ব্যাগ গুছিয়ে...
অন্য উৎসবে
লকাতা স্টেশন থেকে হাজারদুয়ারি এক্সপ্রেস যখন ছাড়ল তখন ঘড়িতে সকাল ৬টা ৫০। চলেছি মুর্শিদাবাদ। নবাব নগরীতে নবাবি আমলের এক বর্ণময় উৎসব চাক্ষুষ করতে। ‘বেড়া’ উৎসব। গত বছর অগস্ট নাগাদ যখন প্রথম শুনি এই উৎসবের কথা, তখনই ঠিক করি, যেতেই হবে মুর্শিদাবাদ। প্রতি বছর ভাদ্র মাসের শেষ বৃহস্পতিবার অনুষ্ঠিত হয় এই উৎসব।
প্রায় চার ঘণ্টায় পৌঁছলাম কলকাতা থেকে মুর্শিদাবাদ। মুর্শিদাবাদে হোটেল আছে অনেকই, তবে ঠিক করলাম থাকব ভাগীরথীর তীরে, ইমামবড়ার পাশে। এই চত্বরটায় মাত্র দু’টি হোটেল।
সন্ধ্যায় হোটেলের ছাদে উঠলাম একা। বন্ধুরা তখন ঘরে বিশ্রাম নিচ্ছে। আলোর বন্যায় ভাসছে হাজারদুয়ারি প্রাসাদ। প্রাসাদের সামনের মাঠে সিরাজের তৈরি ‘মদিনা’ আলো-আঁধারিতে। সামনে বিরাট ইমামবড়া। ভাগীরথীর জল ছলাৎছল। আর কোনও শব্দ নেই কোথাও। একলা ছাদে বেশ গা ছমছম করে!
‘বেড়া’ উৎসব উপলক্ষে এসেছি বটে, কিন্তু দিন দু’য়েক থাকার সুবাদে মুর্শিদাবাদের যেটুকু ঘুরে নেওয়া সম্ভব তা অবশ্যই দেখব। সঙ্গী অভিজ্ঞ গাইড কার্তিক ঘোষ। একে একে দেখে নিলাম আজিমউন্নিসা (কলিজাখাকি) বেগমের সমাধি, মীরজাফর ও তাঁর বংশধরদের সমাধি, নমকহারাম দেউড়ি (যেখানে নাকি সিরাজকে হত্যা করা হয়), কাঠগোলা বাগান ও প্রাসাদ, জগৎ শেঠের বাড়ি, নসীপুর রাজবাড়ি, নসীপুর আখড়া। কাঠগোলা প্রাসাদ ও জগৎ শেঠের বাড়িতে সেই সময়ের বিভিন্ন দুর্মূল্য জিনিসের যে প্রদর্শনী রয়েছে তা সত্যিই দেখার মতো।
বৃহস্পতিবার সকালটা রেখেছিলাম শুধু হাজারদুয়ারি প্রাসাদ মিউজিয়াম দেখব বলে। প্রাসাদের তিনটি তল জুড়েই প্রদর্শনী। চমকপ্রদ সেই প্রদর্শনী যেমন চোখ ধাঁধানো, তেমনই বিস্ময়কর। ভাল করে দেখতে অনেকটা সময়ই লাগল।
হাজারদুয়ারি থেকে মিরজাফরের ১৫তম বংশধর সৈয়দ রেজা আলি মির্জার বাড়ি ‘কিল্লা নিজামত’-এ ‘ছোট নবাব’ বলেই তিনি বেশি পরিচিত মুর্শিদাবাদে। বয়স ৬৫। অমায়িক ব্যবহার। অল্প সময়ের মধ্যেই গল্প জমে উঠল। গল্প নবাবি আমলের এবং অবশ্যই ‘বেড়া’ উৎসবের।
