সমস্যা অপেক্ষা কখনও কখনও সমাধান আরও জটিল হইয়া ওঠে। সম্প্রতি কারাগারগুলিতে বিচারাধীন বন্দির সংখ্যা এবং আদালতে জমিয়া ওঠা মামলার সংখ্যা কমাইতে রাজ্য সরকার ‘প্লি বার্গেনিং’ সম্পর্কিত আইনটি প্রয়োগ করিতে আগ্রহী হইয়াছে। ভারতীয় ফৌজদারি আইনের ধারা সংশোধন করিয়া ‘প্লি বার্গেনিং’ অনুমোদন পাইয়াছিল ২০০৫ সালে। ইহা বস্তুত অভিযোগকারী এবং অভিযুক্তের মধ্যে একটি চুক্তি, যাহাতে অভিযুক্ত তাহার দোষ স্বীকার করিলে অভিযোগকারী তাহার বিরুদ্ধে সর্বাধিক গুরুত্বপূর্ণ অভিযোগগুলি উঠাইয়া লইতে পারে, কিংবা সর্বোচ্চ শাস্তির জন্য আবেদন না করিয়া অল্প শাস্তির আবেদন করিতে পারে। প্রাক্তন বিচারপতি ভি এস মলিমথ-এর নেতৃত্বে গঠিত কমিটি ভারতীয় আদালতগুলিতে পাহাড়প্রমাণ মামলার ভার কমাইতে এই আইনের প্রস্তাব করিয়াছিল। মার্কিন বিচার ব্যবস্থায় বহু দিন ধরিয়াই ইহার প্রয়োগ হইতেছে। কিন্তু ভারতে ইহা লইয়া নানা বিতর্ক উঠিয়াছে। অভিযুক্তকে ভয় দেখাইয়া বা লোভ দেখাইয়া অপরাধ স্বীকার করিতে বাধ্য করা হইতে পারে। দীর্ঘ বিচার প্রক্রিয়া এবং খরচ এড়াইবার জন্য নির্দোষও নিজেকে দোষী বলিতে আগ্রহী হইতে পারে। একই অপরাধ করিয়াও একজন লঘু শাস্তি পাইতে পারে কেবল এই আইনের সাহায্যে। অপর দিকে, কাহারও ‘প্লি বার্গেনিং’-এর আবেদন এক বার না-মঞ্জুর হইলে তাহার আত্মপক্ষ সমর্থন অত্যন্ত কঠিন হইয়া যায়। সুপ্রিম কোর্ট তাহার বিভিন্ন রায়ে বলিয়াছে যে, কেবল দোষ স্বীকার করিলেই আদালত কম শাস্তি দিতে বাধ্য, এমন নহে। উপরন্তু, এই আইনের সাহায্য লইতে হইলে যে সকল প্রস্তুতি এবং আলাপ-আলোচনা চালাইবার প্রয়োজন তাহা সহজসাধ্য নহে। তাই ধনীরা ইহার সুযোগ লইয়া লঘু শাস্তি পাইবেন, আর গরিবরা দীর্ঘ সময় বন্দি থাকিবার পর গুরুতর শাস্তি পাইবেন, এই সামাজিক অন্যায়ের সম্ভাবনাও যথেষ্ট।
এই সকল ঝুঁকি সত্ত্বেও ‘প্লি বার্গেনিং’ আইনটি বহু মানুষের কাজে আসিতে পারে, বিশেষত যেখানে অপরাধ সামান্য, কিন্তু বিচারের প্রতীক্ষায় বহু সময় এবং অর্থ নষ্ট হয়। কিন্তু ইহার প্রয়োগে উদ্যোগী হইতে হইলে সতর্কতার প্রয়োজন আছে। প্রথমত, যাহাদের ক্ষেত্রে ‘প্লি বার্গেনিং’ সুপ্রযুক্ত হইবে তাহাদের নিকট ইহাকে পৌঁছাইবার উপায় কী হইবে? দেশে নিম্নতর আদালতগুলির কাজের মূল্যায়ন করিবার পদ্ধতি এমনই যে, মিটমাট করাইবার প্রক্রিয়াগুলি অপেক্ষা মামলা লড়িবার প্রক্রিয়াকে অধিক গুরুত্ব দেওয়া হয়। অতএব ‘প্লি বার্গেনিং’-এর মতো সমঝোতার প্রক্রিয়াগুলি করিতে আদালতগুলি খুব আগ্রহী হইবে, এমন সম্ভাবনা কম। আইনজীবীরাও নিজেদের স্বার্থে মামলা সহজে মিটমাট করিবার পরিবর্তে দীর্ঘ দিন ধরিয়া লড়িতেই আগ্রহী হইবেন বেশি। তাই বিচার ব্যবস্থার মৌলিক কাঠামোর পরিবর্তন না হইলে মিটমাটের বিবিধ প্রক্রিয়া কার্যকর হইবে না। দ্বিতীয়ত, বিচার ব্যবস্থার মূল লক্ষ্য ন্যায়। দ্রুত কার্যসিদ্ধি তাহার প্রধান উদ্দেশ্য নহে। যে কোনও কাজই দ্রুত করিলে ভাল, কিন্তু বিলম্ব এড়াইতে গিয়া মূল লক্ষ্য হইতে ভ্রষ্ট হওয়া চলিবে না। তাই ‘প্লি বার্গেনিং’ প্রভৃতি পদ্ধতিকে ন্যায়বিচারের উপায় বলিয়াই প্রাথমিক ভাবে দেখিতে হইবে। ইহাকে বন্দির ভার কমাইবার উপায় বলিয়া দেখিলে আইনটির অপপ্রয়োগের সুযোগ বাড়িয়া যাইবে। তাহাতে হিতে বিপরীত হইবার আশঙ্কাই অধিক। |