নিমতার নিখোঁজ স্কুলছাত্রী সোহিনী পালের দেহ মিলেছে। কিন্তু, কোথায় রয়েছেন হরিণঘাটার কলেজছাত্রী সোনালি ঘোষ?
উত্তর জানা নেই সোনালির পরিবারের। অন্ধকারে পুলিশও। সোনালিও সোহিনীর মতোই পড়তে বেরিয়ে আর বাড়ি ফেরেননি। ১৩ অগস্ট থেকে নিখোঁজ ছিলেন সোহিনী। এক দিন পর থেকেই সোনালি। দুই ঘটনায় আপাত কোনও যোগসূত্রও নেই। তবে, সোহিনীর (১৭) পচা-গলা, ক্ষতবিক্ষত দেহ বুধবার রাতে হুগলি নদী থেকে উদ্ধার করে নর্থ পোর্ট থানার পুলিশ। সোনালির খোঁজ এখনও মেলেনি।
১৪ অগস্ট সকালে নদিয়ার হরিণঘাটা নিমতলার বাসিন্দা, বছর উনিশের সোনালি নিখোঁজ হন। পর দিন হরিণঘাটা থানায় নিখোঁজ ডায়েরি হয়। এর পর দু’দিন কল্যাণী মহাবিদ্যালয়ের প্রথম বর্ষের ছাত্রী সোনালি বাড়িতে ফোন করেন। ১৯ অগস্ট ফোন করে তাঁকে ফাঁসানো হয়েছে বলে কান্নাকাটিও করেছিলেন। যে মোবাইল নম্বরগুলি থেকে ফোন এসেছিল, সেগুলিতে ফোন করলে গালিগালাজ করে ফোন কেটে দেওয়া হয় বলে জানান সোনালির মামা বিরাজ দে।
গত ২১ অগস্ট হরিণঘাটা থানায় সমস্ত ঘটনা জানাতে গেলে সোনালির বাবা শঙ্কর ঘোষকে ধমক দিয়ে বের করে দেওয়া হয় বলে অভিযোগ। শঙ্করবাবু বলেন, “পুলিশ তদন্ত না করেই বলে দিল, ‘আপনার মেয়ে কোনও ছেলের সঙ্গে পালিয়েছে’। আমাদের কথা শুনলেনই না অফিসারেরা।” বুধবার কল্যাণীর এসডিপিও-র কাছে হরিণঘাটা থানায় পুলিশি দুর্ব্যবহার ও তদন্তে গাফিলতির অভিযোগ জানিয়েছেন শঙ্করবাবু। এসডিপিও চন্দ্রশেখর বর্ধন বলেন, “শঙ্করবাবুর অভিযোগ খতিয়ে দেখে অবিলম্বে ব্যবস্থা নিচ্ছি। ইতিমধ্যে ওই ফোন নম্বরগুলো যাচাই করা হচ্ছে। হরিণঘাটার আইসি-র কাছে রিপোর্ট চাওয়া হয়েছে।” |
বছর খানেক আগে পাড়ারই এক কাঠ মিস্ত্রি তাঁকে অপহরণের চেষ্টা করেছিল বলেও অভিযোগ সোনালির পরিবারের। যে গাড়িতে করে অপহরণের ছক কষা হয়েছিল, তার চালকই শঙ্করবাবুদের সতর্ক করে দিয়েছিলেন। এ ক্ষেত্রে এসডিপিও-র আশ্বাস, “দুর্ভাগ্যজনক ভাবে সোহিনী না ফিরলেও সোনালিকে ফেরানোর সব রকম চেষ্টা করছি।”
বেলঘরিয়ার মহকালী উচ্চ বালিকা বিদ্যালয়ের দ্বাদশ শ্রেণির ছাত্রী সোহিনীকে অবশ্য পুলিশ বাড়ি ফেরানোর সুযোগ পায়নি। নিমতলা ঘাটে বৃহস্পতিবারই তাঁর শেষকৃত্য সম্পন্ন করেছে নিমতার উদয়পুর এলাকার পাল পরিবার।
