|
|
|
|
বামনগাছি ‘গণধর্ষণ’ |
‘কুপ্রস্তাবে’ রাজি না হওয়াতেই কি ‘অত্যাচার’, তদন্ত |
নিজস্ব সংবাদদাতা • কলকাতা |
পানশালায় গান গেয়ে কোনও দিন ৩০০, কোনও ১০০০ টাকা মেলে। তবে গান ছাড়াও আরও ‘অনেক’ দাবি থাকে অনেকের। সে দাবি না মেটালে গায়িকাদের নানা ‘সমস্যা’! তেমনই কিছু দাবি না মেটানোর জন্য মধ্যমগ্রামের পানশালার গায়িকাকে বারাসতের বামনগাছিতে ‘গণধর্ষণ’ করা হল কি না, তা খতিয়ে দেখছে পুলিশ। কারণ, পুলিশের কাছে ‘ধর্ষিতা’ দাবি করেছেন, ওই মামলায় ধৃত ‘ব্যান্ড ম্যানেজার’ দেবজ্যোতি করভৌমিকের তরফে তাঁকে ‘আপত্তিকর’ প্রস্তাব দেওয়া হয়েছিল।
মঙ্গলবার ভোরে বামনগাছির মাঝেরপাড়া থেকে ‘আচ্ছন্ন’ অবস্থায় পড়ে থাকা বছর সাতাশের ওই গায়িকাকে উদ্ধার করে পুলিশ। তিনি পুলিশের কাছে অভিযোগ করেন, সোমবার রাতে তাঁকে গণধর্ষণ করা হয়েছে। সেই অভিযোগের ভিত্তিতে পুলিশ মধ্যমগ্রামের ওই পানশালার এক ‘ব্যান্ড ম্যানেজার’ দেবজ্যোতি-সহ ৫ জনকে ধরে। পুলিশ সূত্রের খবর, বছর কয়েক আগে মধ্যমগ্রামের ওই পানশালায় কি-বোর্ড বাজাত দেবজ্যোতি। পরে মধ্যমগ্রাম ছাড়াও কদম্বগাছির একটি পানশালার ‘ব্যান্ড-ম্যানেজার’ হিসেবে কাজ শুরু করে। দু’টি পানশালায় গান গাওয়ার জন্য বহু মেয়েকে নিয়ে যেত সে। ব্যান্ড থেকে যে টাকা মিলত, তার কিছুটা ওই মেয়েদের ভাগ করে দিয়ে, বাকিটা নিজে রাখত। তার সঙ্গে এই কাছে হাত লাগায় তার ভাগ্নে ব্যোমকেশ মুখোপাধ্যায়ও। সবাইকে নিয়ে একটি দলও গড়ে দেবজ্যোতি। গণধর্ষণের অভিযোগে ব্যোমকেশ এবং ওই দলের আরও তিন জনকে ধরেছে পুলিশ। তবে দেবজ্যোতির দিদি ইন্দ্রাণী মুখোপাধ্যায় এ দিনও দাবি করেছেন, “আমার ভাই অনেক গরিব মেয়েকে গান গাওয়ার সুযোগ দিয়ে দু’টো রোজগারের ব্যবস্থা করে দিয়েছে। ওকে এবং আমার ছেলেকে মিথ্যা অভিযোগে ফাঁসানো হয়েছে।”
গাইঘাটার বাসিন্দা ওই যুবতী স্বামী-বিচ্ছিন্না। বছর পাঁচেকের ছেলে এবং বাবা-মাকে নিয়ে সংসার। তদন্তে নেমে পুলিশ জেনেছে, ছেলের পড়াশোনার খরচ জোগাড় এবং সংসার চালাতে সম্প্রতি তিনি পানশালায় গায়িকার কাজ নেন। কিন্তু কিছু দিনের মধ্যেই তিনি দেখতে সুন্দর নন এবং বয়স কিছুটা বেশি এই কারণ দেখিয়ে তাঁকে ‘কম কাজ’ দিত দেবজ্যোতি। পুলিশের দাবি, দেবজ্যোতির কিছু ‘আপত্তিকর’ প্রস্তাবও মানেননি মহিলা। সেই থেকে বিবাদের শুরু। এ জন্য কিছু দিন পানশালায় ডাক পাননি ওই যুবতী। পুলিশের কাছে অভিযোগে তিনি জানান, কাজ দেওয়ার জন্য সোমবার সন্ধ্যায় দেবজ্যোতি মাঝেরপাড়ার বাড়িতে তাঁকে নিমন্ত্রণ করে। সেখানে তাঁকে ‘জোর করে’ মদ্যপান করান দেবজ্যোতিরা। তার পরে তাঁর কিছু মনে নেই। চোখ খোলার পরে শারীরিক যন্ত্রণা থেকে তাঁর অনুমান, তাঁকে গণধর্ষণ করা হয়।
