সকলের দাবি, তারাই ‘আসল’ তৃণমূল। কার সঙ্গে দলীয় নেতৃত্বের ‘ঘনিষ্ঠতা’ কতটা, তা জাহির করতেও চেষ্টার ত্রুটি নেই। বিধির তোয়াক্কা না-করে কারও কারও ব্যানারে সরাসরি ‘তৃণমূল’ নামটাও হাজির! পাশাপাশি নানা উপলক্ষে একাধিক সংগঠনের নামে কুপন ছাপিয়ে সরকারি কর্মীদের থেকে চাঁদা আদায় চলছে চুটিয়ে। পরস্পরকে টেক্কা দিতে সরকারি অফিসে বিভিন্ন দাবিতে বিক্ষোভ-আন্দোলনও লাগাতার।
রাজ্য জুড়ে শাসকদলের ‘অনুগত’ সরকারি কর্মচারীদের বিভিন্ন গোষ্ঠীর এ হেন কার্যকলাপে মন্ত্রী-আমলারা হিমসিম খাচ্ছেন! কোথাও দেখা দিচ্ছে প্রশাসনিক সঙ্কট। কী রকম?
বাম-জমানায় কৃষি দফতরে কিছু নিয়োগ ঘিরে ‘তৃণমূলপন্থী’ কর্মচারী সংগঠনের দুই গোষ্ঠীতে আপাতত প্রবল চাপান-উতোর চলছে। নিয়োগ-বিতর্কের মামলা আদালতে গড়ানোর পরেও যা থামার লক্ষণ নেই। মহাকরণে এক পক্ষ সেই নিয়োগ রদ করতে কর্তাদের কাছে দরবার চালিয়ে যাচ্ছে, অন্য পক্ষ তা বহাল রাখতে মরিয়া। জেলায়-জেলায় সমস্যাটা আরও তীব্র। বস্তুত ‘তৃণমূলপন্থী’ হরেক সংগঠন ও তার নিত্য-নতুন নেতৃত্বের নাম মনে রাখতেই সরকারি আধিকারিকেরা জেরবার। একই বিষয়ে পরস্পর-বিরোধী মত নিয়ে দফায় দফায় স্মারকলিপি পেশ চলছে।
আর এ সবের জেরে কিছু দফতরে কাজকর্ম লাটে ওঠার জোগাড় হয়েছে বলে অভিযোগ। সম্প্রতি দক্ষিণ দিনাজপুরের এক স্বাস্থ্য-কর্তা এমনই ‘সমস্যা’র কথা জানিয়ে তৃণমূলের জেলা নেতৃত্বের দ্বারস্থ হয়েছিলেন। |
‘তৃণমূলপন্থী’ এক সংগঠনের ‘আব্দারে’ অতিষ্ঠ হয়ে শ্রমমন্ত্রী পূর্ণেন্দু বসুকে ফোনে নালিশ করেছিলেন সিউড়ির এক পূর্ত-ইঞ্জিনিয়ার। ‘তৃণমূলপন্থী’ সরকারি কর্মী সংগঠনের সম্মেলন কিংবা তাদের আয়োজিত রক্তদান-শিবিরের জন্য চাঁদা আদায়েরও নজির একাধিক, যে সব কর্মসূচির কয়েকটি আদতে অনুষ্ঠিতই হয়নি বলে অভিযোগ উঠেছে।
তৃণমূলের উচ্চ নেতৃত্ব কী বলছেন?
তাঁরা এ ভাবে চাঁদা তোলার বিরোধী। তা জেনেও কেউ কেউ যে সংগঠনের নামে টাকা আদায় করছে, সে খবর কলকাতায় দলের শীর্ষ স্তরের নেতা বা সরকারের গুরুত্বপূর্ণ মন্ত্রীদের কানে পৌঁছচ্ছে। সমমনোভাবাপন্ন সরকারি কর্মচারীদের এক ছাতার নীচে আনার দায়িত্ব মুখ্যমন্ত্রী মমতা বন্দ্যোপাধ্যায় যাঁকে সঁপেছিলেন, দলের সেই মহাসচিব তথা শিল্পমন্ত্রী পার্থ চট্টোপাধ্যায় বলছেন, “কোনও ভাবেই চাঁদা তুলে দলের ভাবমূর্তি নষ্ট হতে দেব না। সরকারি কর্মীদের আন্দোলনের নামে কর্মসংস্কৃতিও নষ্ট করা চলবে না।”
তাতেও অবস্থা বিশেষ পাল্টায়নি। পূর্বতন বামফ্রন্ট সরকারের বিরুদ্ধে সর্বস্তরে আন্দোলন সংগঠনের লক্ষ্যে বাম-বিরোধী সরকারি কর্মীদের এককাট্টা করতে উদ্যোগী হয়েছিলেন তদানীন্তন বিরোধী নেত্রী মমতা। যার অঙ্গ হিসেবে ইউনাইটেড স্টেট গভর্নমেন্ট এমপ্লয়িজ ফেডারেশন (ইউএসজিইএফ) নামে একটি ‘ছাতা’র তলায় তৃণমূল-অনুগামী বিভিন্ন সরকারি কর্মী সংগঠনকে নিয়ে আসার চেষ্টা শুরু হয়। বাম-বিরোধী চার-পাঁচটি প্রধান সংগঠনের নেতাদের নিয়ে ৪১ জনের ‘কোর কমিটি’ও গড়া হয়, যার সভাপতি হন বর্তমানে তৃণমূল বিধায়ক তথা স্টেট গভর্নমেন্ট এমপ্লয়িজ ফেডারেশন (সংযুক্ত)-এর রাজ্য সম্পাদক মৃগেন মাইতি। বিভিন্ন সংগঠনকে নিজেদের ‘অবলুপ্তি’ ঘোষণা করে মূল সংগঠনে মিশে যাওয়ার নির্দেশ দেওয়া হয়েছিল তখনই। কিন্তু ‘পরিবর্তনের’ ১৫ মাস পরেও যে সব গোষ্ঠীকে ঐক্যবদ্ধ করার প্রক্রিয়া শেষ হয়নি, পার্থবাবু তা মানছেন।
তাঁর বক্তব্য, “শীঘ্র একটি সম্মেলনের মাধ্যমে এই কাজ শেষ করা হবে।” |
কিন্তু বাস্তবে তা কার্যকর করা কি আদৌ সম্ভব?
