ক্যালেন্ডারের হিসাবে বিশ্বাস করিলে সংযুক্ত প্রগতিশীল মোর্চার সরকারের হাতে এখনও অনেক সময়। পরবর্তী লোকসভা নির্বাচনের নির্ধারিত সময় এখনও না হউক পৌনে দুই বৎসর দূরে। অর্থনীতির সংস্কার করিতে চাহিলে, অতএব, তাহার সময়ের অভাব নাই। কিন্তু রাজনীতির পাটিগণিত আর কবে ক্যালেন্ডার মানিয়া চলিয়াছে! রাজনীতির হিসাব বলিতেছে, সরকারের হাতে মাত্র পাঁচটি সপ্তাহ রহিয়াছে। সংসদে বাদল অধিবেশনের সমাপ্তি হইতে গুজরাত, হিমাচল প্রদেশে বিধানসভা নির্বাচনের দিন ঘোষণা হওয়া পর্যন্ত যতখানি সময়, ইউ পি এ সরকারের হাতে সংস্কারের জন্য ঠিক ততটুকুই সময় রহিয়াছে। বিধানসভা নির্বাচনের পালা সারা হইতে লোকসভা নির্বাচনের ঢাকে কাঠি পড়িয়া যাইবে। তাহার পর কী হইবে, সে কথা পাঁচ জনে জানেন। কাজেই, যাহা করিবার, তাহা এই পাঁচটি সপ্তাহে করিয়া ফেলিতে হইবে। করিবার জন্য অবশ্য কাজের পাহাড় পড়িয়া আছে। প্রধানমন্ত্রীর প্রধান অর্থনৈতিক উপদেষ্টা সি রঙ্গরাজন সম্প্রতি ভারতীয় অর্থনীতির একটি ছবি আঁকিয়াছেন। সেই ছবির মূল রঙ ধূসর। তাঁহার বক্তব্যের সারমর্ম হইল, ভারত গত অর্থবর্ষে যতটুকু করিতে পারিয়াছিল, এই বৎসর সেইটুকু ধরিয়া রাখিতেও তাহাকে অনেকখানি পথ হাঁটিতে হইবে।
কোন পথে, তাহা সরকারের অজানা নহে। অর্থনৈতিক সংস্কারের যে সিদ্ধান্তগুলি সরকারের নীতিপঙ্গুত্বের কারণে বকেয়া আছে, তাহা এই পাঁচটি সপ্তাহে সারিয়া ফেলিতে হইবে। খুচরা ব্যবসায়ে বিদেশি বিনিয়োগের ছাড়পত্রের ব্যবস্থা করিতে হইবে, ভর্তুকির বিপুল বোঝা অন্তত আংশিক ভাবে হইলেও কমাইতে হইবে, ডিজেলের দাম বাড়াইতে হইবে। এই কাজগুলি পাঁচ সপ্তাহের জন্য ফেলিয়া রাখিবার প্রয়োজন ছিল না। মনমোহন সিংহের সরকার বুঝি ভাবিয়াছিল, বালিতে মুখ গুঁজিয়া রাখিলেই বিপদ কাটিয়া যাইবে। তাহা যে হয় না, সেই কথাটি দেওয়ালে পিঠ ঠেকিবার পর সরকারের মাথায় ঢুকিয়াছে। প্রধানমন্ত্রী জানাইয়াছেন, তিনি শরিকদের মধ্যে ঐকমত্য চাহেন। সেই ঐকমত্যের ভরসাতেই তিনি সংস্কারের উত্তাল সমুদ্রে তাঁহার পানসি ভাসাইবেন। সেইমতো তিনি গত সপ্তাহে এ কে অ্যান্টনিকে পশ্চিমবঙ্গে পাঠাইয়াছিলেন মমতা বন্দ্যোপাধ্যায়ের মন বুঝিতে, তাঁহাকে ঐকমত্যের গুরুত্ব বুঝাইতে। মহাকরণে বৈঠক হইয়াছে, কিন্তু তাহাতে কংগ্রেসের প্রত্যাশিত ফল হয় নাই। তৃণমূল নেত্রী শুনিয়াছেন, বিশেষ বলেন নাই। অন্য শরিকরাও সংস্কারের তারবার্তা পাইয়া প্রধানমন্ত্রীর পার্শ্বে দাঁড়াইতে ঝাঁপাইয়া পড়িবেন, ২৪ আকবর রোডও সম্ভবত সেই কথা বিশ্বাস করে না।
আর্থিক সংস্কার বিষয়ে কংগ্রেসের ঝুলিতে যতগুলি অজুহাত রহিয়াছে, শরিকি ঐকমত্য তাহার মধ্যে প্রধান। প্রথম কথা, সংস্কারের জন্য আদৌ ঐকমত্যের প্রয়োজন হইবে কেন? ২০০৮ সালে ভারত-মার্কিন পরমাণু চুক্তির সময় মনমোহন সিংহ বামপন্থীদের সমর্থনের আশায় বসিয়া থাকেন নাই। এখনই বা শরিকদের সম্মতির প্রত্যাশায় থাকিতে হইবে কেন? সংস্কারে বিশ্বাস করিলে কাজে সেই বিশ্বাসের প্রতিফলন ঘটা বিধেয়। আর, শরিকি সম্মতি যদি প্রধানমন্ত্রীর নিকট সত্যই এত গুরুত্বপূর্ণ হয়, তবে সেই সম্মতি নির্মাণের পথ পৃথক। যখন আর উপায়ান্তর নাই, তখন দূত পাঠাইয়া শরিককে বোঝানো, আর সংকট সাময়িক ভাবে মিটিলেই ফের বিস্মৃত হওয়া জোট রাজনীতির আদর্শ নীতি নহে। সংস্কারের প্রশ্নে যদি শরিকি সম্মতি অপরিহার্যই হয়, আলোচনার প্রক্রিয়াটি নিরবচ্ছিন্ন ভাবে এবং সৎ ভাবে চালাইতে হইবে। শরিকদের কথা শুনিতে হইবে, কংগ্রেসের অবস্থান বিশদ বলিতে হইবে। সেই আলোচনার মাধ্যমেই একটি গ্রহণযোগ্য পথ পাওয়া সম্ভব। গত সাড়ে তিন বৎসরে কংগ্রেস তাহা করে নাই। ফলে, প্রধানমন্ত্রী দূত পাঠাইলে শরিকরা বুঝেন, কংগ্রেস প্যাঁচে পড়িয়াছে, এই মওকায় নিজেদের দাবিদাওয়া আদায় করিয়া লওয়াই ভাল। তাহাই চলিতেছে। কংগ্রেস যে পাঁচ সপ্তাহের ভরসায় আছে, সেই সময়েও ইহার অন্যথা হইবে, তেমন আশা কম। |