প্রাথমিকে নিয়োগে বিতর্ক পিছু ছাড়ছে না হাওড়ায় |
নুরুল আবসার • কলকাতা |
হাওড়া জেলায় প্রাথমিক স্কুলগুলিতে শিক্ষক নিয়োগকে কেন্দ্র করে বিতর্ক পিছু ছাড়ছে না। আগামী ২৬ অগস্ট প্রাথমিক স্কুলগুলিতে শিক্ষক নিয়োগের জন্য লিখিত পরীক্ষা নেওয়ার কথা ছিল জেলা প্রাথমিক স্কুল শিক্ষা সংসদের। কিন্তু ওই পরীক্ষার উপরে বৃহস্পতিবার কলকাতা হাইকোর্ট স্থগিতাদেশ দেওয়ায় লিখিত পরীক্ষাকে কেন্দ্র করে অনিশ্চয়তা দিয়েছে। যে সব প্রার্থীকে লিখিত পরীক্ষায় ডাকা হয়েছিল তাঁরা সকলেই ২০১০ সালে লিখিত পরীক্ষা দিয়েছিলেন।
‘বেনিয়ম’ হয়েছিল এই অভিযোগ তুলে গত ২১ জুন স্কুল শিক্ষা দফতর ২০১০ সালের লিখিত পরীক্ষাটি বাতিল করে দেয়। এই সিদ্ধান্তকে চ্যালেঞ্জ করে কয়েকজন প্রার্থী কলকাতা হাইকোর্টে মামলা করেছিলেন। আদালত সাফ জানিয়েছে, আপাতত ২৬ অগস্টের পরীক্ষা বন্ধ থাকবে। মামলা চলবে। যে সব বেনিয়ম রয়েছে তা সংশোধন করার পথ পাওয়া যায় কিনা তা দেখা হবে।
জেলায় প্রায় তিন হাজার প্রাথমিক স্কুলে দীর্ঘদিন ধরে শিক্ষক নিয়োগ হয়নি। ফলে অনেক স্কুলেই শিক্ষক নেই। জরুরি ভিত্তিতে ২০০৯ সালে প্রাথমিক স্কুলগুলিতে শিক্ষক নিয়োগের জন্য সংবাদপত্রে বিজ্ঞাপন দেয় তৎকালীন প্রাথমিক স্কুল শিক্ষা সংসদ। |
|
জেলায় প্রাথমিক স্কুল হাজার তিনেক। |
পদ খালি প্রায় ২০০০। |
২০০৯ সালে পরীক্ষা নেওয়ার কথা ঘোষণা হয়। |
প্রায় ২৯ হাজার প্রার্থী দরখাস্ত করেছিলেন। |
স্থগিতাদেশ পরীক্ষায় |
১৫ হাজার প্রার্থীকে লিখিত পরীক্ষায় ডাকা হয়। |
সাড়ে ৭ হাজার প্রার্থীর সাক্ষাৎকার নেওয়া হয়।
পরে আরও ৬৫ জন প্রার্থীকে সাক্ষাৎকারে ডাকা হয়। |
|
বিজ্ঞাপনের উত্তরে প্রায় ২৯ হাজার প্রার্থী দরখাস্ত করেছিলেন। তাঁদের মধ্যে থেকে ঝাড়াই-বাছাই করে ১৫ হাজার প্রার্থীকে লিখিত পরীক্ষায় ডাকা হয়। পরীক্ষা হয় ২০১০ সালের জুন মাসে। লিখিত পরীক্ষার ফলাফলের ভিত্তিতে সাড়ে ৭ হাজার প্রার্থীর সাক্ষাৎকার নেওয়া হয়। শিক্ষক নিয়োগকে কেন্দ্র করে বিতর্কের শুরু ওই সাড়ে ৭ হাজার প্রার্থীর সাক্ষাৎকারের পর থেকে।
সাক্ষাৎকারে ডাক পাননি এমন কয়েক জন প্রার্থী কলকাতা হাইকোর্টে মামলা করেন। আদালতের নির্দেশে ১৫ হাজার প্রার্থীর লিখিত পরীক্ষার উত্তরপত্র নতুন করে মূল্যায়ণ করা হয়। তার ভিত্তিতে ফের ৬৫ জন প্রার্থীকে সাক্ষাৎকারে ডাকা হয়। এর ফলে প্যানেল তৈরিতে বেশ দেরি হয়ে যায়। এর মধ্যে ২০১১ সালের ১ মার্চ মাসে বিধানসভা নির্বাচনের বিজ্ঞপ্তি জারি হয়। এর ফলে আটকে যায় প্যানেল প্রকাশ।
