প্রবন্ধ ২...
সংখ্যালঘু বনাম প্রান্তিক
নিয়তির পরিহাস বইকি
নামনি অসমের কোকরাঝাড়, ধুবুরি জেলায় বড়ো জনজাতি বনাম মুসলিম বসতকারীদের হানাহানির প্রতিক্রিয়া অবশিষ্ট ভারতে এক বিচিত্র পরিস্থিতি সৃষ্টি করেছে। বড়োরা অসমের মঙ্গোলয়েড নৃগোষ্ঠীর অন্তর্ভুক্ত এক জনজাতি। এই নৃগোষ্ঠীর অন্যান্য জনজাতি যথা আহোম, নাগা, মিজো, মণিপুরি, খাসি-গারো-জয়ন্তিয়া উপগোষ্ঠীর মানুষরা উত্তর-পূর্বাঞ্চলের সাতটি রাজ্য থেকে ভারতের বিভিন্ন প্রদেশে ছড়িয়ে পড়েছেন। তাঁদের একটা বড় অংশ কলেজ-বিশ্ববিদ্যালয়ে পড়াশোনা করছেন, বাকিরা চাকরি-বাকরি, ভাগ্যান্বেষণ। এঁদের মধ্যে কেউ-কেউ বড়ো জনজাতির, অধিকাংশই নন। অথচ হিন্দুস্তানের মূল স্রোতের জনমণ্ডলীর চোখে উত্তর-পুবের এই সব জনজাতির চেহারাই একই রকম ঠেকে। কোকরাঝাড়ের বড়ো-মুসলিম দাঙ্গা অবশিষ্ট ভারতে মুসলিম-মঙ্গোলয়েড দ্বন্দ্বের সৃষ্টি করেছে।
মুম্বই, পুণে, বেঙ্গালুরু, চেন্নাই, হায়দরাবাদের মতো জায়গায় জনজাতির মানুষ মুসলিমদের দ্বারা আক্রান্ত হয়েছেন। এসএমএস এবং সোশাল নেটওয়ার্কিং সাইট মারফত ঘৃণা ও বিদ্বেষ ছড়িয়ে দেওয়া হচ্ছে। তিব্বতিদের উপর চিনা সৈন্যদের নির্যাতনের ছবি দেখিয়ে বলা হচ্ছে, অসমে মুসলিমদের নির্যাতিত হওয়ার দৃশ্য। রোহিঙ্গা মুসলিমদের উপর মায়ানমারের বৌদ্ধদের হামলা, গৃহদাহ ও লুঠতরাজের ছবিও একই ভাবে ‘জাল’ করে উত্তর-পুবের জনজাতিদের বিরুদ্ধে মারমুখী প্রতিহিংসার মনোভাব উস্কে দেওয়া হচ্ছে। কিছু মতলববাজই যে এই অপকর্মটা করছে, তাতে সংশয় নেই। তবে এর ফলে ভীত, সন্ত্রস্ত জনজাতিরা পড়া ছেড়ে, হস্টেল ছেড়ে, কর্মস্থল ছেড়ে, ভাড়াবাড়ি ছেড়ে সপরিবার গুয়াহাটির ট্রেনের টিকিট কাটছেন। বেঙ্গালুরু, পুনে, হায়দরাবাদ, চেন্নাই ও মুম্বই স্টেশনে উত্তর-পুবের জনজাতিদের ভিড়। হিন্দুস্তান ছেড়ে তাঁরা আবার নাগাল্যান্ড, মিজোরাম, মণিপুরে ফিরতে চান। ‘বৈচিত্র্যের মাঝে ঐক্য’, ‘বিবিধের মাঝে মিলন মহান’-এর ভারতীয় সাধনার তবে কী হবে?