১৩ অগস্ট মায়ের সঙ্গে বিরাটির শপিং মলে কেনাকাটা সারা পর্যন্ত সব আপাত-স্বাভাবিক ছিল। মা বাড়ি ফেরেন। মেয়ে ‘পড়তে যায়’। তার পর থেকেই খোঁজ মেলেনি সোহিনীর। তার রহস্যমৃত্যুর তদন্তে নেমে কার্যত হিমসিম খাচ্ছেন তদন্তকারী অফিসারেরা। মায়ের ১৪ অগস্ট ছিল তাঁর জন্মদিন। জন্মদিনের আগের রাতে পরিকল্পনা করেই সে নিরুদ্দেশ হয়েছিল বলেই প্রাথমিক তদন্তে মনে করছে পুলিশ। স্কুলের মেধাবী ছাত্রী হিসাবে পরিচিত সোহিনীর কেন এই পরিণতি, তার তদন্তে নেমে পুলিশ জেনেছে, সে আট-আটটি সিমকার্ড ব্যবহার করত। সোহিনীর ব্যক্তিগত ডায়েরি, তার ব্যবহৃত সিমকার্ড, মোবাইলের ‘আউটবক্সে’ জমে থাকা এসএমএসএই সব কিছুই পরীক্ষা করে দেখছেন তদন্তকারীরা।
১৩ অগস্ট রাতেই নিমতা থানায় নিখোঁজ ডায়েরি হয়েছিল। পুলিশ ওই বাড়িতে গিয়ে সোহিনীর হাতে লেখা অসংখ্য চিঠি ও তার মোবাইল পায়। অনেকগুলি চিঠিতেই যাকে উদ্দেশ করে লেখা, তার নাম সাঙ্কেতিক ভাবে লিখে রেখেছিল সোহিনী। মোবাইল থেকে সে নিজের এক আত্মীয়কে বেশ কিছু এসএমএস করেছিল বলে পুলিশের দাবি। ওই সব এসএমএস থেকে বেশ কিছু গুরুত্বপূর্ণ সূত্র পেয়েছেন তদন্তকারীরা। এসএমএসে সে বারবার জন্মদিনের দিনই ‘চলে যাওয়া’র কথা জানিয়েছে। আবার একটি এসএমএসে লেখা ছিল, ‘উচ্চ মাধ্যমিক পরীক্ষার প্রস্তুতি ভালো হয়নি। কী করে মুখ দেখাব? আমার পথ আমি ঠিক করে নিলাম।’
বস্তুত, সোহিনীর মনস্তাত্ত্বিক জটিলতা ছিল কি না, তা-ও পুলিশকে ভাবাচ্ছে। সোহিনীর ডায়েরি থেকে তার এক প্রাক্তন ‘প্রেমিকের’ নামও পাওয়া গিয়েছে বলে পুলিশের দাবি। ওই যুবকের লেখা কিছু চিঠিও পুলিশ পেয়েছে, যেগুলির মধ্যেও বেশ কিছু ‘সাঙ্কেতিক’ শব্দ ব্যবহার করা হয়েছে। সোহিনীর ঘনিষ্ঠ কিছু বান্ধবী ও আত্মীয়ের দিকে অভিযোগের আঙুল তুলছেন তার পরিবারের লোকেরা। এর পরেই ১৯ তারিখ অপহরণের মামলা রুজু করে পুলিশ। মেয়ের রহস্যজনক মৃত্যুর ঘটনায় দিশাহারা বাবা-মা। মা সুপ্রীতিদেবী বলেন, “আমার সঙ্গে জন্মদিনের কেনাকাটা করে পড়তে চলে গেল। আর ফিরল না। লাশকাটা ঘরে ওর দেহটা পড়েছিল। কেন ওকে মরতে হল এর উত্তর কি কোনও দিন পাব?” ব্যারাকপুর পুলিশ কমিশনারেটের এডিসি (বেলঘরিয়া) বিশ্বজিৎ ঘোষ বলেন, “সোহিনীর মৃত্যু আমাদের ভাবাচ্ছে। বুধবার রাতেও আমরা তদন্ত করছিলাম ওই ছাত্রীর লেখা ডায়েরি নিয়ে। তখনও ভাবিনি ওর রহস্যজনক মৃত্যু হবে। এর পিছনে একাধিক কারণ থাকতে পারে। আমরা সব দিক এবং সব অভিযোগ খতিয়ে দেখছি।” |