হাঁড়ির খবর
কাঁটা হেরি ক্ষান্ত কেন...
সেই দুষ্টু গরু আর শূন্য গোয়ালের গল্প। সেকেলে প্রজ্ঞা অনুযায়ী, দুষ্টু গরুকে জীবন থেকে খারিজ করা যেতেই পারে কিন্তু তাতে সুখের গ্যারান্টি মিলবে কি?
নিষ্কণ্টক ইলিশেও একই ভয়। স্মোকড হিলসা নামের বিশিষ্ট পদটি যতই কলোনিয়াল আমলের স্মারক হয়ে কলকাতার নামী-দামি ক্লাবের মেনু আলো করুক, ইলিশ নিয়ে ল্যাবরেটরিতে বেশি নাড়া-ঘাঁটা আম বাঙালির জিভে কত দূর পোষায় তা তর্কসাপেক্ষ। সত্যি বলতে কাঁটাবিহীন বা বোনলেস ইলিশের দৌড় নিয়ে কিঞ্চিৎ অবিশ্বাসী হওয়াটা মোটেও সঙ্কীর্ণ বাঙালিত্বের পরিচয় নয়। কাঁটার সঙ্গে তেলালো ইলিশের দেবদুর্লভ নির্যাস, স্বাদের প্রাণভোমরা পিঠটান দিচ্ছে না তো? বাঙালি হেঁশেলে সেরা ইলিশের ‘তার’ যিনি টের পেয়েছেন, কণ্টকমুক্তির নামে মাছটির দফারফা হল ভেবে তাঁর দুশ্চিন্তা আদৌ অসঙ্গত নয়।
কয়েকদিনের মধ্যে কলকাতার বর্ষায় দু’টি জবরদস্ত ইলিশক্ষেত্র মার্কোপোলো এবং ওহ্ ক্যালকাটায় ঢুঁ মেরে সংশয়ের অনেকটাই অবসান ঘটল। কাঁটাবিহীন ইলিশের রোমাঞ্চ অনেক ক্ষেত্রেই তা পাতে আসার পরে বেশি ক্ষণ স্থায়ী হয় না। নিষ্কণ্টক নিস্তরঙ্গ জীবনের মতোই বোনলেস ইলিশও কেমন ম্যাড়মেড়ে পানসে। কাঁচা ঝাল বা ভাপা-ভাজায় চির-অভ্যস্ত জিভেও নয়া অবতার পোষায় না। এই বর্ষায় ক্রমশ বিরল থেকে বিরলতর ইলিশের জন্য শোকগাথার আবহে কাঁটাবিহীন ইলিশ তবু গভীর ছাপ রেখে গেল।
এ যাত্রা প্রাথমিক সংশয়টুকু অবশ্য ছিল ইলিশের জোগান নিয়েই। ইলিশ-বংশের বারো আনাই তো ইদানিং খোকা অবস্থায় ধরা পড়ে যাচ্ছে। আর পেল্লায় চেহারা ছাড়া কাঁটামুক্ত করার উপযোগী ইলিশ মিলবে কোথায়? কম করে এক কিলো ওজন না-হলে সে ইলিশের কাঁটা ছাড়িয়ে অতিথির পাতে দিতে রেস্তোরাঁ-কর্তা লজ্জায় জিভ কাটবেন। কাঁটা ছাড়াতে গিয়েও পুরুষ্টু মাছের শরীর অনেকটা পাতলা হয়ে যেতে বাধ্য। গণ-ভোজের মেনুতে বোনলেস ইলিশের আয়োজন তাই চাট্টিখানি কথা নয়। শ্রাবণের শেষ অবধি ঝুলে থাকার পরে ভরা ভাদ্রে অবশেষে যথাযথ মাপের ইলিশের জোগান নিয়ে কিছুটা আশ্বস্ত রেস্তোরাঁকুল।
