প্রবন্ধ ১...
একটি ‘ধামাকা’র জন্ম
নিশশো সাতচল্লিশ সালের পনেরোই অগস্ট দিনটা নাকি শুভ ছিল না, জ্যোতিষশাস্ত্রবিদরা বলেছিলেন। তাই চোদ্দো তারিখ রাত এগারোটা বাজার আগেই দিল্লিতে গণপরিষদের সভা বসে গেল। সভার কাজ শেষ হতে হতেই রাত বারোটা। পনেরো তারিখ। দিনটা সত্যিই শুভ ছিল না। লর্ড মাউন্টব্যাটেন ছাড়া কাউকেই সে দিন ঠিক গরিমায় আপ্লুত দেখা গেল না। সাড়ে নটায় যখন নতুন ভারতীয় মন্ত্রীরা গণপরিষদের দিকে হেঁটে চলেছেন, সাড়ে দশটায় জাতীয় পতাকা উড়তে শুরু করেছে সংসদ ভবনে, তখনও সকলেরই মনে মনে আশঙ্কা পর দিন বোধ হয় আবার আরম্ভ হবে রক্তবন্যা। তাই ক্ষমতা হস্তান্তরের আনুষ্ঠানিকতা হল, গোটা শহরে প্রায় তিনশোটি পতাকা তোলা হল, কিন্তু নাচ-গান সমারোহ হল না। মানুষের আনন্দ দেখা গেল। সরকারি আনন্দ একটু নিচু তারে বাঁধা রইল।
দু’হাজার বারো সালের পনেরো অগস্ট পশ্চিমবঙ্গে বসে যে সরকারি আনন্দের যে লহরি দেখলাম আমরা, উনিশশো সাতচল্লিশের পনেরো অগস্টে তার কানাকড়িও দেখায়নি সদ্যোজাত ভারত সরকার।
আশঙ্কা সত্যি প্রমাণ করে দিল্লিতে পরের দিনই আবার শুরু হানাহানি। বম্বে আর কলকাতায় দোদুল্যমান অনিশ্চয়তা: তেরঙা-লাঞ্ছিত স্লোগান-আনন্দের ফাঁকে ফাঁকে থমথমে ভয়ের পকেট-অঞ্চল। কলকাতার পুব সীমানায় বেলেঘাটায় নীরব অবসন্ন অনশনরত গাঁধীজি। চোদ্দো অগস্ট বাংলার মুখ্যমন্ত্রী সোহ্রাওয়ার্দি তাঁকে জিজ্ঞেস করেছিলেন, পর দিন কী অনুষ্ঠান হবে। গাঁধীর সপাট উত্তর: চার দিকে মৃত্যুলীলা, এর মধ্যে অনুষ্ঠান? পনেরো অগস্ট সারা দিন দেশি-বিদেশি সাংবাদিকের আনাগোনা তাঁর কাছে। তীব্র প্রত্যাখ্যান তাঁর, কিচ্ছু বলবেন না তিনি: “ওদের ভুলে যেতে বলো যে আমি ইংরেজি জানি!”