সন্ত্রস্ত্র। কোকরাঝাড়, অসম।

উত্তর-পূর্বাঞ্চল বরাবরই প্রান্ত। কেন্দ্রের সঙ্গে, দিল্লি বা হস্তিনাপুরের সঙ্গে মণিপুরের দূরত্ব যোজন-যোজন। অর্জুনরা সেখানে যুধিষ্ঠিরের হয়ে অশ্বমেধ যজ্ঞের ঘোড়া নিয়ে যেতেন। জয় করা হয়ে গেলে ফিরেও আসতেন। এর বেশি মহাভারতে আর কোনও প্রাসঙ্গিকতা বা গুরুত্ব ছিল না কেন্দ্রের কাছে এই প্রান্তের। স্বাধীনতার কালেও উত্তর-পূর্ব ভারত আপন স্বাতন্ত্র্য বজায় রাখতে চেয়েছিল। ব্রিটিশ উপনিবেশের উত্তরাধিকারে গর্বিত জওহরলাল নেহরুর হিন্দুস্তান জনজাতীয় বিভিন্নতাকে জাতীয় সংহতিতে আত্তীকরণ করার এমন পরীক্ষাগার হাতছাড়া করতে চায়নি। পরীক্ষানিরীক্ষার ফল সবসময় অভিপ্রেত হয়নি। কিন্তু শিখ রেজিমেন্ট কিংবা অসম রাইফেল্স-এর উদ্যত সঙিন কিংবা ‘সশস্ত্র বাহিনী বিশেষ ক্ষমতা আইন’-এর গণতন্ত্র ছাপিয়েও উত্তর-পুবের জনজাতিরা, কী আশ্চর্য, ভারতীয়ত্বের সাধনায় অংশী হতে চেয়েছে। লন্ডন অলিম্পিকে মেরি কম কিংবা দেবেন্দ্র সিংহদের ভূমিকায় কেবল চিত্রাঙ্গদার মণিপুর নয়, অর্জুনের হস্তিনাপুরও সমান গর্বিত বোধ করেছে। জনজাতির ভূখণ্ডে হস্তিনাপুরের প্রতিনিধিরা কেবল শোষণ করতে গেছে। ব্যবসা করতে, চা-বাগান করতে, অরণ্যসম্পদ লুঠ করতে, কাঠের চোরাকারবার করতে, তেল ও প্রাকৃতিক গ্যাসের মতো ভূগর্ভস্থ খনিজ সম্পদ নিষ্কাশন করতে। উত্তর-পুবের জনজাতিরা কিন্তু ভারতে ছড়িয়ে পড়েছে ভারতীয় হতে। ভারতকে শোষণ করার মতো পুঁজি তাদের নেই, দেবার মতো সাংস্কৃতিক সম্পদ অঢেল। আজ তাদের ভারত-ছাড়া করে জনজাতীয় কূপমণ্ডূকতায় ফিরিয়ে দিয়ে আমরা কী বার্তা দিচ্ছি? প্রান্তকে আর কেন্দ্রের দরকার নেই?
ব্যাপারটা একটু জটিল হয়েছে জনজাতি খেদানোয় মুসলিমদের ভূমিকায়। অসমে কিংবা উত্তর-পুবের অন্য রাজ্যগুলিতে মুসলিমরা এখনও সংখ্যালঘু, বাংলাদেশ থেকে নিরন্তর অনুপ্রবেশ সত্ত্বেও সংখ্যালঘু। কিন্তু অসমেরই আটটি জেলায় মুসলিমরা জনসংখ্যায় গরিষ্ঠ হয়ে গেছেন, বড়োল্যান্ড স্বশাসিত অঞ্চলেও তা-ই। বড়োদের জমি হস্তান্তরিত হয়ে মুসলিমদের দখলে চলে যাওয়ার আশঙ্কা এবং সংখ্যাগুরু হয়েও মুসলিমদের রাজনৈতিক-প্রশাসনিক ক্ষমতা হাতে না পাওয়ার বঞ্চনাবোধ ও ক্ষোভ থেকেই নামনি অসমে দাঙ্গার সূত্রপাত। এই ঘটনার প্রতিক্রিয়ায় মূল ভারতীয় ভূখণ্ডে মুসলিমরা যেখানে বড়ো-খেদাও বা জনজাতি-খেদাও অভিযানে শামিল, সেখানেও তাঁরা কিন্তু বরাবরের সংখ্যালঘু। তবে এই সংখ্যালঘুত্ব ধর্মীয় তথা সাম্প্রদায়িক। এবং শিখ, খ্রিস্টান, জৈন, পার্সি, বৌদ্ধ প্রভৃতি অন্যান্য ধর্মীয় সংখ্যালঘুদের তুলনায় ভারতীয় মুসলিমরা রীতিমত সংখ্যাগুরু, প্রভাবশালী, সংগঠিত জনগোষ্ঠী। তাঁদের সংখ্যালঘুত্ব কেবল হিন্দুদের নিরিখে। অন্য দিকে জনজাতিরা হচ্ছে ভারতের সবচেয়ে শোষিত, নিপীড়িত, বঞ্চিত সংখ্যালঘু। তাদের সংখ্যালঘুত্ব জাতিগত বলে সংবিধান পর্যন্ত তাদের নিয়ে বিশেষ মাথা ঘামায়নি, রাজনীতিকরাও ঘামান না। আজ যখন নামনি অসমে বড়োরা দাঙ্গার শিকার, তাদের ঘরবাড়ি জ্বলছে, নয়ানজুলিতে লাশ পচছে কিংবা ত্রাণশিবিরে উদ্বাস্তুর গ্লানি নিয়ে তাদের দিন কাটছে, তখন বিজেপির মতো জাতীয় দল কিংবা অসম গণপরিষদের মতো প্রাদেশিক দল তাদের সমর্থনে মায়াকান্না কাঁদছে তারা প্রান্তবাসী জনজাতি বলে নয়, তাদের আক্রমণকারীরা মুসলিম বলে। অর্থাৎ সংহতিজ্ঞাপন কিংবা ত্রাণ-পুনর্বাসনের রাজনীতিটাও সাম্প্রদায়িক সংকীর্ণতায় ক্লিষ্ট।