মার্কোপোলো, ওহ্ ক্যালকাটা অবিশ্যি বিস্তর কাঠখড় পুড়িয়ে ঢের আগেই ইলিশ-অভিযানে সামিল। খাস বাংলাদেশি ইলিশ-কারবারিদের সঙ্গে ‘পিআর’ করে রোমাঞ্চকর ইলিশ-শিকার। কিন্তু সব থেকে সুখের, ইলিশের ভবিষ্যৎ নিয়ে যাবতীয় অনিশ্চয়তাও এই সব রেস্তোরাঁর সৃষ্টিশীলতায় মরচে পড়তে দেয়নি। কার্যত ইলিশবিহীন আষাঢ়-শ্রাবণও কয়েকটি আনকোরা পদের জন্ম দিয়েছে। শুলপো পাতা বা ডিল ও লেবুর স্বাদের সাহেবি ইলিশ (মার্কোপোলো) কিংবা নিরাভরণ দই ও বেজিল পাতার ইলিশের (ওহ্ ক্যালকাটা) মতো কয়েকটি নতুন রান্না বেশ চমকপ্রদ।
এখন বাঙালির ইলিশ-ভাগ্য আর একটু খুলতে আরও অনেকে কোমর বাঁধছেন। তাঁদের মধ্যে বোনলেস ইলিশ নিয়ে ওস্তাদিতে পোড়খাওয়া জয়মাল্য বন্দোপাধ্যায় রয়েছেন। কয়েক বছর আগে মশলাদার বড়িভাজার গুঁড়ো মেশানো কাঁটাবিহীন ইলিশ ফিলে বেক করে শেফ জয় তাক লাগিয়েছিলেন। তাঁর নতুন রেস্তোরাঁ বোহেমিয়ান-এ এ বার ইলিশ ডিমের ললিপপ বা কুমড়োফুলে মোড়া ইলিশ স্টার্টারের উপহার। জারক লেবু-সুরভিত ইলিশ পদও মজুত।
হোটেল হিন্দুস্থান ইন্টারন্যাশনালের মিথ রেস্তোরাঁয় কর্পোরেট শেফ উৎপল মণ্ডলও তাঁর তুরুপের তাস পাকা আমযোগে বিশেষ ইলিশ নামাতে চলেছেন। এই বোনলেস ইলিশ আসবে ম্যাঙ্গো হল্যান্ডেজ সসের অনুষঙ্গে। পারমেজান চিজ, অলিভ অয়েলাদির সঙ্গে কাঁচা আমের পেস্তো সসের উদ্ভাবনও ইলিশের সঙ্গতে কাজে আসছে। ম্যাঙ্গো পেস্তো সসে ইলিশ ভাল লাগার কথা। এ বার কলকাতা ইলিশের সুশি অবধি চেখে ফেলেছে। সল্টলেকের সনেট রেস্তোরাঁয় হিলসা উরা মাকি। ভয় পাবেন না, এই সুশিতে কাঁচা স্যামন বা টুনার মতো কাঁচা ইলিশ নেই। এক খণ্ড স্মোক্ড ইলিশ জাপানি টেম্পুরা ব্যাটারে ভেজে স্টিকি রাইসের মণ্ডে জড়ানো, নরি শিটের রিবনে বাঁধা। বেশ ইলিশ-ভাতের গ্রাস মুখে পুরছি মনে হয়। বাঙালির ইলিশ-ভাতের এও এক ধরনের স্টার্টার-অবতার। সনেটে এখন তাইল্যান্ডের প্যানডান পাতায় মোড়া পাতুরির আদলে বোনলেস ইলিশেরও আয়োজন।
