রাষ্ট্রপতি নির্বাচন ঘিরে গত দু’মাসের তিক্ততার পুরোপুরি অবসান হয়েছিল গত কাল ইউপিএ সমন্বয় কমিটির বৈঠকে। আজ রাজ্যের আর্থিক দাবিদাওয়া ঘিরেও বরফ অনেকটাই গলল।
দিল্লি সফরের দ্বিতীয় দিনে আজ প্রধানমন্ত্রী মনমোহন সিংহ ও কেন্দ্রীয় অর্থমন্ত্রী পি চিদম্বরমের সঙ্গে আলাদা আলাদা বৈঠক করেন মুখ্যমন্ত্রী মমতা বন্দ্যোপাধ্যায়। এই জোড়া বৈঠকের পরে তৃণমূল এবং সরকার দুই সূত্রই বলছে বেহাল আর্থিক অবস্থা থেকে রাজ্যকে উদ্ধার করার জন্য কেন্দ্র যে সাহায্যের হাত বাড়িয়ে দেবে, সে ব্যাপারে আর কোনও সন্দেহ নেই। কোন পথে সেটা করা যায় তা-ই নিয়েই আপাতত ভাবনাচিন্তা চলছে।
মমতা নিজে অবশ্য বলছেন, না আঁচালে বিশ্বাস নেই। তবে একই সঙ্গে এ-ও জানাচ্ছেন যে, এর পর রাজ্যের অর্থমন্ত্রী অমিত মিত্র দিল্লি এসে চিদম্বরমের সঙ্গে বৈঠক করবেন। তৃণমূল সূত্রের মতে, কেন্দ্রীয় সাহায্য সত্যি সত্যি হাতে না-আসা পর্যন্ত চাপ বজায় রাখাই দলনেত্রীর কৌশল।
বামেদের হারিয়ে ক্ষমতায় আসা পর থেকেই রাজ্যের ঋণের বোঝা নিয়ে কেন্দ্রীয় হস্তক্ষেপের দাবি জানিয়ে আসছে তৃণমূল। মমতার বক্তব্য, রাজ্যের আয় ২১ হাজার কোটি টাকা। কিন্তু ঋণের সুদ-আসল শোধ করতেই ২২ হাজার কোটি টাকা বেরিয়ে যাচ্ছে। অথচ এর দায় ৩৪ বছর ধরে ঋণ করে যাওয়া বিগত বামফ্রন্ট সরকারের।
মমতার দাবি খতিয়ে দেখতে প্রণববাবু অর্থমন্ত্রী থাকার সময় তৎকালীন ব্যয়সচিব সুমিত বসুর নেতৃত্বে একটি কমিটি গঠন করা হয়েছিল। সেই কমিটি ১৮ হাজার কোটি টাকার একটি আর্থিক প্যাকেজ তৈরি করলেও মুখ্যমন্ত্রী তা মেনে নেননি। তাঁর যুক্তি, সুদ ও আসল পরিশোধের উপর তিন বছরের স্থগিতাদেশ না পেলে কোনও লাভ হবে না। |
চিদম্বরমের সঙ্গে বৈঠক সেরে বেরোচ্ছেন মমতা বন্দ্যোপাধ্যায়। বৃহস্পতিবার নর্থ ব্লকে। ছবি: পি টি আই |
এখন কয়লা-দুর্নীতির অভিযোগ ঘিরে খোদ প্রধানমন্ত্রী যখন বিরোধীদের চাপের মুখে কোণঠাসা, তখন মমতাকে খুশি রাখতে তাঁর দাবিদাওয়ার অনেকটাই কেন্দ্র মেনে নেবে বলে মনে করছে তৃণমূল শিবির। কারণ, এই জটিল সময়ে সব শরিককে সঙ্গে নিয়ে যথেষ্ট সাবধানে পা ফেলতে চাইছেন কংগ্রেস নেতৃত্ব। ফলে প্রধান শরিক তৃণমূলকে রুষ্ট করা রাজনৈতিক ভাবে আদৌ কাম্য নয় কংগ্রেসের।