সংসদের উভয় কক্ষে উত্তর-পুবের পলাতক জনজাতিদের সুরক্ষায় বিজেপির মুখর সওয়ালের পিছনে মুসলিম-বিরোধিতার সাম্প্রদায়িক রাজনীতির খেলা লক্ষ না করে পারা যায় না। কিন্তু মুসলিমরাও উত্তর-পুবের জনজাতি-খেদাও অভিযানে নেমে আসলে হিন্দু ভারতের, রাষ্ট্রীয় স্বয়ংসেবক সঙ্ঘের প্রিয় কল্পরাষ্ট্রের এজেন্ডাকেই মজবুত করছেন। এত দিন উচ্চবর্ণের হিন্দুরা এই জনজাতিদের প্রতি যে বিরূপতা ও বিদ্বেষ প্রদর্শন করত, যে ভাবে পথে-ঘাটে, হোটেল-রেস্তোরাঁয় মিজো কিশোরী বা নাগা যুবতীদের সঙ্গে ব্যবহার করত, শিখ রেজিমেন্ট ফিজো’র নাগাল্যান্ডে গিয়ে আঙ্গামি ও আও নাগা রমণীদের সঙ্গে যে-আচরণ করে এসেছিল (যে জন্য নেহরুকে এক সময় রেজিমেন্ট তুলে নিতে হয়), মুসলিমরা হিন্দুস্তানের মূল ধারার প্রতিনিধি হতে গিয়ে সেই ভূমিকা পালন করছেন।

সংখ্যাগুরু যেমন সংখ্যালঘুকে শোষণ-নির্যাতন করে, কেন্দ্রও তেমন ভাবেই প্রান্তকে শোষণ করে। বস্তুত, সংখ্যালঘুত্বও এক ধরনের প্রান্তিকতা। একই ভাবে প্রান্তীয়তাও কেন্দ্রের কাছে এক ধরনের সংখ্যালঘুত্ব। আর ধর্মীয় সংখ্যালঘুর সঙ্গে জাতিগত সংখ্যালঘুর বিরোধে লাভবান হবে তো সংখ্যাগুরুই। যদি সংগ্রামই করতে হয়, তবে তার লক্ষ্য হওয়া উচিত সংখ্যাগরিষ্ঠের কাছ থেকে, কেন্দ্রের কাছ থেকে সংখ্যালঘুর তথা প্রান্তের সুযোগসুবিধা আদায়ের দরকষাকষি, আর সে কাজে যুক্তফ্রন্টে সমাবেশিত হতে হবে সব ধরনের সংখ্যালঘুকে, প্রান্তকে। যে মূঢ় ধর্মগুরুরা জুম্মাবারের নমাজের মঞ্চকে উত্তর-পুবের জনজাতি-খেদাও অভিযানের বারুদ সরবরাহের কাজে ব্যবহার করেছে, তারা দেশের মঙ্গল তো কখনওই চায়নি, নিজ সম্প্রদায়ের মঙ্গল কীসে, সে সম্পর্কে ভাবনাচিন্তা করার মস্তিষ্কও রাখে না। তাই উচ্চ বর্ণের ব্রাহ্মণ্যবাদী হিন্দু লেঠেলদের তরফে অনার্য জনজাতি বিতাড়নের ঐতিহাসিক দায়ভাগ তারা নিজেদের কাঁধে তুলে নিয়েছে। বিশ্ব হিন্দু পরিষদ, বজরঙ দল, প্রবীণ তোগাড়িয়াদের ব্রতটা এ ভাবে ভারতের ধর্মীয় সংখ্যালঘুর ব্রতে পরিণত হওয়ার মধ্যে নিয়তির নির্মম পরিহাস আছে বইকি!
আর্যাবর্তের কঠোর ভৌগোলিক চৌহদ্দির মধ্যে কিন্তু এই জনজাতি-বিদ্বেষী অভিযানটা ঘটল না, ঘটল যাকে বলে ভারতীয় উপদ্বীপে, বিন্ধ্যাচলের দক্ষিণে। হিন্দু ভারত কি তবে এ ব্যাপারেও ‘ফ্র্যাঞ্চাইজ’ বিলোতে শুরু করেছে?


First Page| Calcutta| State| Uttarbanga| Dakshinbanga| Bardhaman| Purulia | Murshidabad| Medinipur
National | Foreign| Business | Sports | Health| Environment | Editorial| Today
Crossword| Comics | Feedback | Archives | About Us | Advertisement Rates | Font Problem

অনুমতি ছাড়া এই ওয়েবসাইটের কোনও অংশ লেখা বা ছবি নকল করা বা অন্য কোথাও প্রকাশ করা বেআইনি
No part or content of this website may be copied or reproduced without permission.