দিল্লি-বম্বে-কলকাতা তবু পনেরো তারিখটির জন্য হিন্দু-মুসলিম, মুসলিম-শিখ হানাহানি থেকে কিছুটা রক্ষে পেল। নোয়াখালি-লাহৌর-অমৃতসরের মানুষ কিন্তু এক বেলাও ছাড় পেলেন না। বোমা-ছুরি-ছোরার নারকলীলায় অসংখ্য প্রাণ গেল সে দিনও। স্বাধীনতা দিবসের নতুন সকালটিতেও কোটি কোটি মানুষ বুঝতে পারলেন না, আনন্দ করতে চাইলে কোন দেশের হয়েই-বা আনন্দ করবেন পঞ্জাব আর বাংলার বিভাজন-রেখা র্যাডক্লিফ লাইনটি আঁকতে আরও দুই দিন লাগবে কি না। পরের দু’দিনে মাত্র গোটা-পনেরো লক্ষ মানুষ নিহত-আহত-ধর্ষিত-উৎখাত হলেন। সদা-আত্মমোহিত মাউন্টব্যাটেন অবশ্য এ সবের মধ্যেই সাফল্যের আবেশে বিহ্বল: ‘পৃথিবীর ইতিহাসের বৃহত্তম প্রশাসনিক কাজটি’ সমাধা করতে পারলেন তিনিই।
সত্যিই, কী দুর্ভাগা এই দেশ, একটা শুভ স্বাধীনতার দিবস পর্যন্ত নেই তার। কত দেশ তাদের স্বাধীনতার দিনটি কত আনন্দে কাটায়, কত রকমারি উদ্যাপন করে, কিন্তু যে সব ভারতীয় প্রজন্ম উনিশশো সাতচল্লিশ জেনেছেন বা বুঝেছেন, তাঁদের কাছে ‘পনেরোই অগস্ট’ উচ্চারণের আনন্দ গলা দিয়ে বেরোনোর আগেই বেদনায় রুদ্ধ হয়ে যায়। এমন মানুষ ছিলেন যিনি আজীবন পনেরোই অগস্টে উনিশশো সাতচল্লিশকে মনে করে অরন্ধন-অনশনে পালন করেছেন, গাঁধীবাদী না হয়েও গাঁধীর পথেই স্বাধীনতা দিবস কাটিয়েছেন। এমন মানুষ আছেন যিনি আজও পনেরোই অগস্ট ভারতের মানচিত্রটি হাতে নিয়ে বলেন, “তখনও ভারত যেন দুই-হাত ছড়ানো এক মেয়ে, আর দেখো আজকের ছবি, সেই মেয়ের দু’-দুটি হাত কেটে ফেলেছি আমরা!” রক্তাক্ত ছেদনের স্মৃতি পনেরোই অগস্ট, মস্তক-হস্ত-পদ-যোনি এবং রক্তসম্পর্ক ছেদনের স্মৃতি। সেই স্মৃতি যাঁদের কণ্ঠরোধ করে না, হয় তাঁরা ইতিহাস-বোধরহিত সংকীর্ণমনা স্বার্থপর, নয়তো তাঁরা সম্পূর্ণ ভিন্-ভারতের মানুষ, যে ভারত পনেরো অগস্টকে জানেনি কিংবা বোঝেনি।
উনিশশো সাতচল্লিশের পনেরোই অগস্ট দিল্লিই উত্তেজনার প্রাণকেন্দ্র, দিল্লিতেই সবচেয়ে বেশি মানুষ রাজপথের উৎসবে মেতেছিলেন। কিন্তু তার পর থেকে দুর্ভাগা দেশের উত্তরাধিকার পালন করেছে দিল্লি গত পঁয়ষট্টি বছর ধরে রাজধানীর স্বাধীনতা-দিবসের অনুষ্ঠানে বেশ একটা সচেতন নিয়ন্ত্রণ কাজ করে গিয়েছে। আলগা গাম্ভীর্যের আবরণে ঢাকা থেকেছে শুভ-অশুভের ঐতিহাসিক মেলবন্ধন। লাল কেল্লার বক্তৃতা, জনসমাগম, ভবিষ্যতের প্রতিশ্রুতি, সবই থেকেছে, কিন্তু রাষ্ট্রীয় ক্ষমতার গর্জন কিংবা উচ্ছ্বাস আকাশ-বাতাস কাঁপায়নি এ দিনটিতে। আমাদের সে কালের নেতারা এই এক সুবুদ্ধির ঐতিহ্য প্রতিষ্ঠা করে যেতে পেরেছিলেন। স্বাধীনতা দিবসটি পালনীয় দিন। আর প্রজাতন্ত্র দিবসটি উদ্যাপনীয় দিন। দুর্ভাগা হওয়া সত্ত্বেও আমাদেরও নিশ্চয়ই রাষ্ট্রীয় অহঙ্কার দেখানোর লোভ হয়, কুচকাওয়াজের দাপটে, ট্যাঙ্ক-বিমানের গর্বিত সজ্জায়, পুরস্কারের অবারিত বিতরণে, নাচ-গান-প্রদর্শনের আড়ম্বরে দুনিয়াকে তাক লাগাতে ইচ্ছে করে। করাটাই স্বাভাবিক। তবে সে সব কিছুরই দিন হিসেবে নির্ধারিত হয়েছে ছাব্বিশে জানুয়ারি। পনেরোই আগস্ট নয়।