নতুন সরকার ক্ষমতায় আসার পরে সংসদও চলে আসে বামফ্রন্টের হাত থেকে তৃণমূলের দখলে। তার পর থেকে চাকুরিপ্রার্থীরা প্যানেল প্রকাশের জন্য সংসদের কাছে দাবি জানাতে থাকেন। সংসদের পক্ষ থেকে তৎকালীন শিক্ষামন্ত্রী রবীন্দ্রনাথ ভট্টাচার্যকে জানানো হয় প্যানেলে তৈরিতে ‘বেনিয়ম’ হয়েছে। তাই তা প্রকাশ করা যাবে না। রবীন্দ্রনাথবাবু স্কুল শিক্ষা দফতরকে নির্দেশ দেন তারা যেন ২০১০ সালের উত্তরপত্রগুলি ফের মূল্যায়ণ করে। স্কুল শিক্ষা দফতর জেলা প্রাথমিক স্কুল শিক্ষা সংসদকে নির্দেশ দেয় তারা যেন প্রতিটি উত্তরপত্র এবং সাক্ষাৎকারের ফলাফল তাদের কাছে পাঠিয়ে দেয়। সেই মতো সংসদ ১৫ হাজার উত্তরপত্র এবং সাড়ে ৭ হাজার প্রার্থীর সাক্ষাৎকারের ফল স্কুল শিক্ষা দফতরের কাছে পাঠায়। স্কুল শিক্ষা দফতর সেগুলি পরীক্ষা করে তা ফেরত পাঠায় সংসদে। একই সঙ্গে প্যানেল প্রকাশ করা জন্য তারা সংসদকে নির্দেশ দেয়। তার পরেও সংসদ প্যানেল তৈরি করে তা স্কুল শিক্ষা দফতরের কাছে পাঠায়নি। উল্টে সংসদের পক্ষ থেকে স্কুল শিক্ষা দফতরকে জানানো হয়, লিখিত পরীক্ষা এবং সাক্ষাৎকারের ফলাফলে তারা বেশ কিছু বেনিয়মের সন্ধান পেয়েছে। প্যানেল বাতিল করার দাবি জানায় সংসদ। বিষয়টিকে কেন্দ্র করে স্কুল শিক্ষা দফতর এবং সংসদের মধ্যে বিবাদ বাধে।
সংসদের দাবি মেনে গত ২১ জুন প্যানেল বাতিল করার কথা ঘোষণা করে স্কুল শিক্ষা দফতর। ২৬ অগস্ট নতুন করে পরীক্ষা নেওয়ার কথা ঘোষণা করে সংসদ।
প্যানেল বাতিলের সিদ্ধান্তকে কেন্দ্র করে বিভিন্ন মহলে বিতর্ক ওঠে। পরীক্ষার্থীদের একাংশ প্রশ্ন তোলেন, যাঁদের ক্ষেত্রে বেনিয়ম হয়েছে তাঁদের নাম বাদ দিয়ে বাকিদের মধ্য থেকে প্যানেল প্রকাশ করা হচ্ছে না কেন? ওই বিতর্কের উত্তরে সংসদের চেয়ারম্যান অজয় ভট্টাচার্য বলেছিলেন, “কয়েক জনকে বাদ দিয়ে বাকিদের নিয়ে প্যানেল প্রকাশ করলে যাঁদের নাম বাদ দেওয়া হল তাঁরা মামলা করতে পারতেন। ফলে নিয়োগ প্রক্রিয়ায় দেরি হত। সেই কারণে সংসদ কোনও কোনও বিতর্কের অবকাশ রাখতে চায় না। সবাইকেই লিখিত পরীক্ষায় ডাকা হচ্ছে।” সংসদের দাবি, ২৬ অগস্টের পরীক্ষাকে দুর্নীতিমুক্ত রাখতে তারা সব রকমের ব্যবস্থা নিয়েছে। জেলা প্রশাসনকে প্রস্তাবিত পরীক্ষা প্রক্রিয়ার সঙ্গে সরাসরি যুক্ত করা হয়েছে। হাইকোর্টের নির্দেশ ঘোষণার আগে অবশ্য অজয়বাবু বৃহস্পতিবার সকালেও বলেন, “আমরা নিয়োগ প্রক্রিয়াকে কেন্দ্র করে ভবিষ্যতে কোনও প্রশ্ন উঠতে দেব না।”
অজয়বাবু এত কথা বললেও মামলা কিন্তু এড়াতে পারল না সংসদ। ২০১০ সালে লিখিত পরীক্ষা দিয়েছিলেন তাঁদের মধ্য থেকে কয়েক জন অবিলম্বে প্যানেল প্রকাশের দাবিতে মামলা করেন। বৃহস্পতিবার সেই মামলারই রায়ের পরে সেই অনিশ্চয়তা দেখা দিল কবে শিক্ষক নিয়োগ করা হবে সেই বিষয়টিকে কেন্দ্র করেও। এ দিনের রায়ের পরে অবশ্য অজয়বাবুর সঙ্গে যোগাযোগের চেষ্টা করা হলেও তাঁর মোবাইলের ‘স্যুইচড্ অফ’ থাকায় তা সম্ভব হয়নি।
বেশ কিছু স্কুলের পরিচালন সমিতি এবং প্রধান শিক্ষকেরা এ দিন হাইকোর্টের নির্দেশের পরে হতাশ। তাঁদের বক্তব্য, নিয়োগ প্রক্রিয়া দ্রুত শেষ করা খুবই জরুরি। না হলে শিক্ষকের অভাবে স্কুল চালাতে সমস্যা হচ্ছে। |
|