তৃণমূলের বিভিন্ন সংগঠনের নেতারা পার্থবাবুর সুরে ‘ঐক্যের’ কথা বললেও প্রশ্নটি এই মুহূর্তে যথেষ্ট প্রকট। যেমন আইএনটিটিইউসি-র নেতা শোভনদেব চট্টোপাধ্যায়ের কথায়, “নেত্রীর স্পষ্ট নির্দেশ, ইউএসজিইএফ-ই হবে তৃণমূলপন্থী সরকারি কর্মীদের একমাত্র সংগঠন। আইএনটিটিইউসি-র অন্তর্ভুক্ত বলে নিজেদের দাবি করে সরকারি কর্মীদের কর্মসূচি চলবে না।” যদিও খাস মহাকরণে এমন কিছু সংগঠনের অফিস বন্ধ করা যায়নি। ‘কোর কমিটি’র সভাপতি মৃগেনবাবুও স্বীকার করেন, বিধায়কের দায়িত্ব পালনের জন্য সংগঠনের কাজকর্মে সময় দিতে তাঁর অসুবিধে হচ্ছে। সমস্যার সুরাহায় স্টেট গভর্নমেন্ট এমপ্লয়িজ ফেডারেশনের রাজ্য সভাপতি মনোজ চক্রবর্তী বা স্টেট গভর্নমেন্ট তৃণমূল এমপ্লয়িজ ফেডারেশনের সভাপতি মঙ্গলময় ঘোষও তাকিয়ে আছেন নেত্রীর নির্দেশের দিকে।
অন্য দিকে দলীয় সূত্রের খবর: সংযুক্তিকরণের পরে ইউএসজিইএফের নেতা কারা হবেন, তাই নিয়েই বিভিন্ন সংগঠনের মধ্যে গোল বাধছে। এবং ওই সব সংগঠনেরই নাম করে বিবিধ ‘কারণ’ দেখিয়ে নিয়মিত চাঁদা আদায় চলছে বলে অভিযোগ। চাঁদার অঙ্ক দশ-কুড়ি থেকে শুরু করে হাজার টাকা। মনোজবাবু-মঙ্গলময়বাবুরা অবশ্য এতে বিশেষ অন্যায় দেখছেন না। বরং যুক্তি দিচ্ছেন, “শাখা সংগঠনগুলো তো এ ভাবেই টিকে থাকে!”
কিন্তু সরকারি কর্মচারীদের সংগঠনে তো কোনও দলের নাম থাকতে পারে না! তা-ও তৃণমূল নামধারী সংগঠনের কার্যকলাপ চলছে কী ভাবে?
এর সদুত্তর নেতাদের মুখে মেলেনি। উপরন্তু যে সংগঠনের ‘ছত্রচ্ছায়ায়’ সকলকে নিয়ে আসার কথা বলা হচ্ছে, সেই ইউএসজিইএফের কো-অর্ডিনেটর পার্থ চট্টোপাধ্যায় (কৃষি দফতরের কর্মী) কবুল করেছেন, “জেলায় কোথাও কোথাও আমাদের সংগঠনের নাম করেও চাঁদা তোলা হয়েছে। ওই সব গোষ্ঠীর সঙ্গে আমরা সম্পর্কচ্ছেদ করেছি।”
তবু আসল-নকল ঘিরে ধন্ধ ঘুচছে না। পরিস্থিতি এমনই যে, দলের কোনও সরকারি কর্মী সংগঠনের প্যাডে কোনও আমন্ত্রণ এলে মন্ত্রীরাও ফাঁপরে পড়ে যাচ্ছেন। কোন সংগঠন দলের অনুমোদনপ্রাপ্ত, আর কোনটা নয়, তা নিয়ে ব্রাত্য বসু বা শ্যামল মণ্ডলের মতো মন্ত্রীরা রীতিমতো সংশয়ে!
এ সব দেখে-শুনে বামপন্থী কো-অর্ডিনেশন কমিটির সাধারণ সম্পাদক অনন্ত বন্দ্যোপাধ্যায়ের টিপ্পনি, “আমাদের বিশেষ কিছু করার থাকছে না। তৃণমূলের অনুগামী ছোট-ছোট সংগঠনই তো আসর জমিয়ে দিচ্ছে!” |