কিন্তু ওই যুবতীকে গণধর্ষণ করা হয়েছে কি না, সে ব্যাপারে বুধবারও নির্দিষ্ট ভাবে কিছু জানা যায়নি। মঙ্গলবার বারাসত হাসপাতালে ওই যুবতীর ডাক্তারি-পরীক্ষা হয়। বারাসত হাসপাতালের সুপার পুষ্পেন্দু সেনগুপ্ত বলেন, “ওই মেডিক্যাল রিপোর্ট পুলিশের কাছে পাঠানো হয়েছে।” কিন্তু ওই মহিলা ধর্ষিত হয়েছেন কি না, রিপোর্টে সে ব্যাপারে নিশ্চিত করে কিছু জানানো যায়নি বলেই খবর হাসপাতাল সূত্রের। উত্তর ২৪ পরগনার পুলিশ সুপার চম্পক ভট্টাচার্য বলেন, “আমরা ধর্ষণের মামলাই দায়ের করেছি।”
তবে মধ্যমগ্রামের ওই পানশালা এবং এলাকার অন্য পানশালার একাধিক গায়িকার বক্তব্য, ধর্ষণের মতো ঘটনা না ঘটলেও দারিদ্রের কারণে এই পেশায় এসে তাঁরা নানা ভাবে ‘হেনস্থা’ হচ্ছেন। তাঁদেরই এক জনের কথায়, “টাকার জন্য বারাসত ও লাগোয়া এলাকার প্রচুর গরিব মেয়ে এই কাজে নেমেছে। প্রতিযোগিতাও বেড়েছে। গান গাওয়া, নাচা ছাড়া, অনেক আপত্তিকর কাজ করতেও বাধ্য করানো হয় মেয়েদের। কাজ চলে যাওয়ার ভয়ে অনেকেই মুখ বুজে তা মেনে নেন।”
সোমবার দেবজ্যোতিদের বাড়িতে ছিলেন ওই পানশালার আর এক গায়িকা রূপশ্রীও (আসল নাম নয়)। বছর কুড়ির রূপশ্রী জানিয়েছেন, বাজারে মাছ কেটে সামান্য আয় তাঁর বাবার। ছোট বোনের সামনেই বিয়ে। তাই মাসখানেক আগে দেবজ্যোতির প্রস্তাবে পানশালায় গাইতে রাজি হয়ে যান। তিনি বলেন, “গান গেয়ে প্রতিদিন ৩০০ টাকা মিলত। তবে মাঝেমধ্যেই পানশালায় নানা গণ্ডগোল হত। তখন টাকা পেতাম না।” আর এক গায়িকা বলেন, “পানশালা থেকে আমাদের একটি পরিচয়পত্র দেওয়া হয়। কিন্তু তা-ও সকলের থাকে না। সে জন্য পুলিশের কাছে যেতে আমরা ভয় পাই।”
দেবজ্যোতিকে মঙ্গলবারই চার দিনের জন্য পুলিশি হেফাজতে পাঠান বারাসত আদালতের বিচারক। বুধবার আরও চার অভিযুক্তকে ওই আদালতে তোলা হলে তাদের ১৪ দিন জেল-হাজতে রাখার নির্দেশ দেওয়া হয়। এ দিন বারাসতে মহিলাদের নিরাপত্তা নিয়ে প্রশ্ন তুলে জেলাশাসকের অফিস ও থানাতে বিক্ষোভ দেখায় এসইউসি। জেলাশাসক সঞ্জয় বনশল এ দিন জেলার সব পানশালায় ‘ক্লোজড সার্কিট’ টিভি বসানো এবং গায়িকাদের প্রশাসনের কাছে এবং সংশ্লিষ্ট পানশালাতে নাম নথিভুক্ত করানোর নির্দেশ দেন। |
|
|
|
|
|