লোটা-কম্বল নয়, এখন রুকস্যাকের যুগ।
বেড়াতে যাওয়াই হোক বা সিনেমার শ্যুটিং, সেকেলে অভ্যেস বদলাচ্ছে সর্বত্র। আগে বাঙালির বেড়াতে যাওয়া মানে ছিল, হাওয়া বদলে পশ্চিমে যাত্রা। বাক্স-প্যাঁটরা তো বটেই, সঙ্গে যেত বালিশ-চাদর-বিছানা এমনকী শিল-নোড়াও। এখন কাঁধে একটি রুকস্যাক চাপিয়েই বেরিয়ে পড়েন আজকের বঙ্গসন্তান।
ঠিক একই ভাবে লোটা-কম্বল নিয়ে বিদেশে গিয়ে সিনেমার শু্যটিং করার ধারণাটাও পাল্টে যেতে চলেছে। সিনেমার জন্য প্রোডাকশন ইউনিট অপরিহার্য। তার মধ্যে যেমন ক্যামেরা এবং ক্যামেরাম্যান থাকেন, তেমনই সাউন্ড রেকর্ডিস্ট এবং সেই সংক্রান্ত যন্ত্রপাতিও থাকে। ইদানীং বাংলা সিনেমার বড় অংশ বিদেশেই শ্যুট করা হচ্ছে। বেশির ভাগ ক্ষেত্রে মেকআপ ম্যান, কোরিওগ্রাফার-সহ গোটা প্রোডাকশন ইউনিটই সঙ্গে করে নিয়ে যান প্রযোজক-পরিচালকেরা। কিন্তু বদল আসছে সেই ভাবনাতেও। |
এখন বিদেশ থেকেই গোটা প্রোডাকশন ইউনিট ভাড়া নিয়ে শু্যট করতে চাইছেন বাঙালি পরিচালকেরা। তাতে এক দিকে যেমন আধুনিক ক্যামেরা ও যন্ত্রপাতির সাহায্যে ছবির গুণমান বাড়বে, তেমনই প্রোডাকশন ইউনিট বয়ে নিয়ে যাওয়ার খরচও এড়ানো যাবে। ‘শুকনো লঙ্কা’-র পরিচালক গৌরব পান্ডে তাঁর নতুন ছবি ‘হনুমান ডট কম’-এর লোকেশন দেখতে এখন আইসল্যান্ডে। গৌরবের দাবি, ওখানে জার্মানি থেকে প্রোডাকশন ইউনিট ভাড়া করে শ্যুটিং করতে যা খরচ হবে, ভারতের যে কোনও লোকেশনের চেয়ে তা কম!
গৌরব জানান, মেকআপ ম্যান, কোরিওগ্রাফার-সহ গোটা প্রোডাকশন ইউনিট অত দূর বয়ে নিয়ে যাওয়ার খরচ অনেক। যাতায়াতের বিমান ভাড়া ছাড়াও এতগুলো লোকের বিদেশে থাকা-খাওয়ার খরচও কম নয়! তাই নায়ক-নায়িকা, প্রযোজক এবং আরও দু’তিন জন সহকারীকে নিয়ে আইসল্যান্ডে পৌঁছতে চান গৌরব! আইসল্যান্ডে শ্যুট করার সময়ে যদি পার্শ্ব-চরিত্রের প্রয়োজন হয়? গৌরব বলেন, “ইউরোপে অনেক বাঙালি অফার শুনে লাফিয়ে উঠছেন। ছোট দু’একটা রোল তাঁদের দিয়ে করিয়ে নেব। কলকাতা থেকে অভিনেতা-অভিনেত্রী নিয়ে গেলে খরচ বেড়ে যাবে। তা ছাড়া সিনেমার স্বার্থে অনেকে স্থানীয় ভাষায় কথা বলবেন। সেখানে বিদেশিদের নিলে ছবির গ্রহণযোগ্যতাও বেড়ে যাবে।” |