ছোট নবাব জানালেন, এই ‘বেড়া’ শব্দটি বাংলা ভাষায় প্রচলিত বেড়া নয়। এই ‘বেড়া’ একটি ফারসি শব্দ, যার অর্থ দলবদ্ধ জলযান নিয়ে কোনও মহৎ উদ্দেশ্যে অভিযান করা। প্রথমে সুবেদার ও পরবর্তী কালে বাংলা-বিহার-ওড়িশার নবাব মুর্শিদকুলি খাঁর রাজত্বকালে ১৭০৪-এ প্রথম এই উৎসবের সূচনা হয়। দু’রকমের ব্যাখ্যা পাওয়া যায় এই উৎসব প্রচলনের পিছনে। এখানকার নবাবদের কাছ থেকে বিপুল ধনরত্ন, অর্থ সমেত খাজনা যেত জলপথে উত্তর ভারতে মোগল সম্রাটদের কাছে। সেই ধনরাশি অনেক সময়ে প্রাকৃতিক কারণে বা জলদস্যুদের আক্রমণে জলপথেই খোয়া যেত। সে কারণে খাজনা পাঠানোর পূর্ব মুহূর্তে জলদেবতা খাজা খিজিরের কাছে মানত করা হত এই বেড়া উৎসবের মাধ্যমে।
আর একটি ব্যাখ্যা হল, প্রায় ফি বছর প্রবল বর্ষা ও ভাগীরথীর প্লাবনে মুর্শিদাবাদ ও সংলগ্ন অঞ্চলে অসংখ্য মানুষ ও পশু মারা যেত, ফসল ও সম্পত্তি নষ্ট হত। তাই বর্ষার শেষে ভাদ্র মাসের শেষ বৃহস্পতিবার ধনসম্পদ, স্বাস্থ্য ও নিরাপত্তার কামনায় জলদেবতার (খাজা খিজির-এর) কাছে প্রার্থনা জানানোর এই রেওয়াজ ধর্মীয় আচারের মাধ্যমে। হিন্দু-মুসলিম উভয় সম্প্রদায়ের মানুষই এতে অংশগ্রহণ করেন।
ইমামবড়া থেকে সন্ধ্যায় শোভাযাত্রা শুরু হল হাতি, কুমিরের মুখ বসানো বজরা (বাঁশ, বাখারি, কাগজ দিয়ে তৈরি), আলোকসজ্জা, ব্যান্ড, তাসা নিয়ে। ইমামবড়ার পাশ থেকে ভাগীরথীর পাড় বরাবর বিরাট মেলাও বসে গিয়েছে উৎসব উপলক্ষে। দুপুরের পর থেকেই পিল পিল করে লোক ঢুকল সে পথ দিয়ে। শোভাযাত্রা ইমামবড়া থেকে গেল ওয়াসিফ মঞ্জিল পর্যন্ত। সেখানে ছোটে নবাব ও নবাব পরিবারের অন্য বংশধররা ‘বেড়া’য় (প্রতীকী জলযান ওই বজরাগুলিতে) ‘সেহরা’ অর্থাৎ ফুলের মুকুট পরালেন। এর পর ‘বেড়া’ নিয়ে শোভাযাত্রা ফিরে এল আবার ইমামবড়ার পাশে তোপখানা ঘাটে। ভাগীরথীর তীরে ৪০ ফুট লম্বা ও ৪০ ফুট চওড়া এক বিরাট কলার ভেলায় তোলা হল এই সব প্রতীকী বজরা এবং অসংখ্য প্রদীপ ও আতসবাজি-সহ বিভিন্ন কাঠামো।
ঘাটের পাশের ছোট মঞ্চে উপস্থিত বিশিষ্ট অতিথি। জেলাশাসক, জেলা ও দায়রা বিচারক, নবাব পরিবারের প্রতিনিধিদের উপস্থিতিতে সেখানে জ্বালানো হল সোনা ও রুপোর প্রদীপ। ফল, সুজি, দুধ, ঘি দিয়ে তৈরি খাবার ‘রোট’ নিবেদন করা হল জলদেবতার উদ্দেশে। ঘড়িতে তখন রাত ১১টা। এ বার ঘাট থেকে ওই বিরাট কলার ভেলার বাঁধন কেটে দেওয়া হল। ভেলা ভাসতে শুরু করল ভাগীরথীর বুকে।