দিল্লির দেখাদেখি এই ঐতিহ্য জায়গা করে নিয়েছে অন্যত্রও। রাজপথের অনুকরণে কলকাতার রেড রোডেও আড়ম্বর কম নয় ছাব্বিশে জানুয়ারিতে। পনেরোই অগস্ট তাতে ভাগ বসায়নি। অন্তত গত বছর পর্যন্ত।
এই বছর অন্য রকম। এই বছর পরিবর্তনের লীলা: পঁয়ত্রিশ বছরের বাম রাজত্বে স্বাধীনতার দিনটিকে তেমন গুরুত্ব না দেওয়ার অন্যায় শুধরোনোর জন্য পশ্চিমবঙ্গের উৎসবমুখী মুখ্যমন্ত্রী এ বার সবান্ধবে নেমে পড়লেন স্বাধীনতার ‘ধামাকা’য়।
কমিউনিস্ট ভাবনায় স্বাধীনতা দেশভাগ কোনওটিই তেমন গুরুত্ব পায়নি, নামমাত্র মাল্যদানের বাইরে বেরোয়নি স্বাধীনতা দিনের কার্যক্রম। সে এক আলাদা ঘরানা। কিন্তু সেই ঘরানা থেকে বার হতে গিয়ে যদি ধরে নেওয়া হয় পনেরোই অগস্টও আসলে নাচ-গান আর ফেস্টুন-ট্যাবলোর ফুর্তির দিন, রাজ্য সরকারের ভাঁড়ারের তলানি দিয়েও সরকারি আড়ম্বর প্রদর্শনেরই দিন, তাতে ফুটে ওঠে কেবল আদ্যন্ত অ-সংস্কৃতি। স্বাধীনতা দিবসের অনুষ্ঠান করতে বাধা নেই কোনও, অবশ্যই তা করা উচিত, কিন্তু সব অনুষ্ঠানেরই যে এক ও অকৃত্রিম ‘ধামাকা’ রূপ হতে পারে না, কোনও কোনও ক্ষেত্রে যে সংযমের নিয়ন্ত্রণেও বাঁধতে হয় তাকে, কিছু মন্দ্র তারে বাজাতে হয় সুর, সেই সংবেদনশীলতা এই অ-সংস্কৃতিতে আশা করা যায় না। বিশেষত এই দু’হাজার বারোতেই যখন স্বাধীনতা দিবসের প্রেক্ষাপট জুড়ে রয়েছে আমাদেরই প্রতিবেশী রাজ্যের সাম্প্রদায়িক হানাহানি আর প্রাণভয়ে পলায়নের বীভৎসতা, তার জন্যও যে কিছু নিচু সুরে বাঁধতে হয় উৎসবের তার, সেইটুকু বোঝার ধৈর্যও এই ধামাকার নেই, থাকার কথা নয়।
ইতিহাসের সুবুদ্ধি না হয় খুব উঁচু কথা হল। কিন্তু দেশের স্বাধীনতা পালনের এত দিনের জাতীয় ঐতিহ্য তো দৃষ্টান্ত হিসেবে সামনেই রয়েছে। সেইটুকু বুঝে নেওয়া কি এতই কঠিন? উৎসব খুব ভাল জিনিস, উৎসব মানুষকে খুশি করে, উৎসবে প্রসাদ বিতরণ করা যায়, আর কিছু না হোক, অনুষ্ঠানের একেবারে সামনের সারিতে প্রেমের কাঙালিদের প্রাণ ভরে বসানোর সরকারি প্রসাদটুকু তো হাতেই থাকে। তাই কি উৎসবের উচ্ছ্বাসের এই বাধ্যবাধকতা?
পনেরোই অগস্ট এক অনন্য দিন, কিন্তু নাচগানখেলাখুশির দিন নয়। লর্ড মাউন্টব্যাটেন এবং মমতা বন্দ্যোপাধ্যায় ছাড়া এই কথাটা না বোঝার ঐতিহাসিক ভুল বেশি কেউ করেননি।


First Page| Calcutta| State| Uttarbanga| Dakshinbanga| Bardhaman| Purulia | Murshidabad| Medinipur
National | Foreign| Business | Sports | Health| Environment | Editorial| Today
Crossword| Comics | Feedback | Archives | About Us | Advertisement Rates | Font Problem

অনুমতি ছাড়া এই ওয়েবসাইটের কোনও অংশ লেখা বা ছবি নকল করা বা অন্য কোথাও প্রকাশ করা বেআইনি
No part or content of this website may be copied or reproduced without permission.