কাঁটাবিহীন ইলিশ রান্নাটা কিন্তু মোটেও সোজা কাজ নয়। আজকের মার্কোপোলোয় ইলিশ খেলেই বুঝবেন, চার বছর আগেও এই স্বাদ আয়ত্ত করা সম্ভব হয়নি। উৎসাহে, চেষ্টায় ক্রমশ হাত পেকেছে। প্রথমে অল্প গ্রেভিতে ইলিশটা রেঁধে নিয়ে তার পরে কাঁটা ছাড়াতে হয়। ফিলেটা লম্বালম্বি খোপ-খোপ করে কেটে আড়াআড়ি নিপুণ হাতে ছুরি চালাতে হবে। তাতেই কাঁটার মুক্তি। কিন্তু মাছের তেল-টেল অনেক কিছুই ওই কাঁটার সঙ্গে পালিয়ে যাওয়ার ভয় থাকে। বোনলেস ইলিশ রান্নায় এই বিষয়টা মাথায় রাখা বিশেষ জরুরি। মার্কোপোলোর পোড়-খাওয়া অমিতাভ চক্রবর্তী তাই ইলিশের মুড়ো-কাঁটা থেকে উদ্বৃত্ত যা কিছু সব ঘণ্টা তিনেক ধরে ফুটিয়ে ‘স্টক’ তৈরি করেন। কাঁটা ছাড়ানোর সময়ে মাছের বাদ যাওয়া অংশও স্টকে মেশে। ওই স্টকযোগে মাছের গ্রেভির খানিকটা আলাদা ভাবে তৈরি হয়। বোনলেস ইলিশ ফিলের গায়ে কন্টিনেন্টাল শৈলীতে ইলিশগন্ধী কাইটা ছড়িয়ে দেওয়া হয়।
ওহ্ ক্যালকাটার শেফ সুবীর দেবও এ বার একগাদা নতুন ইলিশ-উপহার এনেছেন। লো ক্যালরি বেজিল ইলিশের কথা আগেই বলেছি। ঝাল-মিষ্টি অরেঞ্জ সসেও ইলিশ হচ্ছে। ইলিশের আবহে কাঁচা লঙ্কার সঙ্গীতটা মিস্ করলে কয়েকটা চেয়ে নেবেন। এই পদগুলোর সঙ্গে কাঁচা লঙ্কা কামড়াতে দিব্যি লাগবে। আর কুমড়োপাতায় মোড়া আমতেলের ইলিশও বেড়ে হয়েছে। আলুভাজাযোগে স্মোক্ড ইলিশ বা সেদ্ধ সব্জিযোগে চিজ-অরিগানোয় গ্রিল্ড ইলিশ অন্য রকম।
কাঁটাবিহীন ইলিশের ভাপা, মরিচ-বাটা ঝাল বা নর্থ ইন্ডিয়ান শৈলীতে কোর্মা কি বিরিয়ানির আধারে ইলিশের পরিবেশনে এ শহরে মার্কোপোলো অন্যতম পথিকৃৎ। এ বার মেক্সিকান সুগন্ধী লঙ্কা চিপতলেযোগে একটা মিষ্টি-মিষ্টি ইলিশও ওরা করছে। তবে এ বারের সেরা প্রাপ্তি স্পাইসি ডিল সসের ইলিশ। মাখন-হোয়াইট ওয়াইন-লেবু সুরভিত সসে দেশজ শুলপো পাতার আলাদা ভূমিকা। শুলপো পাতা মৌরীর মতো দেখতে। গন্ধটাও একটু মৌরী-মৌরী। অহঙ্কারী ইলিশ অবশ্য একাধিপত্যে বিশ্বাসী। আর কারও খবরদারি তার সহ্য হয় না। কাঁটার বাধা জয় করলেও ইলিশের এই প্রখর ব্যক্তিত্বের অমর্যাদা বরদাস্ত করা অসম্ভব।

ছবি: শুভেন্দু চাকী




অনুমতি ছাড়া এই ওয়েবসাইটের কোনও অংশ লেখা বা ছবি নকল করা বা অন্য কোথাও প্রকাশ করা বেআইনি
No part or content of this website may be copied or reproduced without permission.