংক্ষিপ্ত উত্তর: কিছুই না। |