বন্ধু মলয় আর বিশ্বজিৎ এরই মধ্যে একটা দারুণ কাজ করেছে। একটা নৌকোর ব্যবস্থা করেছে যাতে আমরা জলপথে ‘বেড়া-যাত্রা’কে অনুসরণ করতে পারি। তোপখানা ঘাট থেকে ‘বেড়া’ যে মুহূর্তে বাঁধনছিন্ন হয়ে ভাসল, ভাগীরথীর দু’পাড়ে শুরু হয়ে গেল আতসবাজির প্রদর্শনী। দু’পাড়ে হাজার হাজার মানুষ দাঁড়িয়ে। হাজারদুয়ারির চোখ ধাঁধানো শোভার প্রেক্ষাপটে ভেসে যাচ্ছে ভেলা। অসংখ্য প্রদীপ জ্বলছে তাতে। বাজি ফাটছে, কোনওটা আকাশে উড়ছে, কোনওটা আবার ভাগীরথীর জলে চরকি হয়ে ঘুরছে। আমাদের নৌকো ছাড়াও বেড়াযাত্রায় সামিল আরও বেশ কিছু নৌকো। আলো-আঁধারিতে জলে রংবাহারি আলোর প্রতিবিম্ব। অদ্ভুত সুন্দর এই জলযাত্রা। জলের তালে ভাসতে ভাসতে ‘বেড়া’-সহ কলার ভেলা শেষ পর্যন্ত আটকে গেল ওয়াসিফ মঞ্জিল-এর সামনের ঘাটের কাছে গ্যাংওয়েতে। ব্যস, বিভিন্ন নৌকো ও ঘাট থেকে প্রচুর মানুষ মুহূর্তের মধ্যে এসে বেড়া-র সামগ্রী লুঠ করে নিলেন। এটাই প্রচলিত রীতি এই উৎসবের। বেড়া-র এই সব সামগ্রী পবিত্র জিনিস হিসেবে তাঁরা ঘরে রেখে দেবেন।
উৎসব শেষ। বাজি, প্রদীপ ও অন্যান্য আলোর রোশনাই থেকে নৌকো ফিরে চলেছে তোপখানা ঘাটের দিকে। আলো থেকে অন্ধকারের পথে।

কী ভাবে যাবেন
কলকাতা স্টেশন থেকে হাজারদুয়ারি এক্সপ্রেস কিংবা শিয়ালদহ স্টেশন থেকে
ভাগীরথী এক্সপ্রেসে গেলে মুর্শিদাবাদ স্টেশনে নামতে হবে। এ ছাড়া শিয়ালদহ ও হাওড়া
থেকে অন্যান্য ট্রেন বা ধর্মতলা থেকে বাস ধরে নামতে হবে বহরমপুর। সেখান থেকে
গাড়ি বা অটোরিকশায় পৌঁছে যান ১৪ কিলোমিটার দূরে অবস্থিত মুর্শিদাবাদে।
কোথায় থাকবেন
মুর্শিদাবাদে থাকার হোটেল বেশ কিছু থাকলেও ভাগীরথীর তীরে ইমামবড়ার
পাশে থাকার রোমাঞ্চই আলাদা। এখানে কয়েকটি বেসরকারি হোটেল আছে।
মনে রাখবেন
এ বছর ‘বেড়া’ উৎসব অনুষ্ঠিত হবে আগামী ১৩ সেপ্টেম্বর।
হাজারদুয়ারি প্যালেস মিউজিয়াম বন্ধ থাকে প্রতি শুক্রবার।




অনুমতি ছাড়া এই ওয়েবসাইটের কোনও অংশ লেখা বা ছবি নকল করা বা অন্য কোথাও প্রকাশ করা বেআইনি
No part or content of this website may be copied or reproduced without permission.