তবে কেন্দ্রীয় অর্থ মন্ত্রকের কর্তাদের বক্তব্য, নীতিগত ভাবে যদিও পশ্চিমবঙ্গকে আর্থিক সহায়তা দেওয়ার সিদ্ধান্ত হয়েছে, তবু মমতার মূল দাবি মেনে তিন বছর সুদ মকুব করা সম্ভব হবে না। কারণ সে ক্ষেত্রে অন্যান্য রাজ্যের পক্ষ থেকে একই ধরনের চাপ তৈরি হবে। তাই সুদ মকুব না করেও কী ভাবে রাজ্যকে আর্থিক ভাবে চাঙ্গা করা যায় তার সূত্র সন্ধান শুরু হয়েছে। কেন্দ্রীয় অর্থ মন্ত্রক সূত্রে জানা গিয়েছে দু’টি সূত্র নিয়ে প্রাথমিক ভাবে ভাবনাচিন্তা শুরু হয়েছে। প্রথমত, প্রতি বছর ঋণের সুদ বাবদ যে অর্থ রাজ্যকে দিতে হচ্ছে, সেটা রাজ্যকে বিভিন্ন খাতে দীর্ঘ মেয়াদে, কম সুদে ঋণ হিসেবে দেওয়া যেতে পারে। দ্বিতীয়ত, রাজ্যের ঋণ শোধ করার নিয়মনীতি শিথিল করা যেতে পারে। অর্থাৎ, রাজ্য আপাতত শুধু মূলধনই শোধ করুক। পরে অবস্থা বুঝে সুদের বিষয়টি বিবেচনা করা যাবে।
এই সমাধান সূত্র মমতার কাছে কতটা গ্রহণযোগ্য হবে, সেই প্রশ্ন অবশ্য থেকেই যাচ্ছে। বিশেষ করে নতুন ঋণের প্রস্তাবটি। কারণ, আজ হোক বা কাল, সেই ঋণ পরিশোধের ব্যাপার থেকেই যাচ্ছে। এই অবস্থায় নিজের পছন্দমতো আর্থিক প্যাকেজ না পাওয়া পর্যন্ত কেন্দ্রের উপরে চাপ বজায় রাখারই কৌশল নিচ্ছেন মুখ্যমন্ত্রী। সোমবার সংসদে গাঁধী মূর্তির নীচে তৃণমূল সাংসদেরা যে ধর্নায় বসবেন, সেখানে রাজ্যের আর্থিক দাবিই জোরালো ভাবে তুলে ধরা হবে।
দরকষাকষিতে ভাল জায়গায় থাকার কারণে আজ রাজ্যের অন্যান্য সমস্যা নিয়েও কেন্দ্রের কাছে সরব হয়েছেন মমতা। চিদম্বরমের সঙ্গে বৈঠকের পর তিনি বলেন, “সারের দাম বৃদ্ধির বিষয়টি সমস্ত ক্ষুদ্র ও প্রান্তিক কৃষককে চরম বিপদের মুখে ঠেলে দিয়েছে। আমি কেন্দ্রকে জানিয়েছি, এমন কোনও সিদ্ধান্ত যেন না নেওয়া হয় যাতে তাঁরা ক্ষতিগ্রস্ত হন। পঞ্জাবের কৃষকরা ধনী। আমাদের রাজ্যে ছোট চাষীদের সংখা্যা বেশি। তাঁদের পক্ষে এত দাম দিয়ে সার কেনা সম্ভব নয়।” একই সঙ্গে জাতীয় সড়কের ‘বেহাল’ পরিস্থিতির কথাও তুলে ধরেছেন মুখ্যমন্ত্রী।
পাশাপাশি, বেশ কিছু বিষয়ে তিনি যে নিজের অবস্থানে অনড় থাকবেন, তা-ও আজ স্পষ্ট করে দিয়েছেন মমতা। তিনি বলেছেন, “খুচরো ব্যবসা, পেনশনে বিদেশি বিনিয়োগ আমরা কিছুতেই মেনে নিতে পারি না। আমরা সাধারণ মানুষের পক্ষে। গোটা বিশ্বের ছবি দেখলেই বোঝা যাবে যে বিদেশি বিনিয়োগের দরজা খুলে দিলে, শেষ পর্যন্ত কৃষক ও ছোট ব্যবসায়ীরাই মার খান।” |