পরিচালক কৌশিক গঙ্গোপাধ্যায় তাঁর পরের সিনেমার জন্য লোকেশন বেছেছেন সুইডেন। বার্গম্যানের দেশ থেকে তিনিও ভাড়া নিতে চলেছেন স্থানীয় প্রোডাকশন ইউনিট। তাঁর কথায়, “খরচ তো কমাতে হবে! খরচ কমানোর জন্যই এ সব দেশে গিয়ে শ্যুটিং করার সময়ে আমরা হোটেলে থাকার কথা ভাবি না। অ্যাপার্টমেন্ট ভাড়া পাওয়া যায়। রান্নাঘর থাকে। দু’জন বাজার করে আনেন। দু’জন রান্না করে নেন। এ ভাবেই কম খরচে চলে যায়। কেউ কেউ তো বিদেশে শু্যট করতে গিয়ে বন্ধু-বান্ধবদের বাড়িতেও থেকে যায়।” তবে খরচের প্রসঙ্গে তিনি পুরোপুরি গৌরবের সঙ্গে একমত নন। তিনি বলেন, “ওঁদের দেশে ক্যামেরা-সহ যন্ত্রপাতির মান অনেক ভাল। তাতে একটা ঝকঝকে ভাব ফুটে ওঠে ঠিকই। তবে খরচ কম হবে, এমনটা মনে হচ্ছে না।”
‘বাই বাই ব্যাঙ্কক’-এর পরিচালক অনিকেত চট্টোপাধ্যায় অবশ্য মনে করেন, বিদেশে শ্যুটিং করলেও সঙ্গে ন্যূনতম লোকবল থাকা প্রয়োজন। তাঁর কথায়, “এখন তো বেশির ভাগ বাংলা সিনেমার প্লটই ভাবা হচ্ছে বিদেশের প্রেক্ষিতে। প্রযোজকেরা যখন তা অনুমোদন করছেন, তখন তো খরচটা বুঝতে পেরেই করছেন।” তবে যন্ত্রপাতির অনেকাংশ বিদেশ থেকে ভাড়া করে চালানোর পক্ষপাতী তিনিও। তাতে সিনেমার গুণগত মান বৃদ্ধি পায়।
তুরস্কের প্রেক্ষাপটে নতুন সিনেমা ‘টা টা টার্কি’ বানানোর তোড়জোড় শুরু করেছেন অনিকেতবাবু। বলেন, “জানতে হবে ওখানকার প্রোডাকশন ইউনিট-এর কী রকম ভাড়া!”
‘খোকাবাবু’র প্রযোজক অশোক ধানুকা অবশ্য এ পথে হাঁটতে রাজি নন। তিনি যত বারই বিদেশে গিয়ে শ্যুট করেছেন, তত বারই প্রোডাকশন ইউনিট সঙ্গে নিয়ে গিয়েছেন। তাঁর কথায়, “বিদেশে প্রধানত গানের শ্যুটিংই হয়। যন্ত্রপাতি থেকে টেকনিশিয়ান, সঙ্গে নিয়ে যাই। ‘খোকাবাবু’র গানের শ্যুটিং করেছি সুইৎজারল্যান্ডে। পুরো ইউনিট নিয়ে গিয়েছি।”
বাইরে থেকে চিত্রপরিচালকরা যখন এ দেশে এসেছেন, তখন তাঁরাও কিন্তু অনেক সময়ই এখানকার কলাকুশলীদের উপরে নির্ভর করেছেন। পুরো প্রোডাকশন ইউনিটই হয়তো এখান থেকে ভাড়া নেননি, কিন্তু অনেক সময়ই এখানকার টেকনিশিয়ানরা তাঁদের সহকারী হিসেবে কাজ করেছেন। এ বার বাংলার পরিচালকরাও সেই পথে হাঁটছেন। রুকস্যাক জমানা সিনেমায় কতটা বদল আনে, সেটাই দেখতে চাইবেন দশর্করা। |